আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ মানুষ সেবা পেতে ভোগান্তির মুখে পড়ছেন। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় নির্বাচন করার বিষয়ে ইতিবাচক অন্তর্বর্তী সরকার। তবে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

সম্প্রতি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এক জনমত জরিপে উঠে এসেছে, ৬৫ শতাংশ মানুষ আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে। কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশও করেছে। তবে আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতবিরোধ আছে।

জামায়াতে ইসলামী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে। বিপরীতে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল চায় আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গতকাল শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাতেও কোনো কোনো দল বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে।

বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা বৈঠকে দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন। তাঁরা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন আগে হতে হবে। এরপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন।

আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় না বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিও। বৈঠক শেষে দলটির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা স্থানীয় নির্বাচন আগে চাই না। কারণ, স্থানীয় নির্বাচন দিলে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে মারামারি হওয়ার আশঙ্কা আছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।’

গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। এরপর মূলত বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠক করে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের জন্য ইসিকে পরামর্শ দেয় জামায়াতে ইসলামী। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দিনই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়াকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেশকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চায়। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে

অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কাউন্সিলর, পৌর কাউন্সিলর পদগুলোয় জনপ্রতিনিধি নেই। জনগণের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেককেই দুটি করে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ফলে মন্ত্রণালয়ের কাজের অ্যাফিশিয়েন্সি (কার্যক্ষমতা) কমে গেছে। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা নেই, স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কেও তাঁরা অবগত নন। এতে জনসেবামূলক ও দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত হলেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

এর আগে গত ৮ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারকে জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অবশ্য এ নির্বাচনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় লিখিতভাবে অনুরোধ জানালে সাধারণত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের কাজ শুরু করে ইসি। এমন কোনো অনুরোধ ইসি এখনো পায়নি।

ইসি এখন পর্যন্ত ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে ইসি জানিয়েছে, সরকার চাইলে তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করবে। সারা দেশে ধাপে ধাপে সব কটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন করতে হলে এক বছরের মতো সময় লাগবে বলে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মনে করছে ইসি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গত ডিসেম্বর–জানুয়ারিতে ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করে। সেখানে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিষয়ে মতামত উঠে আসে। বিষয়টি তখন প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়েছিল। মূলত দুটি বিষয় মাথায় রেখে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা ভাবা হচ্ছে।

প্রথমত, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর স্থানীয় সরকারের অনেক জনপ্রতিনিধিও আত্মগোপনে চলে যান। একপর্যায়ে বেশির ভাগ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নতুন নির্বাচন কমিশনের একটি পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা হবে। সরকারও সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। নির্বাচনী যেসব সংস্কার আনা হবে, সেগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে, সেটাও এর মাধ্যমে বোঝা সম্ভব হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র র র জন ত ক উপদ ষ ট পর স থ ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

ঢেকে রাখা সেই মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরালে শেখ মুজিবের স্মৃতিচিহ্ন ভেঙে ফেলা হলো   

লালমনিরহাট শহরের শিশুপার্ক সংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিমঞ্চে স্থাপিত ম্যুরালের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেছে জেলা প্রশাসন। ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসন ওই ম্যুরালটি কাপড় দিয়ে ঢেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি ও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কাপড় দিয়ে ম্যুরাল ঢেকে দেওয়ার ঘটনায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম পার না হতেই রোববার জেলা প্রশাসন মুক্তিযুদ্বের স্মৃতিচিহ্ন  ম্যুরাল ভাঙার কাজে হাত দেয়। 

এর আগে শনিবার দুপুুরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মঞ্চে দু’টি পক্ষ একই সময়ে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দুপুর সাড়ে ১১টায় ওই এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করলেও জাতীয় নাগরিক পার্টি করতে পারেননি। 

মুক্তিযুদ্ব স্মৃতি মঞ্চে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লালমনিরহাট শাখার প্রধান সমন্বয়ক হামিদুর রহমান ম্যুরাল অপসারণ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরাতে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। এ সময় তিনি দাবি করে বলেন, ‘এই ম্যুরালটি স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বহন করে না। বাকশাল প্রতিষ্ঠাকারী স্বৈরাচার শেখ মুজিবুর রহমানকে অতিরঞ্জিত উপস্থাপন ও ইতিহাস বিকৃতি করায় এর আগেও ১৬ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন ম্যুরালটি ঢেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫২, ৭১ এর সকল সত্য ইতিহাস অক্ষুণ্ণ রেখে অতিরঞ্জিত অংশ ও স্বৈরাচারের চিহ্ন ঢেকে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুরো দেয়াল ঢেকে দেয়, যা অনাকাঙ্খিত। কিছু স্বৈরাচারের দোসর তাদের ব্যক্তিগত  আক্রোশ, স্বার্থ উদ্ধার ও বর্তমান সরকারের কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে জেলা প্রশাসনের কার্যক্রমকে ভুলভাবে প্রচার করতে থাকে এবং বিদ্বেষবশত মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ম্যুরাল ঢেকে দেওয়ার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবগত ছিল না, তাঁরা এমন কোনো দাবিও করে নাই। স্বৈরাচারের সকল চিহ্ন ও ম্যুরাল অপসারণ ছাত্রজনতার দাবি ও গণআকাঙ্খা।’ 

সংবাদ সম্মেলন শেষে জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিসৌধ এলাকায় যান। সেখানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি হাফিজুর রহমান হাফিজ জানান, ম্যুরালের মধ্যেই বৈষম্য রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানে যেমন অবদান রয়েছে তেমনি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানেরও অবদান রয়েছে। অথচ ম্যুরালে জিয়াউর রহমানের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এটা বৈষম্য। এই ম্যুরাল রাখা ঠিক নয়।   

শনিবার জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) রাসেল আহমেদ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে গেলে তোপের মুখে পড়েন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই ম্যুরালে ৫২ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, ৭১ এর গণহত্যা, বিজয় উল্লাসে মুক্তিযোদ্ধা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন ঢেকে দিয়ে চরম ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছেন জেলা প্রশাসন। পরে তাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর দায় চাপিয়েছেন। ৭১ ও ২৪কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাতিকে বিভাজিত করে আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র চলছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭১ এর অস্তিত্ব ধরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বাদ দিয়ে অন্যগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো মতানৈক্য নেই। 
 
২৬ মার্চ বুধবার সকালে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্বাঞ্জলি দিতে গেলে কাপড় দিয়ে মুরাল ঢেকে রাখার বিষয়টি চোখে পড়ে। সনাক সদস্যরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ফিরে যান। পরে লালমনিরহাট রেলওয়ে শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্বাঞ্জলি দেন তাঁরা। গত ১৬ ডিসেম্বরও একই রকম ঘটনা ঘটায় জেলা  প্রশাসন। ১৪০ ফুট দীর্ঘ ওই ম্যুরালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, উদিত সূর্য, ৭১ এর গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানি, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।  

এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দারের বক্তব্য জানতে তাঁর ফোনে মেসেজ এবং ফোন দিলে কোনো সাড়া মেলেনি।  

সম্পর্কিত নিবন্ধ