আমরা সুইডেনে বা ঢাকায় বসে যখন ‘সার্কুলার প্ল্যাটফর্ম’ কৃষকদের জন্য কী কী সুবিধা আনতে পারে, এমন বিষয়ে আলোচনা করছি, এমন একদিন একটি খবর পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল; ফুলকপির চাষিরা অতি অল্প মূল্যে ফুলকপি বিক্রি করে দিচ্ছেন, এমনকি ফুলকপি বিক্রি করতে না পেরে ফেলেও দিচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অনেক বেশি হয়ে গেছে। 

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলে অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী দাম কমে যায়; কিন্তু আমরা জানি যে আমাদের দেশে যুগে যুগে চাষিরা তাঁদের শস্যের দাম ঠিকমতো পাননি আর এখনো পাচ্ছেন না। এটা শুধু উৎপাদন বেশি হয়েছে বলে ঘটে না। তা ছাড়া যদি উৎপাদন বেশিই হয়, তাহলে আমাদের দরিদ্র কৃষকদের ঘরে খাবারের অভাব থাকে কেন? এখনো কেন আমরা খাদ্যনিরাপত্তা অর্জন করতে পারিনি? 

ইউরোপীয় কমিশনের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনো আমাদের দেশের ২৬ শতাংশ মানুষের (তিন লাখ রোহিঙ্গাসহ) খাদ্যে চরম অনিরাপত্তা রয়েছে। গবেষকদের মতে, আমাদের দেশের বিপণনব্যবস্থা ভালো না। কৃষকের উৎপাদিত শস্য ভোক্তাদের কাছে সময়মতো পৌঁছায় না। আর যা পৌঁছায়, তা অনেক হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত যখন পৌঁছায়, তখন সেসব ভোক্তাকে অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়। অন্য দিকে কৃষকের কাছ থেকে খুব অল্প দামে শস্য কিনে নেয় মধ্যস্বত্বভোগী ‘ভ্যালুচেইন অ্যাক্টর’রা। তার মানে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এ লেখাটিতে আমি এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি প্রস্তাব করছি, যা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পেতে এবং ভোক্তাদের যুক্তিসংগত মূল্যে মানসম্মত খাবার পেতে সহায়তা করবে। আপাতদৃষ্টে এটি অসম্ভব কল্পনা মনে হতে পারে, তবু চেষ্টা করে দেখার পক্ষে আমি। এটি করা সম্ভব যদি আমরা কৃষির উপযুক্ত ‘ইকোসিস্টেম’ ও একটি সহায়ক অবকাঠামো তৈরি করতে পারি এবং এই ধারণা বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট সাহসী এবং দৃঢ় অবস্থান নিতে পারি। আমি এখানে যে সমাধান তুলে ধরতে চাচ্ছি, তাকে বাংলায় বলা যেতে পারে ‘বৃত্তাকার কৃষি উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম’। একটি বৃত্তাকার কৃষি উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম কী, তা বোঝার জন্য আমাদের এই চারটি শব্দকে আলাদাভাবে বুঝতে হবে।

ইনোভেশন বা উদ্ভাবন

ইনোভেশন/উদ্ভাবনকে আমরা সাধারণত নতুন বা অভিনব কিছু মনে করি; কিন্তু ইনোভেশন মানেই খুব নতুন কিছু হওয়ার দরকার নেই। ইনোভেশন হবে সেটিই, ভোক্তাদের কাছে যার একটি বিশেষ মূল্য থাকবে বা যা ব্যবহার করে ভোক্তারা মনে করবেন, তাঁদের চাহিদা পূরণ হয়েছে। কৃষি খাতে উদ্ভাবন বা ইনোভেশন হতে পারে মানসম্মত খাদ্য উৎপাদন, উচ্চ ফলন, উল্লম্ব কৃষিকাজ, মাটির গুণমান ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে নির্ভুল কৃষি, ভোক্তার কাছে দ্রুত সরবরাহ, ভোক্তাদের কাছে যুক্তিসংগত মূল্যে মানসম্মত খাদ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রস্তুতকরণ বা বিপণন ইত্যাদি।

