রাষ্ট্র পুনর্গঠনে সংসদ নির্বাচন আয়োজনই এখন বড় অগ্রাধিকার: জোনায়েদ সাকি
Published: 15th, February 2025 GMT
সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্যের জায়গায় আনতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে প্রস্তাব দিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেছেন, এ সময়ে জাতীয় কর্তব্য হচ্ছে, সংস্কার এগিয়ে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন করা। সেদিক থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার।
আজ শনিবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বেরিয়ে জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের এ কথাগুলো বলেন। রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিএনপি, জামায়াতসহ দেশের ২৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে উপদেষ্টামণ্ডলী, কমিশনগুলোর প্রধানদেরসহ রাজনৈতিক দলগুলো এবং শিক্ষার্থীদের সংগঠনের প্রতিনিধিদের ডেকেছেন। প্রশ্ন এসেছে, কীভাবে এ সংস্কারপ্রক্রিয়া, নির্বাচনপ্রক্রিয়া এগোবে। আমাদের দিক থেকে তিনটি প্রশ্নকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। প্রথমত, ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য তৈরি। যেসব বিষয়ে সবাই একমত, তা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা দরকার এবং সেটাই জাতীয় সনদ আকারে আমাদের সামনে আসতে হবে।
‘দ্বিতীয় হচ্ছে, কী পদ্ধতিতে এগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। আমরা বলেছি, সংবিধান সংস্কার করতে হবে। আর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে যাতে এ সংস্কার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সরকার ও সব পক্ষ যাতে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়।
‘এ ছাড়া নির্বাচনকে এই সংস্কারপ্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা। সংস্কার যেমন নির্বাচনের জন্য দরকার, তেমনি সংস্কার সম্পন্ন করতেও নির্বাচন লাগবে। কাজেই এটাকে বিরোধ হিসেবে না দেখে আগামী নির্বাচনকে সংস্কার সম্পন্ন করার একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা। পরবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংস্কার সভা বা সংসদ গঠিত হবে, সেখানে সংস্কারগুলো বিশেষভাবে সংবিধান সংস্কার যাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়, তার একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি করা এবং সে বিষয়ে অঙ্গীকার ও আইনে বাধ্যবাধকতা তৈরি করা।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক
এছাড়াও পড়ুন:
পুলিশ সংস্কার কি আদৌ হবে, কতটুকু হবে
অন্তর্বর্তী সরকার জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর। কমিশন পুলিশ সংস্কারের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয় গত ১৫ জানুয়ারি।
সংস্কারের জন্য কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর নীতিমালা অনুসরণ করে পুলিশ কর্তৃক পাঁচ ধাপে বলপ্রয়োগের পরিকল্পনা, গ্রেপ্তার–তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন, আসামিকে কাচঘেরা কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যবস্থা, সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া তল্লাশির অভিযোগ গ্রহণে জরুরি কল সার্ভিস চালু, অভিযানকালে ‘বডি ক্যামেরা’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, অজ্ঞাতনামা আসামির নামে মামলা দেওয়ার অপচর্চা বন্ধ করা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে পুলিশের মানাবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা প্রদান, থানায় জিডি ও মামলা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা, পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই–বাছাই না করা, ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ঔপনিবেশিক পুলিশ আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির সংস্কার, পুলিশের কার্যক্রম তদারকিতে থানা বা উপজেলাভিত্তিক ‘ওয়াচডগ বা ওভারসাইট কমিটি’ গঠন, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত, পুলিশের মধ্যে ‘জেন্ডার ও চাইল্ড সেন্সিটিভিটি’ নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
এই সুপারিশগুলো জনমুখী পুলিশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সন্দেহ নেই। কিন্তু সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পথে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে পুলিশ বাহিনীর ওপর দলীয় রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব। আর এই প্রভাব থেকে পুলিশ বাহিনীকে মুক্ত রেখে পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালনার জন্য অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়টি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বহুল প্রত্যাশিত ও আলোচিত স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের ব্যাপারে কোনো সুষ্পষ্ট সুপারিশ ও রূপরেখা দেওয়া হয়নি।
■ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামতের জন্য যেসব সংস্কার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, সেখানে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ■ পুলিশ সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক জনমত জরিপেও পুলিশের তদারকির জন্য স্বাধীন সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসে। ■ পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করা হয়েছে।কমিশনের ৪ নম্বর সুপারিশে একটি নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের বিষয়ে ‘নীতিগতভাবে ঐকমত্য’ পোষণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই কমিশনের গঠন, কার্যপরিধি, সাংবিধানিক বা আইনি বাধ্যবাধকতা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ ও যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে, যা খোদ পুলিশ বাহিনীসহ পুলিশ সংস্কারপ্রত্যাশী অনেককেই আশাহত করেছে। সংস্কার কমিশন তো গঠনই করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ সদস্যদের মাধ্যমে। সেই সংস্কার কমিশনের সুপারিশেই যখন আবার ‘বিশেষজ্ঞ মতামত’ গ্রহণের কথা বলা হয়, তখন তা সংস্কারপ্রক্রিয়া ঝুলিয়ে দেওয়ার জায়গা থেকে করা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক।
