২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নমিনেশন ফরম বিক্রি-জমার কার্যক্রম চলছিল। দলটির নেতাকর্মী মিছিল, ব্যান্ড পার্টি ও ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় ভিড় করেছিল। এ সময় পুলিশ রাস্তা চালু করার নামে লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ছোড়া শুরু করে। মুহূর্তেই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মনোনয়ন উৎসব রূপ নেয় সংঘাতে। ঘটনাস্থল থেকে ৫৯ জনকে আটক করা হয়।

এ ঘটনার জন্য ওই বছর পুলিশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)’ পান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের তৎকালীন উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। পদকপ্রাপ্তির প্রকাশনাতেই কারণ হিসেবে এর উল্লেখ করা হয়েছে।

শুধু আনোয়ার নন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওই বছরে এমন কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ পদক পেয়েছেন অনেকেই। মোট পদক দেওয়া হয় ৩৪৯ জনকে। এত বেশি সংখ্যক পুলিশ পদক ওই বছর ছিল ইতিহাসে সর্বোচ্চ। 

২০১৮ সালের নির্বাচনটি ‘রাতের ভোট’ হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত। সম্প্রতি নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে ওই নির্বাচনের রিটার্নিং ও সহকারী কর্মকর্তারা অনিয়মের জন্য পুলিশকে দায়ী করেন। পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রগুলোও বলছে, মূলত রাতের ভোটের কারিগর হিসেবে ওই সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের এত বেশি পদক দেওয়া হয়।
পদক তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পরের বছরই (২০১৯) পুলিশ পদকের সংখ্যা নেমে আসে এক-তৃতীয়াংশে ১১৮ জন। এর পরের তিন বছরও চিত্র একই রকম; ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে পুলিশ পদক পান ১১৫ জন করে। পরের বছরের পদক দেওয়া হয় ২০২৪ সালে। পদক পান ৪০০ জন। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। দেশে-বিদেশে তা ডামি নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পায়।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বেশির ভাগ কর্মকর্তা নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা রাখার পুরস্কার হিসেবে এই পদক পেয়েছেন। নির্বাচনের আগে-পরে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে দমনপীড়নের স্বীকৃতি ছিল ওই পদক। 

পদক পাওয়া ওই কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন। কয়েকজন গ্রেপ্তারের পর কারাগারে রয়েছেন। একটি বড় অংশ এখনও পুলিশে রয়েছে।

পুলিশ সদস্যদের বীরত্ব, সাহসিকতা, সেবাসহ পেশাদারিত্ব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতিবছর বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) দেওয়া হয়। বিপিএমের জন্য প্রত্যেক পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তা এককালীন হিসেবে পান এক লাখ টাকা এবং বিপিএম-সেবার জন্য পান ৭৫ হাজার টাকা। পিপিএমের জন্য পান এককালীন ৭৫ হাজার এবং পিপিএম-সেবার জন্য ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া বিপিএম ও বিপিএম-সেবার জন্য প্রতি মাসে দেড় হাজার এবং পিপিএম ও পিপিএম-সেবার জন্য মাসে এক হাজার টাকা করে ভাতা পান। পুলিশ সদস্যদের কাছে এই পদক অত্যন্ত সম্মানজনক ও মর্যাদাকর হিসেবে বিবেচিত।

গত ১০ বছরের পুলিশ পদকের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে পুলিশ পদকের হিড়িক পড়ে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের বছরে ৩৪৯ জনকে বিপিএম-পিপিএম দেওয়া হয়েছিল। দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জ ডিআইজিসহ ইউনিটপ্রধানরা পদক পেয়েছিলেন। এর আগে ৬৪ জেলার এসপিসহ সব ইউনিটপ্রধানের একসঙ্গে পদক পাওয়ার নজির নেই।

গত ১৬ বছর নানাভাবে বঞ্চিত ছিলেন– এমন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ভোট ডাকাতির পুরস্কার হিসেবে সে সময় দায়িত্ব পালন করা ৬৪ জেলার এসপি, সব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, সব রেঞ্জ ডিআইজিসহ সব ইউনিটপ্রধানকে পুলিশ পদক দেওয়া হয়। 

