চিলির বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এমন একটি গ্রহাণুর সন্ধান পেয়েছেন, যেটি পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে। এর আকার খুব বড় নয়। তবে এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এমনটা ঘটলে তা হবে সর্বনাশের। কারণ, এই গ্রহাণুতে ৫০০টি পরমাণু বোমার চেয়ে বেশি জ্বালানি জমাট বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। 

গ্রহাণু হলো, সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা মহাকাশ শিলা। এগুলো গ্রহের তুলনায় অনেক ছোট। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এগুলো ৪৬০ কোটি বছর আগে সৌরজগতের গঠনের অবশিষ্টাংশ।

মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যে লাখ লাখ গ্রহাণু ঘুরছে। এই অঞ্চলটিকে প্রধান গ্রহাণু বলয় বলা হয়। কখনও কখনও এগুলো বলয় থেকে বেরিয়ে আসে এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তেমন আশঙ্কা করা হচ্ছে নতুন সন্ধান পাওয়া গ্রহাণু নিয়ে।

পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে এমন বহির্জাগতিক বস্তুর প্রতি বিজ্ঞানীরা সারাক্ষণ নজর রাখেন। এপির খবরে বলা হয়, চিলির একদল বিজ্ঞানী গত ডিসেম্বরে ২০২৪ ওয়াইআর৪ শনাক্ত করেন। এর প্রস্থ ৪০ থেকে ৯০ মিটার। পরে ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা আরও তথ্য সরবরাহ করেন। শুরুর দিকে সবাই আশঙ্কা করেছিলেন, একটি পৃথিবীতে আঘাত হানার আশঙ্কা ১ শতাংশ। তবে গত বৃহস্পতিবার এই পূর্বাভাস বাড়ানোয় এ নিয়ে হইচই পড়ে গেছে।

টাইমের খবরে বলা হয়, গত জানুয়ারিতে ইউএস স্পেস এজেন্সি এবং ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি পূর্বাভাস দিয়েছিল, গ্রহাণুটির আঘাত হানার আশঙ্কা ১.

২ শতাংশ। সেখানে এখন নাসা বলছে, এর আঘাত হানার আশঙ্কা ২.৩ শতাংশ। 

বিজ্ঞানীরা মোটামুটি হিসাব কষে বলেছেন, ২০৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর এটি আঘাত হানতে পারে। শনাক্ত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে গ্রহাণুটির আঘাত হানার পূর্বাভাস যেভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা, প্রায় সাত বছর পর তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সে প্রশ্ন একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির সম্ভাব্য গতিপথের একটি নকশা এঁকেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান রয়েছে। তাদের মতে, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল, আরব সাগর এবং দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত এর লক্ষ্যপথ হতে পারে।

নাসার সেন্টার ফর নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট স্টাডিজের পরিচালক পল চোডাস বলেন, ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আশঙ ক

এছাড়াও পড়ুন:

নারীর প্রতিবাদের ভাষা শক্তি ও সাহসের প্রতীক

‘দ্রৌপদীর কালো শরীর আরো কাছে আসে। দ্রৌপদী দুর্বোধ্য, সেনানায়কের কাছে একেবারে দুর্বোধ্য এক অদম্য হাসিতে কাঁপে। হাসতে গিয়ে ওর বিক্ষত ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরে এবং সে রক্ত হাতের চেটোতে মুছে ফেলে দ্রৌপদী কুলকুলি দেবার মত ভীষণ আকাশচেরা, তীক্ষ্ণ গলায় বলে, কাপড় কি হবে, কাপড়? লেংটো করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? মরদ তু?’

মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ গল্পে একটি চরিত্র আমাদের চোখে ধরা দেয়, যা নারীর প্রতিবাদের এক অনন্য রূপ। এই উদ্ধৃতিতে আমরা দেখতে পাই, দ্রৌপদী তার নিজের শরীরকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। মহাভারতের দ্রৌপদীর মতো সে কোনো দৈবী শক্তির সাহায্য চায় না। বরং সে নিজেই তার অধিকারের জন্য লড়াই করে। এই চরিত্রের মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী ‘পুরুষ নারীর রক্ষক’ এই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। নারীর প্রতিবাদের ভাষা শুধু শব্দে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক প্রকাশ, যা সমাজের গভীরে প্রভাব ফেলে। যেমনটা দেখা যায় মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী মেঝেন– আদিবাসী এক সাঁওতাল নারী তার শরীরকেও প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এই ধরনের প্রতিবাদ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী উপায়। বর্তমান সমাজে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্র– যেমন শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। এই লড়াই শুধু তাদের নিজেদের জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্য একটি সুস্থ ও সমতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে। 
বাংলাদেশ তার অর্ধশত বছর অতিক্রম করলেও নারীর জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ক্রুর থেকে ক্রুরতর হয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ বিনির্মাণ কালে নারীকে পাশে চায়, কিন্তু নারীর অধিকার নিশ্চিন্তকরণের বেলায় নারীকে তখন ‘শরীর’, ‘অপর’ করে তোলার প্রক্রিয়াও দেখা যায়। একাত্তর থেকে চব্বিশ– সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও ফলভোগী হয়ে উঠতে চায় পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোটি। এই পদ্ধতি কাজ করে নারীকে বেশ্যাকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, অমানবিকীকরণের ভেতর দিয়ে; কেননা মানুষ শব্দের সমার্থক হয়ে ওঠে শুধু একা পুরুষ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এক নারী শিক্ষার্থীকে ‘হানি ট্র্যাপ’ বলেছেন। নারীর প্রতিবাদের স্বরকে বন্ধ করতে তার শরীরকে সামনে নিয়ে আসা হয়। তাকে অসম্মান করার হাতিয়ার হিসেবে তার যৌনাঙ্গকে বেছে নেওয়া হয়। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাব নারীকে পুলিশ কর্মকর্তা ‘রাতের রানী’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। ভালো নারীরা রাতে বাইরে থাকে না, কেননা তাদের একটি যৌনাঙ্গ আছে, ভালো নারীরা রাতে বাইরে থাকে না, কেননা তাদের স্তন আছে কিন্তু তাদের মগজ দেখা যায় না, মেধা দেখা যায় না। কারণ পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো দেখতে দিতে চায় না। সে ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি নারীর প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে পাল্টা ডিসকোর্স দিয়ে নয়, বরং নারী ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃঢ় গলায় বলতে পেরেছে– হ্যাঁ আমিই রাতের রানী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় উঠেছে ‘রাতের রানী; স্লোগানে। শুধু উচ্চারণে নয়, নারীর প্রতিবাদ প্রকাশ পায় তাদের চোখের দৃষ্টিতে, তাদের কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তায়, তাদের পদক্ষেপের শক্তিতে। এটি প্রকাশ পায় তাদের সাহসে, তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে।  
জুলাই গণঅভ্যুত্থান কালপর্বে আমরা দেখেছি মধ্যরাতে হলের গেট ভেঙে বেরিয়ে এসেছে নারী শিক্ষার্থীরা। বাহবা জুটেছে কিন্তু অভ্যুত্থান পেরিয়ে যখন সমতার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে তারা, তখন এসে নারীকে শুনতে হচ্ছে ‘হাফ প্যান্ট পরে ফুটবল খেলা যাবে না’, ‘স্যানিটারি ন্যাপকিন গোপনীয় বস্তু’। অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে হাজার হাজার সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অথচ নারীশূন্য মঞ্চ, কোথাও বা টোকেন নারী বক্তা। অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। এটি প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীরা সমানভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