এ ছাড়া পুলিশ সদস্যদের অপরাধ তদন্তে স্বতন্ত্র অভিযোগ কমিশন গঠনে সুপারিশ না থাকা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি না রাখার কারণেও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।
গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দেশের সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন–পীড়ন চালানোর কাজে ব্যবহার করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো পুলিশ বাহিনী। যে প্রতিষ্ঠানের ওপর দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে, সেই প্রতিষ্ঠানই পরিণত হয়েছিল জনগণের বিপক্ষে জুলুমের হাতিয়ারে। পুলিশ বাহিনী এ সময় সরকারি দলের হয়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের ওপর দমন–পীড়ন থেকে শুরু করে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, ভোট জালিয়াতি, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা, গায়েবি মামলা ইত্যাদি ভয়াবহ অপকর্মে লিপ্ত ছিল, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের পর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মধ্য দিয়ে।
এ কারণে বাংলাদেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও রাষ্ট্রীয় জুলুম থেকে রক্ষার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো পুলিশ সংস্কার। অবাক করা বিষয় হলো, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামতের জন্য যেসব সংস্কার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, সেখানে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বলা হচ্ছে, পুলিশ সংস্কারের সুপারিশগুলো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়েই বাস্তবায়ন করা যাবে। কমিশনের খুঁটিনাটি সব সুপারিশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হয়তো নেই। কিন্তু স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন কিংবা ঔপনিবেশিক পুলিশ আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির মতো গুরুতর সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে সংস্কার বাস্তবায়ন ও টেকসই করা কঠিন হবে। এ কারণে খোদ পুলিশের সদস্যরাই মনে করছেন, যে ‘প্রশাসনিক ব্যবস্থার’ মাধ্যমে পুলিশ সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তার ফলে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তা আসলে নষ্ট হবে।
এ বিষয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের সদস্যরা নিজেরাই বলছেন, পুলিশের মূল সমস্যা হলো অবৈধ আদেশ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার। এ প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও পদায়ন ঘিরে। যদি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের মাধ্যমে এ কাজগুলো করা যেত, তাহলে পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব কমে যেত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বর্তমান ব্যবস্থায় চলতে থাকলে এই পুলিশ কখনোই ঠিক হবে না। (সুপারিশ নিয়ে পুলিশে ক্ষোভ, বলবেন প্রধান উপদেষ্টাকে, প্রথম আলো, ১৬ মার্চ ২০২৫)
আরও পড়ুনপুলিশকে ঢেলে সাজাতে যা যা করা দরকার১৪ নভেম্বর ২০২৪সংস্কার বিষয়ে পুলিশ বাহিনীর এই আগ্রহ প্রশংসনীয়। সাধারণত দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে গেলে সবচেয়ে বড় বাধা আসে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকেই। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনী বাধা প্রদানের বদলে যে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে এসেছে, সেটা সাধুবাদযোগ্য। পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে শুধু পুলিশ কমিশনের সুপারিশই করা হয়নি, কমিশনের জন্য একটা খসড়া রূপরেখাও পাঠানো হয়।
এই খসড়া অনুসারে, কমিশনের সদস্য হবেন ১১ জন। কমিশনের চেয়ারপারসন হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি অথবা অবসরপ্রাপ্ত একজন আইজিপি। সদস্যদের মধ্যে চারজন থাকবেন জাতীয় সংসদের সদস্য; এর মধ্যে দুজন সরকারি দলের, একজন প্রধান বিরোধী দলের এবং আরেকজন অন্য দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে মনোনীত। চারজন থাকবেন অরাজনৈতিক ব্যক্তি, যাঁরা বাছাই কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে বিভিন্ন পেশা থেকে মনোনীত হবেন। এর মধ্যে একজন আইনজ্ঞ, অবসরপ্রাপ্ত একজন আইজিপি, সমাজবিজ্ঞান বা পুলিশিং বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও একজন মানবাধিকারকর্মী থাকবেন। চারজনের অন্তত একজন নারী থাকবেন। বাকি দুই সদস্য হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আইজিপি। (পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, সংলগ্নী-৮)
স্বাধীন পুলিশ কমিশনের কথা যে শুধু পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তা নয়; পুলিশ সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক জনমত জরিপেও পুলিশের তদারকির জন্য স্বাধীন সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশই পুলিশের জন্য একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা কমিশন গঠনের পক্ষে বলেছেন। আর বাকি ৪১ দশমিক ১ শতাংশ সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় একটি স্বাধীন ‘পুলিশ ন্যায়পাল’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত দিয়েছেন। এ ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্তের জন্য ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা একটি স্বাধীন সংগঠনের মাধ্যমে তদন্তের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। (পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ২৩-২৪)। ফলে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য স্বাধীন–স্বতন্ত্র তদারকি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা পুলিশ ও জনগণ উভয় দিক থেকেই এসেছে।
