গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁর মেয়াদের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ঘটনাক্রমে বর্তমান অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গভর্নর থাকাকালীনই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা শুরু করে। সেই থেকে পরিস্থিতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি কখনও সংকোচনমূলক, কখনও সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে। গভর্নর আতিউর রহমান চালু করেছিলেন জোড়াতালির সংস্থানমূলক মুদ্রানীতি। বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে মুদ্রানীতি এখনও নামকাওয়াস্তে রয়ে গেছে, পরিণত হয়েছে রুটিন ওয়ার্কে। এবারের ঘোষিত মুদ্রানীতিও ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হচ্ছে না। 

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও এ সময়ে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সম্প্রতি ঘোষিত দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতেও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একই রাখা হয়েছে। অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বিদ্যমান ১০ শতাংশ নীতি সুদহার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ নীতি সুদহার ধরে রাখার পেছনে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের। যদিও এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বলছেন, এভাবে উচ্চ সুদহার বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখার মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতির হার আগামী জুন শেষে ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যপূরণের অংশ হিসেবে কঠোর মুদ্রানীতি বজায় রাখা হয়েছে; যাতে সম্পদ হিসেবে টাকার মূল্যমান আকর্ষণীয় থাকে, বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং মূল্যস্ফীতির চাপ কমে আসে। সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে সুদহার ও তারল্য সরবরাহে প্রয়োজনীয় সমন্বয় হবে বলে মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। যদিও এ সময়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। যেটি গত আগস্ট থেকে তিন দফায় বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব দেশ নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, গেল কয়েক মাস ধরে সবাই আবার নীতি সুদহার কমানোর দিকে হাঁটছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৪ শতাংশে নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।
আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য অস্ত্র সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম আরেক দফা বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। রমজানকে কেন্দ্র করে অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া না। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে মুদ্রানীতিতে ব্যক্ত প্রত্যাশা কতটুকু বাস্তবসম্মত?

নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে এরই মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে ১৫-১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগের সামগ্রিক পরিবেশও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির জন্য অনুকূল নয়। আমাদের শিল্প খাতের উৎপাদন অনেকাংশে আমদানিনির্ভর। আমদানি কিছুটা বাড়লেও সেখানে উৎপাদনের সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত নেই। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা সামনে বাড়ার কী গ্যারান্টি আছে? ফলে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রেখে মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেই যে বাস্তবে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়বে তা নয়। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল ব্যাংক খাতের দুর্বলতাগুলো দূর করতে ও দক্ষতা বাড়াতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। তাহলে খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারত এবং সুদহারও কমানো সম্ভব হতো। 

নীতি সুদহারের পাশাপাশি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বিশেষ রেপো বা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ঊর্ধ্বসীমা ও সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা রিভার্স রেপো বা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ)। বর্তমানে এসএলএফ ও এসডিএফের সুদহার যথাক্রমে ১১ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে নীতি সুদহারের করিডোর রাখা হয়েছে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ সময়ে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। নীতি সুদহার ও সুদহার করিডোরের মধ্যে তারল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ব্যাপক মুদ্রার এ প্রবৃদ্ধি ব্যবস্থাপনা করা হবে। প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশ ধরা হলে এ ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ শতাংশ।
আমি মনে করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা থেকে এখনও বের হতে পারেনি। বরং বিভিন্ন অজুহাত বের করে মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রণটা কীভাবে তাদের হাতে রেখে দেবে সেটির চেষ্টা করে। 

২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। এর আগে প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হলেও এ সময়ে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের মতোই ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে।

অনেকের সঙ্গে আমিও একমত, বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এটি আগামীতে আরও কমতে পারে। ব্যক্তি খাতের ঋণ বৃদ্ধি সহায়ক কিছু মুদ্রানীতিতে নেই। যেসব প্যারামিটারের কারণে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি, সেই প্যারামিটারের মধ্যে শুধু সুদহার বাড়িয়ে এটিকে বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব না। এটি মূলত পণ্য সরবরাহের বিষয় এবং সেখানেই সরকারের ব্যর্থতা। কারণ চাঁদাবাজিটা হচ্ছে। তার মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিছু জায়গায় ভ্যাটও বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও কোনো সুসংবাদ নেই। এমনিতেই শিল্প-কারখানাগুলো বিভিন্ন কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। এর মধ্যে যদি এসব প্যারামিটার সামনে আসে, তখন বিনিয়োগ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

সবাই জানি, কয়েক যুগ ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বেসরকারি খাত। শিল্পের উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের সিংহভাগই বেসরকারি খাতনির্ভর। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে খাতটিকে ঋণবঞ্চিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি না কমে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
সোজা কথায়– বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমলে বিনিয়োগ কমবে, কর্মসংস্থান হুমকিতে পড়বে।  মুদ্রানীতিতে ঘোষিত আশাবাদ ভালো মানুষের আকাঙ্ক্ষাই থেকে যাবে। বাজারে খুব একটা  ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে না।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক। 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রথম র ধ র ম দ র ন ত ত পর স থ ত ৯ দশম ক র প রথম ব সরক র দশম ক ৮ ৭ দশম ক হয় ছ ল এ সময় ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ন্যাশনাল ফিডের লোকসান বেড়েছে ১৬৬.৬৭ শতাংশ

পুঁজিবাজারে বিবিধ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ন্যাশনাল ফিড মিলস লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২৪) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আলোচ্য অর্ধবার্ষিক প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) বেড়েছে।

মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এর আগে সোমবার (২৪ মার্চ) অনুষ্ঠিত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে চলতি হিসাববছরের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও অনুমোদনের পর তা প্রকাশ করা হয়।

তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে (০.২৪) টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল (০.০৯) টাকা। সেই হিসাবে কোম্পানিটির আলোচ্য সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান বেড়েছে (০.১৫) টাকা বা ১৬৬.৬৭ শতাংশ।

এদিকে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ০.০১ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ছিল ০.১০ টাকা।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ছিল ১০.৮৩ টাকা।

ঢাকা/এনটি/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঈদের আগে প্রবাসী আয়ে রেকর্ড, আগস্টের পর থেকেই বাড়ছে
  • ২৬ দিনে রেমিট্যান্স ৩শ’ কোটি ডলারের  কাছাকাছি 
  • রেমিট্যান্সের নতুন রেকর্ড
  • প্রবাসী আয় ৩ বিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই, ঈদের আগেই রেকর্ড
  • ম্যাকসন্স স্পিনিংয়ের লোকসান বেড়েছে ৮২ শতাংশ
  • বিডি সার্ভিসেসের লোকসান বেড়েছে ৯০ শতাংশ
  • ২৪ দিনে এল ২৭০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়
  • ডিএসসিসির রাজস্বে ভাটা, আদায় বাড়াতে ঈদের পর অভিযান
  • ‘বিনিয়োগ করুন, আপনারা তো আর সালমান এফ রহমান হতে পারবেন না’
  • ন্যাশনাল ফিডের লোকসান বেড়েছে ১৬৬.৬৭ শতাংশ