উদ্ভাবনী/ইনোভেশন প্ল্যাটফর্ম

উদ্ভাবনী বা ইনোভেশন প্ল্যাটফর্ম হলো একটি ভার্চু৵য়াল জায়গা, যা ‘ভ্যালু’ সৃষ্টিকে সক্ষম করে অর্থাৎ ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করে। ভোক্তাদের চাহিদা যদি কোনো পণ্য দিয়ে মেটানো না যায়, তাহলে তাকে কখনোই ইনোভেশন বলা যাবে না। এই প্ল্যাটফর্ম উৎপাদক, ভোক্তা এবং বাজারের অন্যান্য অংশীদারদের, যেমন প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা, নীতিনির্ধারক, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে একত্র করে; তাদের সাধারণ সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে সাহায্য করে এবং বাজারের চাহিদা শনাক্ত করতে সহায়তা করে।

এর ফলে বাজারে উদ্যোক্তাদের আসার সুযোগ তৈরি হয়। যেমন ধরুন, ভোক্তারা যদি জৈব বা অর্গানিক খাবার খেতে বেশি আগ্রহী হন, স্বাভাবিকভাবেই পোলট্রির জন্য জৈব বা অর্গানিক খাদ্য, মাটির জন্য জৈব বা অর্গানিক সার এবং কম কার্বন পদচিহ্নসহ সরবরাহব্যবস্থার প্রয়োজন হবে। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য উদ্যোক্তারা তখন তেমন জৈব বা পরিবেশবান্ধব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন বা পারবেন। 

সার্কুলার বা বৃত্তাকার অর্থনীতি

এই উদ্ভাবনী/ইনোভেশন প্ল্যাটফর্মে ‘বৃত্তাকার’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এটা এসেছে বৃত্তাকার অর্থনীতি বা সার্কুলার ইকোনমি নামক ধারণা থেকে, যা টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। সার্কুলার ইকোনমিকে একটি পুনর্জন্মব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়; যা বলে—পণ্যকে পুনর্ব্যবহার, পুনর্গঠন, পুনর্নির্মাণ করে নতুন পণ্য তৈরি করো। 

সার্কুলার ইকোনমির তিনটি প্রধান নীতি হলো ১.

বর্জ্য ও দূষণ দূর করা; ২. পুনর্ব্যবহার, মেরামত, পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে পণ্যের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করা এবং ৩. নবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহার করা। সহজ কথায়, একটি সার্কুলার ইকোনমিতে বর্জ্য এবং সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে ‘শূন্য বর্জ্য’ (জিরো ওয়েস্ট) নিশ্চিত করা হয়। যেমন গরুর গোবর জৈব সার উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা পরে ফসল উৎপাদনের জন্য উর্বর জমিতে ব্যবহার করা হয়; অথবা খাদ্য বর্জ্য কম্পোস্ট বা ধানের তুষ ও ছাই তৈরিতে ব্যবহার করে তৈরি হয় শক্তি, যা ব্যবহার করা যায় অন্য কোনো সামগ্রী উৎপাদন করার জন্য। 

 বৃত্তাকার চর্চা বা সার্কুলার প্র্যাকটিস বাংলাদেশে নতুন নয়। কয়েক শতক ধরে কৃষকের ঘরে ঘরে এই ধরনের চর্চা চলে এসেছে। তবে কয়েক দশক ধরে এই চর্চাগুলো বাদ দিয়ে কৃষকেরা অনেক বেশি অজৈবিক/নন অর্গানিক চর্চার দিকে ঝুঁকেছেন। কারণ, তাঁদের ধারণা নন-অর্গানিক চর্চার ফলে উৎপাদন বেশি হয়; কিন্তু উৎপাদন বেশি করতে গিয়ে খাদ্যর মধ্যে যে বিষ ঢুকিয়ে ফেলছে, তারা সেটি খেয়ালই করছেন না বা করলেও জীবন ও জীবিকার জন্য ওই পথটাই বেঁচে নিয়েছেন। 

বৃত্তাকার কৃষি উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম

আমাদের দেশে কৃষকেরা যেন তাদের পণ্যের জন্য প্রাপ্য মূল্য পান, তার জন্য আমি একটি সার্কুলার/বৃত্তাকার কৃষি উদ্ভাবনী/ইনোভেশন প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রস্তাব করছি। এই প্ল্যাটফর্ম কৃষক এবং ভোক্তাদের মধে৵ মধ্যস্থতাকারীর পরিমাণ কমিয়ে আনবে। এতে কৃষকেরা সরাসরি বা অল্প সংখ৵ক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে তাদের পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন। আর ভোক্তারাও স্বল্প মূল্যে ভালো খাবার খেতে পারবেন। 

বিভিন্ন কৃষিজীবী মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান যেমন কৃষক, হাঁস-মুরগি এবং মাছ সংগ্রহকারী, সবুজ সার, কীটনাশক কোম্পানি, বীজ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র, পুনঃ চক্রায়ন কেন্দ্র, মুদিখানা এবং ভোক্তাদের মধ্যে সম্পদ বিনিময় সমন্বয় করে সম্পদের শূন্য অপচয় নিশ্চিত করবে। 

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কোনো মধ্যস্থতাকারীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে এবং প্রয়োজনে তাঁদের কাছ থেকে সরাসরি ন্যায্যমূল্য দিয়ে পণ্য কিনে নিতে পারবে। 

গবেষণাকেন্দ্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হবে, যার ফলে ভবিষ্যতের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য নতুন জ্ঞান তৈরি করতে সাহায্য করবে এবং টেকসই/সাস্টেইনেবল/গ্রিন/অর্গানিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেবে।

প্ল্যাটফর্মটা কেমন হবে 

প্ল্যাটফর্মটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বনির্ভর হতে হবে। কারণ, একটি বৃত্তাকার/সার্কুলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে অংশীদারেরা একে অপরকে উপকৃত করবে। সহজ করে যদি বলি, কৃষির একটি খাত থেকে যে বর্জ্য আসবে, তা অন্য খাতে ব্যবহার করা হবে। আগে যেমন একটা উদাহরণ দিয়েছি—গোবর ব্যবহার হচ্ছে সার উৎপাদনের জন্য, তা শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এতে কৃষির এক খাত আর এক খাতকে সমৃদ্ধ করবে। 

কৃষক, ভোক্তা এবং বাজারের অন্যান্য অ্যাক্টর যারা আছে, তারা একটি ভার্চু৵য়াল প্ল্যাটফর্ম, একটি ওয়েব অ্যাকাউন্ট এবং/অথবা একটি স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে সংযুক্ত হবে। এই অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকেরা কী উৎপাদন করলেন, কী পরিমাণে করলেন বা তার কত মূল্য—এ ধরনের তথ্যগুলো অন্যদের সঙ্গে আদান–প্রদান করতে পারবেন। ভোক্তারা এবং অন্য উদ্যোক্তারা এই তথ্যগুলো আগেই জানতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কোথা থেকে, কবে, কোন পণ্য বা বর্জ্য তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনে কিনবে। 

একটি ভৌত/ ফিজিক্যাল প্ল্যাটফর্মও থাকতে হবে, যা এই ভার্চু৵য়াল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বাজারমূল্যে বিক্রি করার জন্য এই আউটলেটে নিয়ে আসবেন। তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য দোকানের কাছাকাছি অবস্থিত স্টোরেজ, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং কেন্দ্রে রেখে যেতে পারবেন পরবর্তী দিনের জন্য।

আজ যদি প্রতিটা উপজেলা শহরে এমন প্রতিষ্ঠান থাকত, তাহলে কৃষকদের এই শীতের ফুলকপিগুলোকে এত কম মূল্যে বিক্রি করতে হতো না বা বেচতে না পেরে ফুলকপিগুলো ফেলে দিতে হতো না। আর দুই মাস পর যখন বাজারে ফুলকপি থাকবে না, সেই সময় সংরক্ষণাগারে রাখা এই ফুলকপি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারতেন। শুধু তা–ই নয়, প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা ব্যবহার করে ফুলকপির নানা রকম খাবার তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতে পারতেন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বাজারে নানা রকমের মিশ্রিত সবজি ফ্রোজেন অবস্থায় পাওয়া যায়, যা মাসের পর মাস ভোক্তারা কিনে খেতে পারেন। 

ভৌত প্ল্যাটফর্মটি সম্মিলিতভাবে কৃষকদের মালিকানাধীন হতে হবে। কেন্দ্রটির মালিকানা কৃষকদের দর–কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। কারণ, কৃষকেরা বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এর ফলে বিভিন্ন স্তরের আড়তদারদের ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এতে করে বড় শহরগুলোতে অবস্থিত বৃহৎ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাঁদের একরকম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, যা কৃষক এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানিগুলোকে উদ্ভাবন করতে এবং খাদ্যের মান বাড়াতে বাধ্য করবে। এতে করে ভোক্তারা গুণগত মানসম্পন্ন খাবার খেতে পারবেন এবং তাঁরা কাছাকাছি স্থান থেকে পণ্য কিনতে উৎসাহিত হবেন। এভাবে যানবাহনের অতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন তা হ্রাস পাওয়া সম্ভব হবে। 

এটি কীভাবে কাজ করবে

১. উপজেলা স্টোরেজ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং সুবিধা তৈরি করা হবে, যেখানে কৃষকেরা তাঁদের ফসল/সবজি/ফল সংরক্ষণ করবেন; তাঁদের ফসল/সবজি/ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং প্যাকেজিং করবে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা ফসল/সবজি/ফল ধুয়ে, শুকিয়ে এবং প্যাকিং করতে পারবেন, মূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন এবং অন্যান্য স্থানে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করতে পারবে।

২. আউটলেট থেকে পণ্যের নিলামভিত্তিক বিপণন হবে। তাই এই কেন্দ্র থেকে ফসল, সবজি, মাছ ও হাঁস-মুরগি বিক্রি থেকে প্রাপ্ত লাভ সরাসরি কৃষকদের কাছে যাবে, যা তাঁরা স্টোরেজ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং সুবিধার রক্ষণাবেক্ষণ, অন্যান্য বাজারে পণ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য বিপণনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবেন। বিতরণব্যবস্থা কৃষকদের মালিকানাধীন হতে পারে অথবা প্রাথমিকভাবে একটি পৃথক কোম্পানি সরবরাহ পরিচালনা করতে পারে ধার্যকৃত মূল্যের ভিত্তিতে।

৩. কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের তথ্য, উৎপাদিত পণ্যের ছবি অ্যাপের মাধ্যমে ভার্চু৵য়াল প্ল্যাটফর্মে আপলোড করবেন। মুদিদোকান এই অ্যাপের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। ভোক্তারাও সরাসরি আউটলেটে গিয়ে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করতে পারবেন।

৪. আমরা জানি, যখন সরবরাহ প্রচুর থাকে, তখন উৎপাদকের দর–কষাকষির ক্ষমতা হ্রাস পায়। কারণ, ভোক্তাদের কাছে বিকল্পগুলো বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। কৃষি কর্মকর্তারা চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রতি মৌসুমে কৃষকদের নির্দিষ্ট ফসল বা শাকসবজি বা ফল উৎপাদনের পরামর্শ দিতে পারেন। এতে করে কোনো একটি বিশেষ ফসল চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদিত হবে না এবং কৃষকদের বিক্রি না হওয়া ফসল বা খাদ্য অল্প মূল্যে বিক্রি করতে হবে না। 

৫. এই প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ফসল, সবজি, ফল, হাঁস-মুরগি এবং মাছের বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহার করা। এই প্ল্যাটফর্ম খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সবুজ সার, সবুজ কীটনাশক, শক্তি, পুনর্ব্যবহার এবং বর্জ্য খাতে উদ্যোক্তা কার্যকলাপকে উৎসাহিত করতে পারে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বকেও উৎসাহিত করা যেতে পারে।

৬. এই প্ল্যাটফর্মটি সরকারি সংস্থা, গবেষণা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা সব ধরনের সংগঠিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে সমর্থন করবে, কৃষকদের সংগঠিত করবে এবং তাদের দর–কষাকষির ক্ষমতা প্রদান করবে। 