কিন্তু এ ব্যাপারে আপত্তি এসেছে ভিন্ন একটি জায়গা থেকে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করা হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে পাঠানো মতামতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন করলে নিয়ন্ত্রণকারী কোনো কর্তৃপক্ষ থাকবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা এবং পুলিশ বাহিনীকে যৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাবে না। সুতরাং স্বাধীন পুলিশ কমিশন করার প্রস্তাবের সঙ্গে জননিরাপত্তা বিভাগ যৌক্তিক কারণে দ্বিমত পোষণ করছে। (পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, সংলগ্নী-৯)
স্বাধীন পুলিশ কমিশন করলে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ থাকবে না—এ কথা সঠিক নয়। স্বাধীন পুলিশ কমিশনই হবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, যার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করার সুযোগ তৈরি হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ রকম স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর তদারক করা হয়। উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার পুলিশ কমিশনের কথা বলা যায়।
শ্রীলঙ্কার পুলিশ কমিশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, এই পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য হলো পুলিশ বিভাগের বিরাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন মজবুত করা। কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে পুলিশের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত ও শাস্তি প্রদান। পুলিশের কোড অব কন্ডাক্ট কী হবে, কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, এগুলোও নির্ধারণ করে শ্রীলঙ্কার পুলিশ কমিশন।
অথচ বাংলাদেশে পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করার কেউ থাকবে না—এমন অজুহাত দিয়ে স্বাধীন পুলিশ কমিশনের বিরোধিতা করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। শুধু তা–ই নয়, এ বিভাগের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশক আমলে প্রণীত নিপীড়নমূলক আইনগুলোর সংস্কার বিষয়েও আপত্তি তোলা হয়েছে। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনকে দেওয়া মতামতে জননিরাপত্তা বিভাগ লিখেছে, ‘বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধানসমূহ পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতার সঙ্গে কাজ করার জন্য যথেষ্ট। উক্ত আইন বিধিসমূহ সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা নেই। উক্ত আইন ও বিধি বিধানসমূহ মেনে কাজ করলে অবশ্যই পুলিশবাহিনী জবাবদিহিতার সাথে কাজ করতে পারবে।’ (পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, সংলগ্নী-৯)
অথচ পুলিশ সংস্কার কমিশনের জনমত জরিপে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮–এর বিভিন্ন ধারার সংস্কার চেয়েছেন বেশির ভাগ উত্তরদাতা। যেমন পুলিশ কর্তৃক বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তারের বিধানসংবলিত ৫৪ ধারার সংস্কার বা সংশোধন চেয়েছেন ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ১৬৭ ধারায় পুলিশ হেফাজতে বা রিমান্ডে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের ধারাটি সংশোধন বা সংস্কার চেয়েছেন ৯১ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা। (পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ১৭-১৮)
একদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন ও ঔপনিবেশিক পুলিশ আইন সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপত্তি প্রদান এবং অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পুলিশ সংস্কার বিষয়ে কোনো মতামত না চাওয়ার বিষয়গুলো নানা ধরনের প্রশ্ন ও সংশয়ের জন্ম দিয়েছে।
সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মাতামত চেয়ে ৩৭টি রাজনৈতিক দলকে চিঠি ও ‘স্প্রেডশিট’ পাঠিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। কোন সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে তারা একমত এবং সেগুলো নির্বাচনের আগে না পরে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে নাকি জাতীয় সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে, তা দলগুলোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশের বিষয়ে একমত হবে, সেগুলোর ভিত্তিতে তৈরি হবে ‘জুলাই চার্টার’ বা জুলাই সনদ।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো স্প্রেডশিটে পুলিশ সংস্কারের সুপারিশগুলো না থাকায় জুলাই চার্টারে পুলিশ কমিশনের সুপারিশ থাকবে না। এ রকম অবস্থায় পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের কোনগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, নির্বাচনের আগে কতটুকু আর নির্বাচনের পর কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি না হলে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দল সেই সংস্কারের কতটুকু অক্ষুণ্ন রাখবে আর কতটুকু বাতিল করে দেবে ইত্যাদি প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
যেসব সংস্কারের প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে, সেগুলোর পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হলে বা একমত হয়েও বাস্তবায়ন না করলে তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী থাকবে। কিন্তু পুলিশ সংস্কারের সুপারিশগুলো যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানোই হলো না, সেহেতু এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত না হলে বা বাস্তবায়নের পর টেকসই না হলে তার সম্পূর্ণ দায় কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরেই বর্তাবে।
●কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক