লামিনে ইয়ামাল মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ফুটবলের বর্তমান। যখনই মাঠে নামছেন, পায়ের ঝলকানিতে মন্ত্রমুগ্ধ করছেন সবাইকে। তাঁর পায়ে বল মানেই জাদুকরী কিছুর সম্ভাবনা। তবে বার্সেলোনা ও স্পেনের হয়ে তাঁর যাত্রাটা মাত্র শুরু হলো।

এখনো পাড়ি দেওয়া বাকি অনেক লম্বা পথ। তবে ইয়ামালের এই পথচলাটা ভিন্ন রকমও হতে পারত, যদি ১০ বছর আগে একটি ই–মেইল চালাচালির ঘটনা না ঘটত। হ্যাঁ, বলা যায় একটি ই–মেইল বার্তা বদলে দিয়েছে ইয়ামালের পথচলার গতিপথ।

২০১৫ সালে ইয়ামালের বয়স যখন সাত বছর, তখনই তিনি খেলা শুরু করেছিলেন লা তোরেতার হয়ে। এখানে খেলার সময় মূলত বার্সেলোনা অনূর্ধ্ব-১০ দলের সমন্বয়ক ও স্কাউট অস্কার হার্নান্দেজের নজরে পড়েন ইয়ামাল। বার্সার একই কর্মকর্তা বুঝতে পেরেছিলেন, ইয়ামালের মধ্যে দারুণ কিছু আছে। ফলে স্প্যানিশ শিশুটিকে দেখেই মনে ধরে যায় তাঁর। কিন্তু এরপরই বাঁধে বিপত্তি।

আরও পড়ুনইয়ামাল যেভাবে ‘মেসি ২.

০’ ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

যে সময়ে ইয়ামালের খেলায় হার্নান্দেজ মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিলেন, তখনই তৈরি হয় স্প্যাানিশ শিশুটির এস্পানিওলে যাওয়ার সম্ভাবনা। লা তোরেতার সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি সম্পাদনে অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিল বার্সার নগর প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে বার্সার সামনে অপেক্ষা করার আর কোনো সুযোগ ছিল না।

ব্যালন ডি’অরে কোপা ট্রফি জেতা ইয়ামাল

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়লেই মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়বে না

আমাদের বিকাশের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা শিক্ষার নিম্নমান। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের ভাবতে হচ্ছে, আমরা কি অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ শ্রমশক্তির ওপর ভর করেই চলব? এমনকি আমাদের দেশের ভালো ব্যবস্থাপকের কাজও কি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের কাছে চলে যাবে? 

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অভিমুখে যাত্রা করছে বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম থাকবে দেশের। তবে সে পথ যে খুব বেশি মসৃণ হবে না, তা বোঝা যায় শিক্ষার মান ও শিক্ষায় বিনিয়োগের মাত্রা দেখে। 

শিক্ষার পরিবেশ বিচারে সাক্ষরতার হার আর মানসম্পন্ন শিক্ষা ভিন্ন বিষয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, সাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ৯, ১৯৭১ সালে যা ছিল ১৬ দশমিক ৮। অর্থাৎ দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। শিক্ষায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশই এখন কর্মক্ষম। এ কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে দরকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা

দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও মানসম্পন্ন শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কম। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম বারবার পরিবর্তন। তৃতীয়ত, একমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাব। চতুর্থত, শিক্ষা প্রশাসনে ন্যূনতম জবাবদিহির অভাব। শিক্ষকদের দুষ্ট রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার। 

ইউনেসকোর পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে বরাদ্দ ১২ শতাংশের ওপর উঠছে না। জিডিপির বিপরীতে এ খাতে বরাদ্দ ক্রমেই কমছে। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। 

উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া দেশগুলো মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে কোনো আপস করেনি। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি। 

বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম হওয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন হচ্ছে না, তেমনি বেহাল কারিকুলামের। বারবার পরিবর্তন হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বিশ্বসেরার তালিকায় নাম লেখাতে পারে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা শক্তিশালী হয়। বিনিয়োগ কম ও কর্তাব্যক্তিদের উৎসাহের অভাব থাকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অনেক পিছিয়ে। 

দেশের শিক্ষা খাতে সিংহভাগ ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে ব্যয় হয় যৎসামান্যই। কিছুটা থাকলেও গবেষণায় নিবেদিত লোক পাওয়া যায় না। বিশ্বব্যাপীই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল ভালোভাবে ও পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারাই উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছে। 

বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে আরও প্রায় এক যুগ আগে, অর্থাৎ ২০১২ সালে। ২০৪০ সালে আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। তবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা শেষ হবে ২০৫০ সালে। 

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশই এখন কর্মক্ষম। এ কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে দরকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা। 

এ জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়াতে হবে। শুধু সাক্ষরতার হার বাড়ালেই হবে না; মানসম্মত ও কর্মমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। 

কর্মক্ষম প্রত্যেক মানুষের জন্য আনুষ্ঠানিক খাত অথবা অনানুষ্ঠানিক খাতে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

এদিকে শিক্ষায় বারবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কারণে আমরা আন্তর্জাতিক মান থেকেও পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রাথমিক পর্যায়ে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। দেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে অন্তত ১১ ধরনের। ধরনভেদে প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমেও রয়েছে ভিন্নতা।

স্বাধীনতার এত বছর পরও ইংরেজি, বাংলা আর মাদ্রাসাশিক্ষার মধ্যে আমরা ন্যূনতম সমন্বয় সাধন করতে পারিনি। অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো আমাদের দেশেও জিডিপির তুলনায় শিক্ষা খাতে স্বল্প বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি নিয়ে অনেকেই নিয়মিতভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। তাঁরা এখানে যথার্থই বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলেন। 

স্বল্প রাজস্ব আয়ের দেশে এটা তো অবশ্যই বিরাট সমস্যা। তবে এটাও বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, বরাদ্দের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বরাদ্দের টাকার গুণগত ব্যবহার এবং ব্যবহারে ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ। শিক্ষা খাত যেখানে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে বিবেচিত হয়, সেই জাতি তার অগ্রগতিকে বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