বছরের হিসাব গড়াল সাড়ে ১৩ মাসে
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর ২০২৪ সালের পুলিশ সপ্তাহে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মকর্তাকে বিপিএম, পিপিএম দেওয়া হয়েছিল। ৪০০ কর্মকর্তা-সদস্য এই পদক পান। সাধারণত এক বছরের (১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর) কার্যক্রম বিবেচনায় বিপিএম-পিপিএম দেওয়া হলেও ২০২৩ সালে ব্যতিক্রম করা হয়। ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত (১৩ মাস ১০ দিন) কার্যক্রম বিবেচনায় নিয়ে পদক দেওয়া হয়। যদিও ২০২২ সালের পদকের মধ্যেও ডিসেম্বরের কার্যক্রম যুক্ত ছিল। 

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির গণসমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। ৭ ডিসেম্বর নেতাকর্মী জড়ো হলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে নেতাকর্মীর ওপর। ওই কার্যক্রমে অংশ নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের কয়েকজন পদকবঞ্চিত ছিলেন। তাদের পদক দিতে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে পরের বছরের সঙ্গে ওই মাসটি যুক্ত করা হয় বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় যুক্ত করা হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আগে-পরে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ও আন্দোলন মোকাবিলা করা কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করতে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

পদক প্রকাশনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিরোধী দল ও নেতাকর্মীর দমনপীড়ন, দ্বাদশ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসহ নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পুলিশ পদক পেয়েছেন অন্তত ৫৭ কর্মকর্তা।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ সপ্তাহে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের পদক পরিয়ে দেন। পদক পান ৪০০ কর্মকর্তা। এর মধ্যে বিপিএম ৩৫ জন, বিপিএম-সেবা ৯৫, পিপিএম ৬০ ও পিপিএম-সেবা ২১০ জন। 

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০২২ সালে পদক পেয়েছিলেন ১১৫ কর্মকর্তা। ২০২১ সালে ১১৫ জন, ২০২০ সালে ১১৫ ও ২০১৯ সালে ১১৮ জন। ২০১৮ সালে পুলিশ পদক পান ৩৪৯ কর্মকর্তা-সদস্য। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০১৯ সালের পুলিশ সপ্তাহে কর্মকর্তাদের এই পদক পরিয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ৬৪ এসপির মধ্যে বিপিএম-সেবা পান ২৪ জন, ৩৯ জন পিপিএম-সেবা এবং একজন বিপিএম। এর আগে ২০১৭ সালে পদক পান ১৮২ জন, ২০১৬ সালে ১৩২, ২০১৫ সালে ১০২ এবং ২০১৪ সালে ৮৬ জন।

২০১৮ সালে পদক পাওয়া ৬৪ এসপির মধ্যে অন্তত ৩০ জন ২০তম বিসিএসের। অন্যরা ২১, ২২ ও ২৪ বিসিএসের। ২০১৮ সালের পর তাদের পদোন্নতিতে আর বাধা পেতে হয়নি। ২০তম বিসিএস কর্মকর্তার বেশির ভাগই পদোন্নতি পেয়ে ডিআইজি হন। ২১, ২২ ও ২৪ ব্যাচের কেউ কেউ হয়েছেন অ্যাডিশনাল ডিআইজি। তাদের বেশির ভাগই ৫ আগস্টের আগে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে কর্মরত ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তাদের কাউকে বদলি এবং কাউকে রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। দু’জন ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও হারুন অর রশীদ আত্মগোপনে রয়েছেন।

‘দেশবিরোধী নৈরাজ্য’ ঠেকিয়ে আশরাফের বিপিএম
ডিএমপির রমনা বিভাগের তৎকালীন উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন ২০২৩ সালে বিপিএম পান। তাঁর বিষয়ে পুলিশ পদক-সংক্রান্ত প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশবিরোধী নৈরাজ্যজনক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়। মহাসমাবেশের একটি অংশ প্রধান বিচারপতির বাসভবনের কাছে চলে আসে। আন্দোলনকারীরা শান্তিনগর, মালিবাগসহ আশপাশে নাশকতা ও অগ্নিসংযোগ করে। এ অবস্থায় আশরাফ হোসেনের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও নির্দেশে পুলিশ সদস্যরা উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে (বিএনপি নেতাকর্মী) লাঠিচার্জ, শটগান ফায়ার, সাউন্ড গ্রেনেড, স্মোক গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করে এলাকা পরিষ্কার করেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশ পদকে ভূষিত হন আশরাফ হোসেন।

