দিন দিন বাংলা ফন্ট বর্ণিল হয়ে উঠছে। দেশের তরুণরা বাংলা টাইপোগ্রাফির জগতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তারা বাংলা টাইপ ডিজাইন ও ফন্ট অর্থের বিনিময়ে কেনার মতো মূল্যবান করে তুলছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে বাংলা লিপির নান্দনিক উৎকর্ষে কাজ করা এমনই দুই তরুণের সৃজনশীল জগৎ লিপিকলা ও বেঙ্গল ফন্টস-এর কথা তুলে ধরছেন আশিক মুস্তাফা  

বাংলা টাইপোগ্রাফির জগতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে লিপিকলা টাইপ ফাউন্ড্রি। এই উদ্যোগ শুধু একটি ফন্ট 
ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্মই নয়, বরং বাংলা অক্ষরশিল্পের এক বিস্তৃত শৈল্পিক গবেষণাগার। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজী যুবাইর মাহমুদ। কেন এই পথে হাঁটলেন– এমন প্রশ্নের উত্তরে কাজী যুবাইর মাহমুদ বলেন, ‘লিপিকলা টাইপ ফাউন্ড্রির পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ স্বপ্নের পরিক্রমা। শৈশব থেকেই বাংলা অক্ষরশিল্পের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও চর্চা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার জন্য শত শত উন্নতমানের ফন্ট পাওয়া গেলেও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সেই ঘাটতি স্পষ্ট। বিশ্বের ৩০ কোটির বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলে, অথচ আমাদের ভাষার জন্য শিল্পমানে উত্তীর্ণ ফন্টের সংখ্যা খুবই কম। অন্যান্য ভাষার চেয়ে বাংলায় ফন্ট তৈরি করা অতিরিক্ত কষ্টসাধ্য কাজ। যুক্তবর্ণসহ বিশালসংখ্যক গ্লিফ তৈরি করতে হয় বাংলায়, যা সময়সাপেক্ষ ও জটিল। একই সঙ্গে অক্ষরের শেইপ ঠিক রেখে প্রতিটি গ্লিফস করার মতো ডিজাইনার বিরল। বর্তমানে ডিজাইন ও টাইপোগ্রাফির 
আধুনিকতার যুগে এসেও আমরা হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি উন্নত ও সুপার ফিনিশড বাংলা ফন্ট দেখতে পাই। এ ছাড়া রাস্তাঘাটে, বিলবোর্ডে, লোগোতে কিংবা পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে ব্যবহৃত বাংলা 
টাইপোগ্রাফির বেশির ভাগই অপরিপক্ব, অপরিকল্পিত ও দুর্বল মনে হয়। এটি আমাকে ব্যথিত করে। সেই অভাববোধ থেকেই জন্ম নেয় লিপিকলা।’
লিপিকলার যাত্রা
কবে শুরু লিপিকলার যাত্রা– এই প্রশ্নের উত্তরে কাজী যুবাইর মাহমুদ বলেন, “২০২০ সালে করোনাকালীন সংকটের মধ্যে আমি লিপিকলার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করি। গত পাঁচ বছরে আমরা প্রায় ১০০টি ফন্ট ডিজাইন করেছি। এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে লিপিকলার ঘোষণা দেওয়া হয়নি। এর আগেই দেশে ঘটে গেছে এক গণঅভ্যুত্থান, স্বৈরাচারের পতন। এ আন্দোলনের সময় আমি অনুভব করি, ফন্টের মাধ্যমেও প্রতিবাদ ও বিপ্লবের ভাষা তুলে ধরা সম্ভব। একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরুলের একটি কবিতার লাইন লিখলাম ব্রাশপেনে– ‘আমি চিনেছি আমারে আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’ এই লাইনটি দেয়াল লিখনের অভিজ্ঞতা থেকে আঁকা হয়েছিল, যেখানে আন্দোলনের আবেগ স্পষ্ট ছিল। তখন মনে হলো, এই শৈল্পিক প্রকাশকে একটি পূর্ণাঙ্গ ফন্টে রূপ দেওয়া দরকার। এই ভাবনা থেকে জন্ম নেয় লিপিকলার প্রথম আনুষ্ঠানিক ফন্ট ‘দ্রোহ’– বাংলার প্রথম প্রতিবাদী টাইপফেস।”
দ্রোহ: আন্দোলনের ভাষায় এক বিপ্লব
বাংলা প্রথম প্রতিবাদী টাইপফেস দ্রোহ সম্পর্কে জানতে চাইলে কাজী যুবাইর মাহমুদ বলেন, “১ আগস্ট ২০২৪, আমি লিপিকলা থেকে ‘দ্রোহ’ ফন্টের ঘোষণা দিই। ২ আগস্ট এটি উন্মুক্ত করা হয় মাত্র এক দিনে পাঁচশর বেশি অক্ষর ডিজাইন করে। আন্দোলনের ভাষা ধারণ করে দ্রোহ ফন্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান আজও বিভিন্ন স্লোগানে, ব্যানারে, প্ল্যাকার্ডে এই ফন্ট ব্যবহার করছে। এটি আমার জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি, যা আমাকে আরও নতুন নতুন ফন্ট তৈরির অনুপ্রেরণা দেয়।” 
