সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের লক্ষ্য দ্রুততার সঙ্গে সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা, যাতে নির্বাচনের পথে অগ্রসর হওয়া যায়।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ কথা বলেন। আজ শনিবার ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক শেষে কমিশনের লক্ষ্য ও বৈঠকের বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের জানান তিনি। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ২৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ওই বৈঠক করে কমিশন। এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক আজ বেলা তিনটার পর শুরু হয়। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে এ বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, আজকের বৈঠকের লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রক্রিয়াটি কী হবে, সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা। এক অর্থে এটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ২৭টি দল ও জোটের পক্ষ থেকে এক শ জনের বেশি রাজনীতিক বৈঠকে যোগ দেন। তিনি বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে যে বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—জাতীয় ঐক্য রক্ষার আর কোনো বিকল্প নেই। সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দলগুলো দৃঢ়তা প্রকাশ করেছে। তাদের (দলগুলো) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংস্কারপ্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করবে, সাহায্য করবে, অংশগ্রহণ করবে।

আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে; যেটা আজ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন—আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই, আমরা প্রত্যেকেই—রাজনৈতিক দল হিসেবে, নাগরিক হিসেবে, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই সংস্কারপ্রক্রিয়াকে সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তার লক্ষ্যেই আজ এই সূচনা। আমরা আশা করছি, জাতীয় ঐকমত্যের কাজ এখন শুরু হবে।’

আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা আলাদাভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলব, জোটগতভাবে কথা বলব এবং সম্ভাব্য লক্ষ্য হচ্ছে একপর্যায়ে হয়তো আবারও সবাইকে একত্রিত করব। এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা করতে চাই না। আমরা আশা করছি, কিছুদিনের মধ্যে এটা করতে পারব।’ তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের জমা দেওয়া প্রতিবেদনগুলোর ছাপা কপি চেয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে সেটি দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, সর্বোপরি যেটা বিষয়, সেটা হলো ঐকমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কারও কোনো দ্বিধার সুযোগ নেই এবং সেই প্রক্রিয়াটিই দ্রুত অগ্রসর করতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা বৈঠক কবে শুরু হবে এবং সংলাপ কত দিন লাগতে পারে? জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ দেওয়া হয়েছে ছয় মাস। সে ক্ষেত্রে কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে চাই। ছয়টি কমিশনের সারাংশ ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্যালোচনা করার জন্য তাদের সময় দিতে হবে। আমরা চাই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে; কেননা সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যাতে আমরা নির্বাচনের পথে অগ্রসর হতে পারি।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা আশা করছি, ছয় মাসের কম সময়ে যদি সম্ভব হয়। রাজনৈতিক দলগুলোরও আগ্রহ আছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও মনে করে যত দ্রুত সম্ভব। কিন্তু এটি অকস্মাৎ হবে না, মাত্র প্রতিবেদনগুলো পাওয়া গেছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র য় জ বল ন

এছাড়াও পড়ুন:

আমলাতন্ত্রের দোরগোড়ায় আটকে যায় সব সংস্কার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত। অনেক আলোচনা হয়েছে। এমনকি তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একধরনের ঐকমত্যও আছে। কিন্তু শেষমেশ কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না।

দেশে নীতিপ্রণেতা, পরামর্শক ও বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে একধরনের দূরত্ব আছে। এমনকি বিদ্যায়তনের মানুষের কথা রাজনীতিবিদেরা মেনে নিলেও কিছু হয় না। তাতে শেষমেশ দেখা যায়, আমলাতন্ত্রের দোরগোড়ায় গিয়ে সব সংস্কার আটকে যায়।

অর্থনীবিদ সেলিম জাহানের দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আজ বৃহস্পতিবার বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। বাঙলার পাঠশালা আয়োজিত এই অনুষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। বই দুটির মধ্যে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ এবং মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ: কনটেমপোরারি ডেভেলপমেন্ট ইস্যুস’।

প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। সভাপতিত্ব করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ। আর বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন, সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন প্রমুখ।

রেহমান সোবহান বলেন,‘ দেশের সমস্যা কী এবং তার সমাধনই-ই বা কী, তা নিয়ে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। আমরা জানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আরও বিনিয়োগ করা দরকার। কিন্তু শেষমেশ কোনোটি হয় না।’ কেন বারবার অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায় না, এখন তার ভেতরের গল্প তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।

পৃথিবীর অনেক দেশে সহিংসতা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে এবং তারপর তারা অনেকেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেলিম জাহান বৈশ্বিক পরিসরে কাজ করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রওনক জাহান আহ্বান জানান, তিনি যেন সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের প্রসঙ্গে লেখেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে আবার কার্যকর করা যায়, তা বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে লেখার আহ্বান জানান।

সংস্কার প্রসঙ্গে সব সরকারই বিশেষজ্ঞদের কথা অগ্রাহ্য করেছে বলে অভিযোগ করেন মাহ্‌ফুজ আনাম। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৯টি টাস্কফোর্স গঠনে রেহমান সোবহান যুক্ত ছিলেন। টাস্কফোর্সগুলোর উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতি ও প্রশাসনপ্রক্রিয়ার নানা সমস্যার সমাধান করা। টাস্কফোর্সগুলোয় ছিলেন সেই সময়কার দেশের ২৫৫ জন সেরা পেশাদার ব্যক্তি। কিন্তু সেই টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন পরবর্তী অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সম্ভবত পড়েও দেখেননি।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান চলমান সংস্কারের গতি-প্রকৃতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, সংস্কারের চাপ দেওয়ার জন্য সমাজে নানা রকম গোষ্ঠী আছে, বিষয়টি সে রকম নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী ছাড়া সমাজে আরও কেউ সংস্কার চায়, তেমনটা মনে হচ্ছে না।

সংস্কার প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, এ বিষয়ে বৃহত্তর ঐকমত্য দরকার, তা না হলে কোনো উদ্যোগই আলোর মুখ দেখবে না। এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আমলেও সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিছু কাজ সেই সরকার করেছিল; কিন্তু শেষমেশ তার কিছুই টেকেনি।

বই দুটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সেলিম জাহান বলেন, এগুলো গবেষণাধর্মী বই নয়। একদম সাধারণ মানুষ যেন পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল বুঝতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে এই বই দুটি লেখা।

আলোচনায় প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন বলেন, বাংলোদেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বইটি সাংবাদিকদের পড়া উচিত। উন্নয়ন ও অগ্রগতির মধ্যে কী ফারাক, তা বোঝার জন্য এই বই পড়া জরুরি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবের ওপর রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের চেষ্টা চলছে: প্রধান বিচারপতি
  • জিম্মির লাশ নিয়ে ফের যুদ্ধের শঙ্কা 
  • ছয় কমিশনের প্রতিবেদন এবং ঐকমত্যের প্রশ্ন
  • বাংলাদেশ হউক বহুপক্ষীয়
  • আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে গণ অধিকার পরিষদ
  • আমলাতন্ত্রের দোরগোড়ায় আটকে যায় সব সংস্কার
  • দলগুলো সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ডিসেম্বরে নির্বাচন সম্ভব হবে: আলী রীয়াজ