রাজনৈতিক কর্মসূচি মোকাবিলায় ভূমিকা রেখে পদক
২০২৩ সালের পদকপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ডিএমপির ৭৩ জন ছিলেন। ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের আট কর্মকর্তা পদক পান। এই বিভাগের সে সময়ের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান রাজনৈতিক কর্মসূচি মোকাবিলায় সাহসী ভূমিকা রাখায় বিপিএম পদক পান বলে প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়।

পদক-সংক্রান্ত প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়, এক বছরে (২০২৩) ভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রায় ৩০০টি বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি অসংখ্য কর্মসূচি পালিত হয় মতিঝিল বিভাগে। হায়াতুলের নেতৃত্বে এসব কর্মসূচিতে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণসহ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে সহায়তা করে।

খিলগাঁও জোনের তৎকালীন অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার রাশেদুল ইসলামের পিপিএম-সেবা পদক পাওয়ার বিষয়ে প্রকাশনায় বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর একটি রাজনৈতিক দলের (বিএনপি) মহাসমাবেশ উপলক্ষে ৭ ডিসেম্বর ওই দলের পার্টি অফিসের সামনে নেতাকর্মী জড়ো হন। তাদের সড়ক থেকে সরানোর চেষ্টা করলে পুলিশের ওপর হামলা করে। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় নেতাকর্মীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিরোধীদের শক্ত হাতে দমন
তৎকালীন পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল বাতেন বিপিএম (সেবা) পদকে ভূষিত হন ২০২৩ সালে। পদকপ্রাপ্তির কারণ হিসেবে প্রকাশনায় বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন বাধাগ্রস্ত করতে স্বার্থান্বেষী মহল প্রচেষ্টা চালায়। তাঁর নেতৃত্বে রংপুর রেঞ্জ পুলিশ এই প্রচেষ্টা বানচাল করে দেয়। নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার আগে ও পরে অগ্নিসন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ও নাশকতাকারীদের সব পরিকল্পনা শক্ত হাতে দমন করা হয়। ফলে গণতন্ত্রবিরোধী গোষ্ঠী রাজপথসহ কোথাও উল্লেখযোগ্য নাশকতার ঘটনা ঘটাতে পারেনি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় কাজী শফিকুল ইসলাম গাজীপুরের এসপি ছিলেন। নির্বাচনের পর তিনিও বিপিএম পেয়েছেন। তাঁর পদক পাওয়া সম্পর্কে প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা ও বর্তমান সরকারের (ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার) উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনের আগে থেকেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে একটি স্বার্থান্বেষী মহল নির্বাচনকে ভন্ডুল করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অংশ হিসেবে গাজীপুর জেলায় নাশকতা চালায়। তাঁর (এসপি শফিকুল) নেতৃত্বে নির্বাচন প্রতিহতকারী ২৫৬ দুষ্কৃতকারী গ্রেপ্তার এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।

এখন কারা কোথায়
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাদের কাউকে গুরুত্বহীন জায়গায় বদলি এবং কাউকে বিভিন্ন রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। নির্বাচনের পর পদক পাওয়া কর্মকর্তার মধ্যে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমানকে রেলওয়ে পুলিশ সংযুক্ত; বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি ইলিয়াছ শরীফকে অ্যান্টিটেররিজম ইউনিটে সংযুক্ত; ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি শাহ আবিদ হোসেনকে ট্যুরিস্ট পুলিশে সংযুক্ত; বরিশাল মহানগর পুলিশ কমিশনার জিহাদুল কবির ও সিলেট মহানগর কমিশনার জাকির হোসেন খানকে পিবিআইয়ে এবং চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা, খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি মঈনুল হক ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলামকে সারদা পুলিশ একাডেমিতে সংযুক্ত করা হয়। সম্প্রতি সাইফুল ইসলাম গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে সারদায় বদলি ও যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মো.