আগামীর স্বপ্ন
লিপিকলা ও নিজের ব্যক্তিগত স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তরুণ এই স্বপ্নবাজ বলেন, “যে কোনো মিডিয়া ও করপোরেট হাউসের ব্র্যান্ড আইডেনটিটির জন্য নিজস্ব ফন্ট দরকার হয়। ব্র্যান্ড আইডেনটিটির কোয়ালিটি চরিত্র বজায় রেখে ইউনিক ফন্ট প্রোভাইড টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান বা প্ল্যাটফর্ম নেই বললেই চলে। লিপিকলা টিম সেই অভাব পূরণের জন্য প্রস্তুত। লিপিকলা শুধু ফন্ট তৈরির জন্য নয়; বরং বাংলা অক্ষরশিল্পের প্রতিটি শাখাকে উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এ আমরা টাইপোগ্রাফার এইচ এম খালিদের লেখা ‘ক্যালিগ্রাফি, টাইপোগ্রাফি ও লেটারিং’ বইটি প্রকাশ করেছি। ২০০ পৃষ্ঠার এই বই বাংলা টাইপোগ্রাফির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স, যা নতুনদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে। এ ছাড়া আমরা বেশ কিছু কাজ করছি লিপিকলা নিয়ে। https://lipikola.

com– এই ওয়েবসাইটে চোখ রাখলে বিস্তারিত জানতে পারবেন পাঠক।”
বাংলা ভাষা ও টাইপোগ্রাফির এই নতুন যাত্রায় লিপিকলা টাইপ ফাউন্ড্রি এক অনন্য মাইলফলক সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। আমরা স্বপ্ন দেখি, এই তরুণদের হাত ধরে একদিন বাংলা টাইপোগ্রাফি বিশ্বমানের স্তরে পৌঁছাবে। লিপিকলা হবে সেই অভিযাত্রার অন্যতম অগ্রদূত। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ল প কল র র জন য ড জ ইন প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

ঘাটের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে সীতাকুণ্ডের সবুজ বেষ্টনী

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নাম ভাঙিয়ে দখল করা হচ্ছে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী তুলাতলী সাগর উপকূল। জেলা পরিষদ থেকে মীর্জানগরের ছোঁয়াখালী ঘাট ইজারা নিয়ে অনুমতি ছাড়াই বেড়িবাঁধের পাশে মাটি খনন করা হচ্ছে; কাটা হচ্ছে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর গাছ। দখল ও আধিপত্য নিয়ে ইতোমধ্যে দুই পক্ষে মারামারিও হয়েছে সেখানে।  
খনন করা স্থানে টানানো একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণের ফেরিঘাট’। এটির নাম মীর্জানগর ছোঁয়াখালী ঘাট। বর্তমানে যেখানে মাটি খনন ও ভরাট করা হচ্ছে, সেখানে কখনও খাল ছিল না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ থেকে ঘাট ইজারা নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে খাল খনন করার দাবি করছেন ইজারাদার সাকিল চৌধুরী। জেলা পরিষদের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘাট ইজারা দেওয়া হলেও উপকূলে মাটি খনন-ভরাট বা গাছ কাটার কোনো সুযোগ নেই। অনৈতিক কাজ করলে পার পাবে না বলে মন্তব্য করেছেন তারা। 
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী পোর্টলিংক থেকে আঁকাবাঁকা গ্রামীণ সড়ক দিয়ে অর্ধকিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত সন্দ্বীপ যাতায়াতের ছোঁয়াখালী নৌঘাট। প্রায় ১৫ বছর আগে এই নৌঘাট নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সন্দ্বীপের মানুষ বিকল্প পথে যাতায়াত করেন।
মীর্জানগরের ছোঁয়াখালী নৌঘাট এলাকায় ১৫-২০টি দোকান রয়েছে। দুই হাজারের বেশি জেলের বসতি এখানে। জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন নৌঘাটে তাদের মাছ ধরার ইঞ্জিনচালিত নৌযানগুলো রাখেন। দোকান থেকে বাজার-সদায় করেন। সরেজমিন দেখা যায়, উপকূলে ছোঁয়াখালী খালের দক্ষিণে রয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের শিপইয়ার্ড। এতে কিছু স্থাপনাও আছে। তবে ইয়ার্ডটি চালু করতে পারেননি সাবেক সংসদ সদস্য। ওই স্থাপনার দক্ষিণে সাগর উপকূলের বেড়িবাঁধের পশ্চিমে বনবিভাগের সবুজ বেষ্টনীর আওতায় করা কেউড়া ও ঝাউবন। ঘাট তৈরির নামে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন স্থান থেকে কাটা হয়েছে অর্ধশতাধিক গাছ। 
