মাতৃভাষাকে আমরা মাত্-তৃ-ভাশা উচ্চারণ না করি
Published: 15th, February 2025 GMT
পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। ভাষার মধ্য দিয়ে জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মাণ হয়। অনেক শব্দ আছে, যেগুলোর ইংরেজি বানান একই রকম হলেও ভৌগোলিক অবস্থান বা উৎপত্তিগত কারণে উচ্চারণগত বা আবেদনগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। একটি শব্দ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন পদ্মা, যার ইংরেজি ‘Padma’.
আরেকটি শব্দ, যেমন একটি ফুটবল ক্লাব নিয়ে বলা যেতে পারে ‘Real Madrid’। এর স্বাভাবিক উচ্চারণ যদি আমরা বলি ‘রিয়াল মাদ্রিদ’ তাহলে আপাতত মনে হবে ঠিক আছে। কিন্তু তা না, ‘Real’ একটি স্প্যানিশ শব্দ, যেটি দ্বারা বুঝানো হয় ‘Royal’ এবং এর উচ্চারণ হলো রেয়াল। আমরা রেয়াল না বলে রিয়েল বললে তাঁদের কাছেও শ্রুতিকটু লাগে। তাই ভাষার প্রমিত উচ্চারণ না করলে ভাষার মাধুর্য হারিয়ে যায়। শুনতে খুব বিদঘুটে লাগে।
আমরা আমাদের ভাষার বিষয়ে অনেকাংশেই সচেতন নই। তাই যাঁরা জানেন, তাঁদের সামনে ভুল উচ্চারিত হলে বিব্রত অনুভূত হন। ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে বা ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার মানুষ নিবেদিতচিত্তে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, অথচ আমরা এই ভাষা ব্যবহারে সচেতন নই। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আমরা ভাষার প্রতি কতটুকু যত্নশীল, তা কিছু শব্দের উচ্চারণের দিকে লক্ষ করলেই উপলব্ধি করতে পারব। বহুল প্রচলিত একটি শব্দ ‘মাতৃভাষা’, যা অনেকে উচ্চারণ করেন মাত্-তৃ-ভাশা, যা ভুল। কারণ ঋ-কার যুক্ত ব্যঞ্জন কখনো দ্বিত্ব উচ্চারণ হয় না। তাই উচ্চারণ হবে মা-তৃ-ভাশা। ‘সবাইকে অনুগ্রহ করে বলতে চাই, মাতৃভাষাকে আমরা মাত্-তৃ-ভাশা উচ্চারণ না করি।’ অনুরূপ মাতৃত্ব–এর উচ্চারণ মাত্-তৃত্-তো না হয়ে হবে মা-তৃত্-তো, নেতৃত্ব–এর উচ্চারণ নেত্-তৃত্-তো না হয়ে হবে নে-তৃত্-তো।
বিচলিত হচ্ছেন, তাহলে পরিচিত একটি শব্দ বলি যে শব্দটির উচ্চারণ সবার জানা। ‘আবৃত্তি’–এর প্রমিত উচ্চারণ আব্-বৃত্-তি নাকি আব্-বৃত্-তি। আপনারা সবাই জানেন আ-বৃত্-তি ঠিক। ওপরের নিয়ম এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে। আরও কিছু শব্দ যেমন প্রকৃতি-এর উচ্চারণ প্রক্-কৃতি না হয়ে হবে প্রো-কৃতি, আকৃষ্ট-এর উচ্চারণ আক্-কৃশ্-টো না হয়ে হবে আ-কৃশ্-টো। তবে ভয়ংকর একটি বিষয় হলো, উচ্চারণ প্রমিত না হলে অর্থের পরিবর্তন ঘটে যায়। যেমন বিকৃত একটি শব্দ, এর উচ্চারণ বি-কৃ-তো। কিন্তু আমরা অনেকে উচ্চারণ করছি বিক্-ক্রি-তো, যার অর্থ হয়ে যায় বিক্রয় করা হয়েছে। আবার নিত্য একটি শব্দ, এর উচ্চারণ নিত্-তো এবং এর অর্থ হলো প্রত্যহ। আরেকটি শব্দ ‘নৃত্য’ এর উচ্চারণ হলো নৃত্-তো এবং এর অর্থ হলো নাচ। কিন্তু আমরা ‘নৃত্য পরিবেশন’ উচ্চারণ করি নিত্-তো পোরিবেশন, যার অর্থ হয়ে যায় প্রত্যহ পরিবেশন। সতর্ক না হওয়ার কারণে আমরা কী বলছি, একবারও কি চিন্তা করছি! প্রায়ই আমরা শব্দের ভুল উচ্চারণ করি। যেমন আহ্বান–কে আমরা আহ্-বান উচ্চারণ করি জিহ্বা কে আমরা জিহ্-বা উচ্চারণ করি, যা ভুল। কারণ, শব্দের আদিতে অ বা আ উচ্চারিত হলে এবং উক্ত শব্দে হ এর সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত থাকলে সেই হ–এর পরিবর্তে ও এবং ব–এর পরিবর্তে ভ উচ্চারিত হয়। তাই আহ্বান এর উচ্চারণ হবে আও্-ভান্, গহ্বর এর উচ্চারণ হবে গও্-ভর্। তবে শব্দের আদিতে ই উচ্চারিত হলে হ–এর পরিবর্তে উ এবং ব–এর পরিবর্তে ভ উচ্চারিত হবে। তাই জিহ্বা এর উচ্চারণ হবে জিউ্-ভা এবং বিহ্বল এর উচ্চারণ হবে বিউ্-ভল্। দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে, তাহলে স্বাভাবিক শব্দ নিয়ে বলা যাক।