শহীদুল্লাহকে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়, অ্যাডিশনাল ডিআইজি আলমগীর কবিরকে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে সারদায় বদলি করা হয়। শহীদুল্লাহ সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন। অতিরিক্ত ডিআইজি টুটুল চক্রবর্তীকে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় ও বরিশাল মহানগর পুলিশের উপকমিশনার এস এম তানভীর আরাফাতকে সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

কে কী বলেন
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ২০১৮ সালে এসপির দায়িত্ব পালন করা ১২ জনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে সমকাল। চারজনের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আটজনের মধ্যে পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। লক্ষ্মীপুরের সাবেক এসপি আ স ম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘ভোটের বিষয় রিটার্নিং কর্মকর্তা কথা বলবেন। পুলিশ তো আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি দেখেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে কেন অভিযোগ, সেটি জানি না।’

ফরিদপুরের সাবেক এসপি জাকির হোসেন খান বলেন, ‘এখন বাসের ভেতরে। এসব বিষয়ে কথা বলতে পারব না।’ তিনি বর্তমানে পিবিআইয়ে সংযুক্ত।
বাগেরহাটের সাবেক এসপি পংকজ চন্দ্র রায় সমকালকে বলেন, ‘সবার সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের বিরুদ্ধে কে কোথায় কী অভিযোগ করেছে, জানি না।’ তিনি বর্তমানে রেলওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি।

প্রত্যাহারের উদ্যোগ
২০১৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের বছরে পুলিশের ১০৩ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দেওয়া বিপিএম-পিপিএম প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সক্রিয় দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশের ১০৩ পদস্থ কর্মকর্তাকে ঢালাওভাবে পদক দিয়ে রাষ্ট্রীয় পদকের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

পুলিশ স্টাফ কলেজের অ্যাডিশনাল ডিআইজি আবদুর রাজ্জাক গত ৮ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তিনি লিখেছেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রায় পুরোটাই জেলার ডিসি, পুলিশ সুপার, নির্বাচন অফিসার, অন্যান্য শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টায় নির্ধারিত দিনের আগেই সম্পন্ন হয়েছিল।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘নগদ অর্থের পুরস্কার স্বৈরাচারের কোষাগার থেকে মেটানো হলেও পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রতি মাসে আজীবন ভাতা দেওয়ার বিধান রয়েছে। দিনের পর দিন জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে ভাতা পেতে থাকবেন, তা কীভাবে হয়? নির্বাচনী পদক ও খেতাবগুলো বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, ‘পদক-সংক্রান্ত বিষয়ে ফেসবুকেই তো স্ট্যাটাস দিয়েছি।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, দুই পর্যায়ে নির্বাচনের পর পুলিশের যে পদক দেওয়া হয়েছিল, সেটি বিতর্কিত ছিল। এটি বোঝাই গিয়েছিল পুলিশের যারা নির্বাচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে কর্তৃত্ববাদী সরকারের ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য, তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণায়ও প্রতীয়মান হয়েছে, নেতিবাচক দিক থেকে পুলিশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতায় অব্যাহত রাখার জন্য ভূমিকা রেখেছে। 

পদক বাতিলের বিষয়ে সম্প্রতি যে প্রশ্ন উঠেছে সেটি যৌক্তিক উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাতিল যেন ঢালাওভাবে না হয়। কোনো নিরপরাধ কর্মকর্তাকে যেন পদক থেকে বঞ্চিত করা না হয়।

সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, যদি ভালো কাজ করা হয়ে থাকে, তাহলে পদক পেতেই পারে। তাই সংখ্যা বাড়ার ক্ষেত্রে আমি কোনো অস্বাভাবিকতা দেখি না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পদক দেওয়ার যে কারণ বলা হচ্ছে, সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। যেমন কাউকে অন্যায্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে কিনা বা পুলিশ বাহিনী সরকারের দলীয় বাহিনীর মতো কাজ করেছে কিনা, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে আইনানুগভাবে কাজ করেছে কিনা– এসব। আইন অনুযায়ী কাজ করে থাকলে ঠিক আছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ঞ জ র ড আইজ প ল শ পদক প র ঞ জ ড আইজ প ল শ সদস য ২০২২ স ল র ২০১৮ স ল র ২০২৪ স ল র ব প এম স ব প প এম স ব স য ক ত কর পদক প য় ছ ২০২৩ স ল স ল র ১০ ব প এম প র জন য প ড স ম বর ন ত কর ম ড এমপ র ল ইসল ম পদক প ন ৫ আগস ট তৎক ল ন সরক র র হয় ছ ল ন র জন ক জ কর র পর ত ন র পর ইউন ট র পদক আশর ফ সমক ল পদক র ব এনপ ন শকত ক ষমত র বছর বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