৭.  যদি এটি উপজেলা পর্যায়ে কাজ করে, তাহলে আমরা জেলা (জেলা) পর্যায়ে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারি, যাতে দ্রুত বাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করা যায়,  যেখান থেকে পণ্য অন্যান্য বাজারে পরিবহন করা যেতে পারে।

অনেক উন্নত দেশেই উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, যা উৎপাদক এবং গ্রাহকদের মধ্যে যোগাযোগে সহায়তা করে এবং বিভিন্ন অংশীজনের তথ্য, ধারণা এবং সম্পদ আদান–প্রদানে সাহায্য করে, উদ্যোক্তা গঠনের সুযোগ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, নীতিমালা ও নিয়মকানুন তৈরি করে,  যা কৃষকদের বা উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করে, উদ্যোক্তা কার্যক্রম সফল করার জন্য সহায়ক অবকাঠামো তৈরি করতে সাহায্য করে। বাংলাদেশ হয়তো উন্নত দেশ নয় এবং এর অনেক চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে, তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা সম্ভব, যা দরিদ্র কৃষকের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে।

ড. সাবরিনা লুৎফা জ্যেষ্ঠ প্রভাষক  ইউনিভার্সিটি ওয়েস্ট, সুইডেন

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল প ল য টফর ম আম দ র দ শ স হ য য কর র ব যবহ র র উৎপ দ ত র র জন য ন র জন য অন য ন য ক ষকদ র র ক ষমত ব যবস থ সরবর হ বর জ য ধরন র ফ লকপ সরক র অবস থ ম নসম র একট ত করত

এছাড়াও পড়ুন:

ওরা কারা বসন্ত আটকে দিতে চায়!

শীত চলে গেলেও কুয়াশা কাটে না। কেননা ওরা বসন্ত আটকে দিতে চায়। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘কথিত আন্দোলন আর মবের মহড়া আমরা এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করব। রাষ্ট্রকে অকার্যকর এবং ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না’ (সমকাল)। ‘তৌহিদি জনতার’ উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাইলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট (গণ্য) করা হবে।’ তাঁর এ বিবৃতি যেন কথার কথা না হয়।

মব হলো একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। আমার কাছে ঘটনাগুলো মব মনে হয় না, এটি আমার কাছে পরিকল্পিত প্রতিক্রিয়াই মনে হয়। প্রথম যেসব ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, তা সরকার নাই অবস্থায় হয়েছে, সত্য। তা কি শুধু শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার প্রতি ঘৃণা থেকে হয়েছে? মেহেরপুরে যাদের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, তারা শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনা ছিলেন না– এটা সবারই জানা। এই সেদিনও সুনামগঞ্জের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, কৃষক স্বৈরাচার বা শেখ হাসিনা নন, এটাও সবার জানা।

তাই আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যারা ভাঙছে তারা বৈষম্যে বিশ্বাসী। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে অবিশ্বাসী। তারা সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বহু ইসলামী পরিচয়ধারী দেশে ভাস্কর্য আছে, তা জানা সত্ত্বেও ভাস্কর্য ভাঙাকেই নিজেদের ধর্মীয় পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকেই নিজেদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। অগ্রসর মানুষ তাদের ডেভিল মনে করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়ায় ওই ডেভিলদের মোকাবিলা করা।

সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্রিয়াশীল থাকার সময়ই একের পর এক মাজারে হামলা হয়েছে। যারা হামলা করেছে তারা জানে মাজারে শেখ হাসিনা নেই বা কোনো স্বৈরাচারের দোসর সেখানে নেই। কোনো ব্যাংক লুটের টাকা সেখানে নেই। নির্মমভাবে পিটিয়ে সিলেটের মাজারে যে গরিব মানুষগুলোকে হত্যা করা হলো, তাদের বাড়িঘর পর্যন্ত নেই। চারদিন লাশ মর্গে পড়ে থাকল, তাদের দাফন করার কোনো লোক পর্যন্ত নেই। রাষ্ট্রশাসকদের চোখের সামনে এসব গরিব মানুষ হত্যা এবং উপর্যুপরি মাজারে হামলার পরেও তাদের গায়ে কোনো আঁচড় পড়ল না! আমাকে কেন বিশ্বাস করতে হবে রাষ্ট্র-সরকার ধর্মীয় বৈচিত্র্য রক্ষা করতে চায়? গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে? বহুত্ববাদে বিশ্বাস করে?