বর্তমান সমাজে নারীর প্রতিবাদের ভাষা বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। ইরানে মাশা আমিনির মৃত্যুর পর নারীরা হিজাব খুলে ফেলে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এটি শুধু একটি পোশাক খোলার ঘটনা নয়, এটি একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। নারীরা তাদের শরীরের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে। কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারীরা ঘর ছেড়ে রাতের রাস্তা দখল করেছে। যে রাতের রাস্তা তাদের জীবনে সান্ধ্য আইন বয়ে নিয়ে এসেছিল তাকেই তারা দখল করে নিতে চাইল। প্যারাডাইম শিফটের ভেতর দিয়ে রাতকে করে নিতে চাইল নিজের করে, এটাই তাদের প্রতিবাদ। 
নারী তার প্রতিবাদের ভাষা শুধু কথার মধ্যেই সীমিত করে রাখতে চায় না। এটি তাদের কর্মে, তাদের সাহসে এবং তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে প্রকাশ পায়। নারীর প্রতিবাদের ভাষা বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে। কখনও তা হতে পারে একটি কবিতা, কখনও একটি চিত্রকর্ম, কখনও একটি গান, আবার কখনও একটি মিছিল। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর মূল উদ্দেশ্য একটাই– সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। 
নারীর প্রতিবাদের ভাষা শুধু বর্তমানের জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও। প্রতিটি প্রতিবাদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল পথ তৈরি করে। যাতে তারা একটি সমতাপূর্ণ সমাজে বেড়ে উঠতে পারে। এ ভাষা কখনও হিংসাত্মক নয়, বরং এটি সৃজনশীল ও রচনাত্মক। এটি ধ্বংসের নয়, নির্মাণের। এটি ঘৃণার নয়, ভালোবাসার। এটি বিভেদের নয়, ঐক্যের। নারীর প্রতিবাদের ভাষা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি পরিবর্তনের বাহক। এটি সমাজকে নাড়া দেয়, চিন্তা করতে বাধ্য করে। এটি প্রশ্ন তোলে, চ্যালেঞ্জ করে প্রচলিত ধারণাগুলোকে।
শেষ পর্যন্ত নারীর প্রতিবাদের ভাষা হলো স্বাধীনতার ভাষা, মুক্তির আহ্বান। এটি সমতার দাবি, ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা, মানবাধিকারের ঘোষণা। নারীর প্রতিবাদের ভাষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রতিটি নারী একজন মানুষ, তার নিজস্ব পরিচয় আছে, তার স্বপ্ন আছে, তার আকাঙ্ক্ষা আছে। সে শুধু কারও মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা নয়– সে নিজের অধিকারে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তাই যখনই কোনো নারী প্রতিবাদ করে, তখন সে শুধু নিজের জন্য নয়, সমগ্র নারী সমাজের জন্য কথা বলে। তার প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে সকল নারীর কণ্ঠস্বর। এই প্রতিবাদের ভাষা ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, ব্যাপক হচ্ছে। এটি এখন আর থামানো যাবে না। কারণ এটি শুধু একটি ভাষা নয়, এটি একটি আন্দোলন– একটি বিপ্লব। নারীর প্রতিবাদের ভাষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে এবং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এটি এখন শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশ নয়, বরং একটি সামষ্টিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সামাজিক মাধ্যম, শিল্পকলা, সাহিত্য, খেলাধুলা, রাজনীতি– সব ক্ষেত্রেই নারীরা তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরছে। এই প্রতিবাদের ভাষা শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, এটি একটি নতুন, ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের আহ্বান। প্রতিটি প্রতিবাদ তা যতই ছোট হোক না কেন, একটি বৃহত্তর পরিবর্তনের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। 

লেখক

চলচ্চিত্রকার
লেখক ও শিক্ষক 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভুলের দেয়ালে সিদ্ধান্তের পেরেক
  • বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাসদ গঠনের কাজ শুরু হয়েছে: ব্যারিস্টার ফারাহ খান
  • অস্ট্রেলিয়াকে খর্বশক্তির মানতে নারাজ স্মিথ
  • জিম্মির লাশ নিয়ে ফের যুদ্ধের শঙ্কা 
  • ফাগুনের চিঠি
  • তোমার জন্য একটি চিঠি
  • ভাষাশহীদদের প্রতি আমরা কতটুকু শ্রদ্ধাশীল?
  • নারীর প্রতিবাদের ভাষা শক্তি ও সাহসের প্রতীক