দুবাই থেকে অবৈধভাবে এসেছে ৩২ হাজার কোটি টাকার সোনা

সংযুক্ত আরব-আমিরাত (দেশটির প্রসিদ্ধ শহর দুবাই) প্রতিবছর বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ সোনার বার রপ্তানি করে। দেশটি থেকে সোনার বার রপ্তানির শীর্ষ ১০ গন্তব্যের একটি বাংলাদেশ। অবশ্য বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, আবর আমিরাত থেকে বাংলাদেশে সোনা আমদানি হয় খুব সামান্য।

দুই দেশের সোনা-বাণিজ্যের হিসাবে এই গরমিলের কারণ, বেশির ভাগ সোনার বার আসে ‘অবৈধভাবে’। অবৈধ সোনা-বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশ রাজস্ব হারায়। অন্যদিকে অপরাধ ও চোরাচালানে ব্যবহার করা হয় অবৈধভাবে আসা সোনা।

জাতিসংঘের পশ্চিম এশিয়াবিষয়ক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইএসসিডব্লিউএ) তথ্যভান্ডারে থাকা হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩৬৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের সোনা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে। তাদের এই তথ্যের সূত্র জাতিসংঘের পণ্য বাণিজ্যের তথ্যভান্ডার ইউএন কম ট্রেড ও আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ।

বিশ্বব্যাংকের বছরভিত্তিক গড় মূল্য ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, দুবাই থেকে আনা সোনার পরিমাণ ৭৮ টন বা ৭৮ হাজার কেজির বেশি। ডলারের গড় দাম অনুযায়ী এই পরিমাণ সোনার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, এই ১০ বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বৈধ পথে মাত্র ৮২ লাখ ডলার মূল্যের সোনা আমদানি হয়েছে। অর্থাৎ ৩৬৫ কোটি ৮২ লাখ ডলারের সোনা বৈধভাবে দেশে ঢোকেনি।

বিশ্বব্যাংকের বছরভিত্তিক গড় মূল্য ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, দুবাই থেকে আনা সোনার পরিমাণ ৭৮ টন বা ৭৮ হাজার কেজির বেশি। ডলারের গড় দাম অনুযায়ী এই পরিমাণ সোনার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, এই হিসাবের মধ্যে যাত্রীরা নিয়ে আসা সোনার বার বা গয়না অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

নাম প্রকাশ নাম করার শর্তে দেশের একজন সোনা ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে সোনা যে অবৈধভাবে আসে, তার বড় অংশ ভারতে পাচার হয়, সেটা সবার জানা। আরব আমিরাত সোনা রপ্তানির হিসাব ঠিকই রাখে। কিন্তু বাংলাদেশে অবৈধভাবে আসে বলে এ দেশের সরকারি সংস্থার হিসাবে তা থাকে না।

বড় গরমিল

সংযুক্ত আরব-আমিরাত থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়। এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩ সালে আমিরাত থেকে আমদানি পণ্যের শীর্ষে ছিল সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার। এ সময়ে দেশটি থেকে ১১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ক্লিংকার আমদানি হয়। তবে দেশটি থেকে ওই বছর কোনো সোনা আমদানি হয়নি। তবে ইএসসিডব্লিউএর তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। জাতিসংঘের এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আমিরাত থেকে বাংলাদেশে শীর্ষ রপ্তানি পণ্য ছিল সোনা। এই বছর দেশটি থেকে ৫৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের সোনা আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ক্লিংকার ছিল দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানি পণ্য।শুধু ওই এক বছরই নয়, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের মধ্যে ৯ বছরই আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে সোনা।

ইএসসিডব্লিউএ আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির যে হিসাব দিয়েছে, তাতে সোনা ছাড়া অন্য পণ্যের বাণিজ্যের হিসাব কাছাকাছি। রপ্তানি পণ্য পাঠানো এবং আমদানি পণ্য খালাসের পর বাংলাদেশের হিসাবের ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধানের কারণে হিসাবে কিছুটা কম-বেশি হয়।

ইএসসিডব্লিউএর হিসাবে আমিরাত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সোনা রপ্তানি করেছে ২০১৯ সালে। ডলারের হিসাবে তা ৬০ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশে ওই বছর বৈধ পথে কোনো সোনা আমদানির রেকর্ডই নেই।

বাংলাদেশে সহজভাবে বৈধভাবে সোনা আমদানি শুরু হয় ২০২০ সালে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেয়। এরপর ২০২০ সালের জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে সোনা আমদানি শুরু হয়। এর আগেও সোনা আমদানি করার সুযোগ ছিল। তবে কঠিন শর্তের কারণে বৈধভাবে সোনা আমদানি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে ১০ টন সোনা কিনেছিল আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে, যা এখন পর্যন্ত এক বছরে সর্বোচ্চ আমদানির রেকর্ড। অথচ ইএসসিডব্লিউএর হিসাবে আমিরাত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সোনা রপ্তানি করেছে ২০১৯ সালে। ডলারের হিসাবে তা ৬০ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশে ওই বছর বৈধ পথে কোনো সোনা আমদানির রেকর্ডই নেই।

বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ইএসসিডব্লিউএর কার্যালয়ের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সংস্থাটির বাণিজ্য দলের কর্মকর্তা মাজেদ হামুদেহ ই-মেইলে পাঠানো বক্তব্যে বলেন, ইএসসিডব্লিউএর তথ্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোর অফিশিয়াল (আনুষ্ঠানিক) উৎস থেকে পাওয়া। সোনার তথ্যও সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিকারকভিত্তিক বিস্তারিত তথ্যের জন্য তিনি আমিরাত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

বাংলাদেশে সোনার বাজার দেশের বাইরে থেকে আসা সোনার ওপর নির্ভরশীল। দেশে এই সোনা আসে তিনভাবে—এক. যাত্রীদের হাত ধরে। দুই. বৈধভাবে ব্যবসায়ীদের আমদানির মাধ্যমে। এবং তিন. অবৈধভাবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে কারা এই সোনা রপ্তানি করল, বাংলাদেশের কারা আমদানি করল—এমন বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়ে আরব আমিরাতের ‘ফেডারেল কম্পিটিটিভনেস অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস সেন্টার’ কার্যালয়কে গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই-মেইল করা হয়। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি আরব অঞ্চলের দেশ কুয়েত থেকেও সোনা আমদানির তথ্য রয়েছে জাতিসংঘের সংস্থাটির তথ্যভান্ডারে। সেখানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে কুয়েত থেকে বাংলাদেশে ১৯ লাখ ডলারের সোনা রপ্তানি হয়। তবে বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে কুয়েত থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এক তোলা সোনা আমদানির রেকর্ড নেই।

সোনা আসে তিনভাবে

বাংলাদেশে সোনার বাজার দেশের বাইরে থেকে আসা সোনার ওপর নির্ভরশীল। দেশে এই সোনা আসে তিনভাবে—এক. যাত্রীদের হাত ধরে। দুই. বৈধভাবে ব্যবসায়ীদের আমদানির মাধ্যমে। এবং তিন. অবৈধভাবে।

আনুষ্ঠানিক আমদানির বাইরে যাত্রীদের হাত ধরে সোনার বার আসে। এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রীদের হাত ধরে আনা সোনা আনুষ্ঠানিক আমদানি হিসেবে গণ্য হয় না। যাত্রীদের মাধ্যমে সোনা আসা বেড়েছে মূলত গত চার বছরে (২০২১-২০২৪)। এর আগে বছরে তিন থেকে পাঁচ টন করে সোনা এনেছিলেন যাত্রীরা, যার বড় অংশ আমিরাত থেকে এসেছে। এই তিন বছরের আগে যাত্রীরা যে পরিমাণ সোনা এনেছিলেন, তার চেয়ে বাংলাদেশে আরব আমিরাতের রপ্তানি ছিল বেশি।

যেমন ২০১৯ সালে আরব আমিরাত রপ্তানি করেছে ৬০ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের সোনা। এ সময়ে যাত্রীরা এনেছেন ১৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলার মূল্যের প্রায় সাড়ে তিন টন সোনা।

সাত স্টেশনের মধ্যে শুধু ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বৈধ পথে সোনা আমদানির তথ্য রয়েছে। তা-ও বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে আমদানি শুরুর পর। সব মিলিয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৯৪ লাখ ডলার মূল্যের মোট ১৫৪ কেজি সোনা আমদানি হয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে। আরব আমিরাত থেকে এসব সোনা এনেছে ৯টি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে অন্য শুল্কস্টেশন দিয়ে বৈধভাবে সোনা আনা হয়নি।