নারী খেলোয়াড়দের ওপর আক্রমণ এবং তাদের খেলা প্রতিরোধ করা হলো। বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় পুলিশের সামনে আক্রমণ এবং বইয়ের স্টল বন্ধের ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করেছে। আমাকে কেন বিশ্বাস করতে হবে এক স্বৈরাচারকে জনতা উচ্ছেদ করার পর যে সরকার তৈরি হলো, তাদের ছায়াপথে আমাদের নিকষ অন্ধকার গর্তে ঢুকে যেতে হবে না? গায়ের জোর দেখালে আপনাকে ডবল স্বৈরাচার ডবল ফ্যাসিবাদ মনে করব না কেন? পাহাড়ে এবং সমতলে সর্বত্র সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষার স্বাধীনতা নেই, ভূমির অধিকার নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। কেন?
আগের স্বৈরাচারীরা ব্যাংক লুট করেছে, কারও বাড়িঘর লুটপাট করেনি। আজ তো বাড়িঘর লুটপাট চলছে। এটা মানব কেন? গাজীপুরের নেতা এবং সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অপরাধ দেখলে তাঁর নামে ৫০টি মামলা করতে পারে, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে, বিচার করে ফাঁসি দিতে পারে, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু গভীর রাতে তাঁর বাড়ি লুট করতে পারে কি? তাঁর অপরাধের জন্য তাঁর পুত্র-পুত্রবধূর সঙ্গে প্রতিবেশীকে দায় দেওয়া, শাস্তি দেওয়া– কোন গণতন্ত্রে পড়ে? আবার সেখানে গণপ্রতিরোধের অপরাধে শত শত সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করে সেই আগের সরকারের মতোই পুলিশি রাজত্ব, পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালু মানা যায় কি?

আগের সরকার শ্রমিকরা পাওনা মজুরির জন্য আন্দোলন করলে তাকে বিদেশি চক্রান্ত বলে শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করেছে। এখনকার সরকারও হুবহু একই কাজ করছে। আজ পর্যন্ত বেতন দেয়নি বলে একজন মালিককেও কোথাও কোনো ধমক সরকার দিয়েছে বলে দেখিনি। অথচ এখনও মধ্যরাত পর্যন্ত শ্রমিকদের থানার পুলিশ, শিল্প পুলিশের যৌথ বাহিনী মোকাবিলা করতে হয়। তবুও কেন এই সরকারকেই সমর্থন করে যাব? শিক্ষকদের ওপর আগের সরকারও বর্বর কায়দায় জলকামান, রায়টকার ব্যবহার করত, এখনকার সরকারও তা-ই করছে। এই সরকার তৈরির প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের জন্য দ্রোহযাত্রা করেছি। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে– গণতন্ত্র তুমি কোথায়? তুমি কেন প্রেস ক্লাবে আসো না? মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তুমি কেন বইমেলায় আসো না?

বিধান জারি হলো, তারুণ্যকে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করলে প্রতিহত করা হবে। বসন্ত বরণ করা যাবে না। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে চলতে পারবে না। আমার চোখে আজও ভাসছে ৫ আগস্ট ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বিশাল মিছিল করে শেখ হাসিনার পতন ঘটাচ্ছে। সেদিন বনানীর ওভারব্রিজে যারা ছিল তারা সাক্ষ্য দেবে, যুবক-যুবতী, বোরকা পরা অনেক মেয়ে, জিনস প্যান্ট পরা অনেক মেয়ে ছেলেদের সঙ্গেই মিছিল করে শেখ হাসিনাকে নামিয়েছে। আজ কেন একসঙ্গে বসন্তবরণ কিংবা ভালোবাসা দিবস উদযাপন কিংবা এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দিবস পালন করতে পারবে না? 
সরকারকে এসব বিষয়ে শুধু বক্তব্য স্পষ্ট নয়, দৃঢ় অবস্থান নিতেই হবে। নইলে আমরাও বলতে বাধ্য হবো– ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার।’

জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন

সম্পর্কিত নিবন্ধ