১৩ ফেব্রুয়ারি দেখা যায়, কেউড়া ও ঝাউবন থেকে দুটি এক্সক্যাভেটর দিয়ে কাটা হচ্ছে মাটি। অনেক স্থানে হয়েছে গর্ত। ওই মাটি দিয়ে উপকূলের বেড়িবাঁধের দুই পাশ ভরাট করা হচ্ছে। বনের ভেতর মাটি খননের ফলে বন বিভাগের রোপণ করা অনেক গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে।
এদিকে, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি কাটা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি চলছে। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের দুই পক্ষ আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা, আরজু, শাখাওয়াত ও মামুন বলেন, ‘বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কিছু লোক বেড়িবাঁধ দখল করছে। উপকূল থেকে মাটি খনন ও ভরাট করছে। পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে পরিবেশ, এলাকার বসতিও পড়ছে হুমকির মুখে।’
ছোঁয়াখালী ফেরিঘাট ইজারাদার সাকিল চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এ নৌঘাট ইজারা নিয়ে লুটপাট করেছে স্বৈরাচারের দোসররা। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ বর্তমানে এ ঘাটটির নাম পরিবর্তন করে ছোঁয়াখালী-শিবেরহাট (আমতলী) রেখে ইজারা দিয়েছে। ঘাটটি ইজারা নেওয়ার পর নিজস্ব অর্থায়নে উপকূল থেকে মাটি কেটে খাল খননের কাজ করছি। মাটি কাটতে জেলা পরিষদের কোনো অনুমোদন নেই বলে তিনি স্বীকার করেন।
খালের অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও কেমনে ঘাট ইজারা নিলেন– এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ ঘাটে ইজারা সবসময় চালু ছিল। অনেকে ইজারা না নিয়ে ঘাট ব্যবহার করে অর্থ কামিয়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর আমি ইজারা নিয়ে খাল সংস্কারে হাত দিয়েছি। এটা চলমান থাকবে। বড় করে নিজস্ব অর্থায়নে খাল খনন করা হচ্ছে। ওই খাল দিয়ে মালামাল বোঝাই লঞ্চ সন্দ্বীপসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবে।’
 তিনি আরও বলেন, ‘জনকল্যাণ ও জনস্বার্থে মাটি কেটে বেড়িবাঁধ সংস্কার করছি। কিছু লোক দলীয় পরিচয়ে চাঁদাবাজি করতে আসছিলেন।
 আমারা তাদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় কিছুটা ঝামেলা হয়েছে। নিজস্ব অর্থে কাজ করছি, তাদের টাকা দিব কেন?’
 ভাটিয়ারী ও ছলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘কোন অবস্থাতেই অনুমোদন ছাড়া উপকূলে মাটি খনন-ভরাট বা গাছ কাটার সুযোগ নেই। মাটি খনন ও ভরাটের জন্য ইজাদারের কয়েকজন অনুমতির জন্য এসেছিলনে, তাদের বলে দেওয়া হয়েছে এ কাজ করা কোন সুযোগ নেই। এরপরও যদি তারা উপকূলে মাটি খনন-ভরাট বা গাছ কাটেন তাহলে বিধি মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘ঘাটের ইজারা দেওয়া হয়েছে। সাগর উপকূলে স্ক্যাভেটর দিয়ে মাটি খনন-ভরাট বা গাছ কাটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। ইজারাদার জেলা পরিষদে কয়েকবার মাটি খনন ও কাটার অনুমোদনের জন্য এসেছিলেন। বলে দেওয়া হয়েছে নিয়ম বহিভূত কোন কাজ করা যাবে না। কিন্তু তারা তা অমান্য করে উপকূল থেকে মাটি খনন-ভরাট ও গাছ কাটার কথা শুনেছি, যা তা সম্পূর্ণ অবৈধ।’  
চট্টগ্রাম কাট্টলী বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা পরিষদ থেকে খাল খনন ও সড়ক নির্মাণের অনুমোতি নিয়ে কাজ করছেন বলে ইজারাদার জানিয়েছেন। তবে তারা কোন প্রমাণপত্র আমাদের দেয়নি। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর পাশে থাকা যে গাছ  তারা কেটেছে তা অবৈধভাবে কেটেছে।  ইজারাদারের লোকেরা দুইটি স্ক্যাভেটর দিয়ে মাটি কাটছে দেখে তা বন্ধ করতে বলেছি। জনবল সংকটসহ নানা কারণে যথায়থ আইন প্রয়োগ করতে সম্ভব হচ্ছে না। তবে বিষয়টি বন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