তাহলে কোন পথে আসছে সোনা

এনবিআরের তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি পণ্য আসার প্রধান পথ চট্টগ্রাম বন্দর। মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট—এই তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েও আরব আমিরাত থেকে পণ্য আসছে। রূপপুর এলসি স্টেশনেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আরব আমিরাত থেকে কিছু পণ্য আমদানি হয়েছে। অর্থাৎ আমিরাত থেকে যা আমদানি হচ্ছে, তা এই সাতটি জায়গা দিয়েই খালাস হয়।

এই সাত স্টেশনের মধ্যে শুধু ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বৈধ পথে সোনা আমদানির তথ্য রয়েছে। তা-ও বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে আমদানি শুরুর পর। সব মিলিয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৯৪ লাখ ডলার মূল্যের মোট ১৫৪ কেজি সোনা আমদানি হয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে। আরব আমিরাত থেকে এসব সোনা এনেছে ৯টি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে অন্য শুল্কস্টেশন দিয়ে বৈধভাবে সোনা আনা হয়নি।

অবশ্য অবৈধভাবে আনা সোনা জব্দের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। ২০২৩ সালে তিন বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের জব্দ করা সোনার পরিমাণ ৮৮৪ কেজি। সোনা ব্যবসায়ী ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের ধারণা, যে পরিমাণ সোনা ধরা পড়ছে, তা অবৈধভাবে আনা সোনার সামান্য অংশ। এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানও গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সোনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, ‘আমরা ১০০টার মধ্যে একটা ধরতে পারি। ৯৯টা আমরা ধরতে পারি না নানা কারণে।’

জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) গত বছরের ৯ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ধারণার ভিত্তিতে দাবি করেছিল, বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার সোনা ও হীরা চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে।

সোনার শেষ গন্তব্য কোথায়

স্বর্ণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে নতুন সোনার চাহিদা ১৮-৩৬ টন। অর্থাৎ গড় হিসাবে বছরে নতুন সোনার চাহিদা ২৭ টন। তবে তিন বছরে (২০২১-২০২৩) যাত্রীদের হাত ধরে গড়ে বছরে প্রায় ৪৪ টন সোনা এসেছে। এর মানে হলো, যাত্রীদের আনা সোনাও দেশে থাকছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অবৈধভাবে আনা সোনা দেশে থাকে না।

বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্ত দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারে পাচারের সময় নিয়মিত সোনা জব্দ করে। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি সোনা জব্দ করা হয়েছে ২০২৩ সালে, পরিমাণ ২৬০ দশমিক ৫৬ কেজি। সব মিলিয়ে গত চার বছরে গড়ে প্রতিবছর ১৫৯ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে।

আমদানিতে সময় লাগে বেশি, যে কারণে বৈধ পথে আমদানি কম। আমদানির প্রক্রিয়া ও খালাস কার্যক্রম সহজ করা গেলে বৈধ পথে আমদানি বাড়বে।বাজুস সেক্রেটারি জেনারেল বাদল চন্দ্র রায়

সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে সোনা রপ্তানির বিষয় তুলে ধরে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সেক্রেটারি জেনারেল বাদল চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। বৈধ-অবৈধ পথে আসা সোনা দেশের বাজারে থাকে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাত্রীদের মাধ্যমে ও অবৈধ পথে যেসব সোনা আসছে, সেগুলোর কিছু হয়তো দেশে থাকে, তবে বেশির ভাগই পাচার হয়ে যায়। বাংলাদেশের যাঁরা জড়িত, তাঁরা হয়তো বাহক হিসেবেই কাজ করছেন।

বাদল চন্দ্র বলেন, আমদানিতে সময় লাগে বেশি, যে কারণে বৈধ পথে আমদানি কম। আমদানির প্রক্রিয়া ও খালাস কার্যক্রম সহজ করা গেলে বৈধ পথে আমদানি বাড়বে।

অবৈধ বাণিজ্য বিশ্বজুড়ে, পথ বাংলাদেশও

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘সুইসএইড’ গত বছরের ৩০ মে আফ্রিকার সোনা নিয়ে ‘অন দ্য ট্র্যায়াল অব আফ্রিকান গোল্ড’ নামে সমীক্ষা প্রকাশ করে। তাতে আফ্রিকার সোনা-বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে দুবাইকে (আমিরাতের শহর) চিহ্নিত করা হয়। সমীক্ষায় বলা হয়, আফ্রিকা থেকে উড়োজাহাজে করে দুবাইয়ে সোনা পাচার করা হয়। সে ক্ষেত্রে নিয়মিত ফ্লাইট বা ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হয়। আমিরাতে সোনা শোধনাগার শিল্প রয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে সোনা রপ্তানি হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সোনার বাজারবিষয়ক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ভারতের অবৈধ পথে আসা সোনার ৪০-৫০ শতাংশ আসে পশ্চিমবঙ্গ, মণিপুর ও মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে। এই অবৈধ সোনার বড় উৎস বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন।

অবৈধ লেনদেন অবৈধ সোনায়

বিশ্বজুড়ে অবৈধ বাণিজ্যের লেনদেন ও নানা দেশে সশস্ত্র গোষ্ঠীর অর্থায়নে সোনা ব্যবহার করা হয়। দু-তিন কেজি সোনা লুকিয়ে বহন করা যত সহজ, সে তুলনায় সমমূল্যের মুদ্রা সহজে লুকিয়ে বহন করা যায় না। এ কারণে অবৈধ লেনদেন ও আমদানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েস (কম মূল্য ঘোষণা) করা পণ্যের দাম পরিশোধে সোনা ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েস সবচেয়ে বেশি হয় ভারতের সঙ্গে। যেমন এ বছর ভারত থেকে মাত্র ৪ টাকা ৮৮ পয়সায় গেঞ্জি, ২১০ টাকায় পাঞ্জাবি আমদানির রেকর্ড আছে এনবিআরে। শুল্ক কর্তৃপক্ষের হিসাবে এই দর অনেক কম। সে জন্য শুল্ক কর্তৃপক্ষ পাঁচ গুণ বেশি দাম ধরে পণ্যের শুল্কায়ন করেছে। এত কম টাকায় অনেক পণ্য আমদানি হচ্ছে, যা পরে নানাভাবে পরিশোধ করা হয়।

‘জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করা দরকার’

২০২৪ সালের ১৩ মে কলকাতায় খুন হন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। খুনের ঘটনাটির তদন্তে বেরিয়ে আসে, সোনা চোরাচালান নিয়ে বিরোধেই খুন হন আজীম। তখন প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সোনা চোরাকারবারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন আজীম।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে যে পরিমাণ সোনা রপ্তানি হচ্ছে, তা বাংলাদেশের হিসাবে নেই—এটা খুবই উদ্বেগজনক তথ্য। জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত করা দরকার। এ জন্য আমিরাত থেকে তথ্য নিতে হবে। আমিরাতের কারা এই সোনা রপ্তানি করল, বাংলাদেশের কারা আমদানি করল, কোন পথে আমদানি হলো, ঋণপত্র খোলা হয়েছে কি না, ঋণপত্র খোলা হলে সঠিক ঘোষণা ছিল কি না—সবকিছুই অনুসন্ধানের আওতায় আনা দরকার। তিনি বলেন, আমিরাতে অর্থ পাচারের সঙ্গে সোনা চোরাচালান জড়িত হয়ে আরেকটি চক্র কাজ করেছে কি না, সেটারও তদন্ত করা দরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হামাসের সামরিক গোয়েন্দা প্রধানকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
  • কৃষক ও তৈরি পোশাকশ্রমিকদের ব্যাংক হিসাব বেশি বেড়েছে
  • ইসরায়েলের নিরাপত্তাপ্রধানকে বরখাস্ত করলেন নেতানিয়াহু
  • আমিরাতে ২৫ ভারতীয়কে মৃত্যুদণ্ড
  • আগামী দিনের পথ নির্মাণ করবে তরুণরাই
  • সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলায় দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে, বললেন জি এম কাদের
  • মামলা থাকায় কুবির ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে সাময়িক বরখাস্ত
  • দুবাই থেকে অবৈধভাবে এসেছে ৩২ হাজার কোটি টাকার সোনা
  • ‘মা, আমি ক্লান্ত, মরে যেতে চাই’: ইসরায়েলি আগ্রাসনে মানসিক বিপর্যয়ে শিশুরা
  • গাজায় এবার স্থল অভিযান শুরু করলো ইসরায়েল