কেউ কেউ মজার ছলে বলে থাকেন, বাংলা ভাষা আহত হয়েছে চট্টগ্রামে আর নিহত হয়েছে সিলেটে। চট্টগ্রাম ও সিলেট ঠিক উচ্চারণ করলেও ঝামেলা করে ফেলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর ও আমের নগরী রাজশাহী উচ্চারণে। অবচেতন মনে রাজ্-শাহিকে আমরা উচ্চারণ করি রাশ্-শাহি তা–ই নয় কি? হায় রে কত ভুল, আমরা নিজেরাই জানি না। ভাষার প্রমিত উচ্চারণের জন্য আরেকটি বিষয় জানা দরকার, তা হলো ধ্বনি ও বর্ণের পার্থক্য। ব্যঞ্জন বর্ণ ৩৯টি হলেও ব্যঞ্জনধ্বনি কিন্তু ৩৯টি নয়, মাত্র ৩১টি; অর্থাৎ ৮টি বর্ণ আছে, যাদের কোনো নিজস্ব উচ্চারণ বা ধ্বনি নেই। যেমন- ‘ঃ’ বিসর্গ একটি বর্ণ, এটি ধ্বনি নয়। এটি শব্দের শেষে বসলে এর উচ্চারণ হয় ‘হ’, আর মাঝখানে বসলে পরবর্তী ব্যঞ্জন দ্বিত্ব হয়। বাঃ-এর উচ্চারণ বাহ্, আঃ-এর উচ্চারণ আহ্। অতঃপর-এর উচ্চারণ অতোপ্-পর্, মনঃকষ্ট-এর উচ্চারণ মনোক্-কশ্-টো।
আবার আমরা জানি, ব্যঞ্জনবর্ণে ফলা ছয়টি। এই ছয়টি ফলা শব্দের অবস্থান অনুসারে কখনো উচ্চারিত হয়, কখনো হয় না, আবার কখনো যুক্ত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন: স্বাধীন-এর উচ্চারণ শা-ধিন্, শ্মশান-এর উচ্চারণ শ-শান্। কিন্তু ব-ফলা ও র-ফলা মাঝখানে থাকলে দ্বিত্ব হয়। অদ্বিতীয়-এর উচ্চারণ অ-দি-তি-য়ো না হয়ে হবে অদ্-দি-তি-য়ো, দেশপ্রেম-এর উচ্চারণ দেশ্-প্রেম না হয়ে হবে দেশোপ্-প্রেম্। একত্রিশ-এর উচ্চারণ এক-ত্রিশ না হয়ে হবে একোত্-ত্রিশ্। খটকা লাগছে, তাহলে পরিচিত শব্দ বলি—বিদ্রোহ। এর উচ্চারণ কি বি-দ্রো-হো নাকি বিদ্-দ্রো-হো। সবাই জানেন বিদ্-দ্রো-হো, কারণ এখানে মাঝখানে র-ফলা আছে, যার কারণে দ্বিত্ব হয়েছে।
হ-এর সঙ্গে ন/ ণ যুক্ত হলে আমরা তখনো উচ্চারণে ভুল করি। হ-এর সঙ্গে ন/ ণ যুক্ত হলে আমরা অনেকে হ-কে বিলুপ্ত করে দিয়ে ন-এর দ্বিত্ব উচ্চারণ করি যেমন চিহ্ন-এর উচ্চারণ করি চিন্-নো,অপরাহ্ণ-এর উচ্চারণ করি অপ-রান্-নো। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, হ-এর সঙ্গে ন/ ণ যুক্ত হলে কখনোই হ বিলুপ্ত হবে না; বরং ন/ ণ–এর উচ্চারণ আগে হবে, তারপর হ-এর উচ্চারণ হবে; অর্থাৎ চিহ্ন-এর উচ্চারণ হবে চিন্-হো এবং অপরাহ্ণ -এর উচ্চারণ হবে অপ-রান্-হো। আমরা প্রতিদিন অসচেতনতার কারণে কিছু অঙ্কের ভুল উচ্চারণ করি। যেমন-চারটা কে আমরা চাট্-টা, সাতটা কে আমরা সাট্-টা উচ্চারণ করে থাকি, যা মারাত্মক ভুল। এই উচ্চারণের ছলে আমরা একটি স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছি। একটি ব্যঞ্জন বিলুপ্ত হলে অর্থ হারানোর পাশাপাশি কতটা বিদঘুটে লাগে। তার উদাহরণ হলো পাঁচটাকে যদি আমরা পাট্-টা উচ্চারণ করি। পাঁচটার প্রমিত উচ্চারণ পাঁচ্-টা, অনুরূপ চারটার উচ্চারণ চার্-টা এবং সাতটার উচ্চারণ সাত্-টা। আমরা চারটা থেকে র এবং সাতটা থেকে ত বাদ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারব না। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাহলে চলুন উচ্চারণ করে দেখি। প্রয়োজনে রেকর্ড করে দেখতে পারেন আপনার ভুল হচ্ছে না তো? একটু বিদ্যুৎ–সংযোগের ফলে লাইট বা বাল্ব থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়, ঠিক তেমনি আমরা আমাদের মাতৃভাষা প্রয়োগ ও প্রমিত উচ্চারণের প্রতি একটু সচেতন হলে ভাষাটি গৌরব ও মর্যাদায় মহীয়ান হয়ে থাকবে। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়’ না, কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যেই ভাষার জন্য বাংলার মানুষ সেই ভাষাকে আমরা বিকৃত করে ভাষাশহীদদের কলঙ্কিত করতে পারি না। মাতৃভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে আমরা কি একটু চাইলে পারি না প্রমিত ভাষায় কথা বলতে? নিশ্চয়ই পারি, নিশ্চয়ই আপনিও পারেন।
লেখক: এস এম মতিউর রহমান, জনসংযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
আজও গোবিন্দগঞ্জে যানবাহনের ধীরগতি
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গোবিন্দগঞ্জের চার রাস্তা মোড়ে শনিবার দিনভরই থেমে থেমে যানজট ও ধীরগতি দেখা গেছে। সওজের সাসেক প্রকল্পের নির্মাণ কাজের পাশাপাশি ঢাকা-উত্তরাঞ্চলগামী দূর ও স্বল্পপাল্লার বাস থেকে যাত্রী যত্রতত্র উঠা-নামায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সেনাবাহিনী, ট্র্যাফিক ও হাইওয়ে পুলিশসহ আনসার সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছেন। তবে পরিবহন চালকরা নিয়ম না মেনে যাত্রী উঠা-নামা করায় কৃত্রিম যানজট ও ধীরগতির সৃষ্টি হচ্ছে।
গোবিন্দগঞ্জ চার রাস্তা মোড়ে পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত ইন্সপেক্টর ওসমান আলী জানান, সওজের কাজের কারণে রাস্তায় এমনিতেই সরু। তার ওপর যত্রতত্র যানবাহন থেকে যাত্রী উঠা-নামায় অল্প সময়ের জন্য যানবাহনের ধীরগতি হলেও শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। দীর্ঘ সময়ের জন্য কোনো ধরনের যানজট ধীরগতি সৃষ্টি করতে দেওয়া হচ্ছে না।
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে রংপুর পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার মহাসড়কে গত সাড়ে আট বছর থেকে সওজের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২) প্রকল্পের কাজ চলছে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় গাইবান্ধার পলাশবাড়ি ও গোবিন্দগঞ্জ মোড়ে এখনও কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এতে ঈদের আগে এই দুই স্থানেই বেশি জটলা বাঁধছে।
সওজের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২) প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, সাড়ে আট বছর আগে কাজ শুরু হলেও মূলত জোরেশোরে শুরু হয় করোনা শেষে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ভূমি অধিগ্রহণ কাজের জটিলতার জন্য গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ীতে কাজ শুরু করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ইনশাল্লাহ পুরো কাজ হবে। আগামী বছর থেকে চার রাস্তা সম্প্রসারণ সুফল উত্তরাঞ্চলবাসীর পুরোপুরি ভোগ করতে পারবে।
গাইবান্ধা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিয়াস কুমার সেন বলেন, হাইওয়ের কাজ করছে সাসেক-২ প্রকল্প। তাদের কাজ এখনও চলমান। আমাদের কাছে সড়ক বুঝিয়ে দেওয়ার পর রাস্তার পাশের অবৈধ স্থাপনাসহ সড়কের সার্বিক দেখভাল করবে গাইবান্ধা সড়ক বিভাগ।
বগুড়া রিজিয়ন হাইওয়ে পুলিশের এসপি (অতিরিক্ত ডিআইজি পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ঢাকা রংপুর মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ-বগুড়া অংশে শনিবার দুপুর পর্যন্ত যানজট হয়নি। বরং ঢাকা-উত্তরাঞ্চলগামী যানবাহন দুই লেন দিয়েই স্বাভাবিকভাবে চলছে।