সরকার যদি বিবৃতি দিয়েই যায়, কাজটা করবে কে
Published: 15th, February 2025 GMT
এবার মৌসুমের শুরুতেই বোরোর আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা। বোরোর ফলন নির্ভর করে সেচের ওপর, এবারে তাঁরা সেচটা ঠিকমতো দিতে পারবেন কি না, তা নিয়েই এই দুশ্চিন্তা।
তিন মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটানোর আগাম প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা কিছু স্বল্পমেয়াদি, কিছু মধ্যমেয়াদি ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে জ্বালানি পরিস্থিতি উন্নতি করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি, গ্রীষ্ম মৌসুমে, সেচের মৌসুমে বড় ধরনের ঘাটতি হবে না।’
গত সপ্তাহে বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়া এলএনজির আমদানি বাড়িয়ে এবারের গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। এরপরও উপদেষ্টা মনে করছেন, দৈনিক ৭০০ থেকে ১৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা লাগতে পারে।
ধরে নিই, বোরোয় সেচের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে সরকার অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু তারপরও কেন সেচ নিয়ে কৃষকের এমন দুশ্চিন্তা?
এ প্রশ্নের একটা উত্তর মিলবে ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারার ‘আমনে পাস হয়নি, বোরোতেও কি ফেল হবে’ শিরোনামের লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘সিংহভাগ সেচব্যবস্থা চলে সমবায় উদ্যোগে নানা কিছিমের সমিতির মাধ্যমে। এগুলো সংগঠিত করতে, চালাতে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী স্থানীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ লাগে। অধিকাংশ আশীর্বাদদাতার হালহকিকত আগের মতো নেই। ইতিমধ্যেই “এবার আমরা খাব” গোষ্ঠী বেরিয়ে পড়েছে যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী।’
এই যে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছাড়া কৃষক যে সেচ পান না, তার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্র বলি, আর সরকার বলি, বাংলাদেশের বিরাট অংশজুড়ে তার অস্তিত্ব প্রায় খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্র কিংবা সরকারের সম্পর্ক এখানে সরাসরি নয়। মাঝখানে কায়েমি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ধরেই তাদের রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছাতে হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক গবেষক আরাইল্ড এঙ্গেলসন রুড বাংলাদেশের সমাজের এই ধরনকে বলেছেন নেটওয়ার্ক সমাজ। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলছেন, ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্র দুর্বল। প্রশাসনিক যন্ত্র হিসেবেও রাষ্ট্র দুর্বল। দেশের বড় অংশে কার্যত রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। গ্রামীণ পর্যায়ে আপনি এমন কাউকে ভোট দেন, যিনি প্রয়োজনে আপনাকে রক্ষা করবেন। এমন কাউকে, যিনি শক্তিশালী, যাঁর সংযোগ আছে, যিনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আপনার যদি পুলিশ, প্রতিবেশী বা প্রশাসনের সঙ্গে সমস্যা হয়, আপনি স্থানীয় নেতার কাছে যাবেন। সেই নেতা যেতে পারেন একজন মধ্যপর্যায়ের নেতার কাছে। সেই নেতা আবার যেতে পারেন এমপির কাছে। তারপর আপনি আপনার সমস্যা সমাধান করতে পারেন’ (বাংলাদেশে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন হবে, প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪)।
বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির এই সরল সমীকরণ পাঠ করা না গেলে যেকোনো পরিবর্তনের আলোচনাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কার্ল মার্ক্স ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষের সমাজের স্থবিরতার পেছনে এখানকার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামভিত্তিক সমাজকে দায়ী করেছিলেন। একেকটা গ্রামই একেকটা বিচ্ছিন্ন দেশ। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল রাজধানীতে। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের এই যে বিচ্ছিন্নতা কিংবা ব্যবধান, সেখান থেকে আমরা কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ এমন একটা দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে সারা দেশ থেকে সম্পদ এনে ঢাকাকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসা থেকে শুরু করে সুই কেনা—সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। এখানেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রবলভাবে বিরাজ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র যেখানে প্রবলভাবে অস্তিত্বশীল থাকার কথা, সেই ঢাকাতেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের অস্তিত্ব কি আমরা খুঁজে পাচ্ছি? বলা চলে, সেই শূন্যস্থানে প্রবল প্রতাপে বিরাজ করছে ‘মবতন্ত্র’।
দুই.সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। হাওয়ার বেগে সেসব পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে। উত্তেজিত জনতা ভার্চ্যুয়াল জগৎ থেকে নেমে আসছে রাস্তায়। শুরু হয়ে যাচ্ছে ভাঙচুর বা হামলার ঘটনা।
একের পর এক মাজার ভাঙা হলো। কোথাও কিছুই ঠেকানো যাচ্ছে না, হচ্ছে না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নিন্দা জানিয়ে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে একের পর এক বিবৃতি আসছে। বিবৃতিনির্ভর এই নিষ্ক্রিয়তা বড় করেই প্রশ্ন তৈরি করছে, সরকার কি এনজিও বা নাগরিক সংগঠন? নিন্দা জানিয়ে সরকার যদি বিবৃতি দেয়, তাহলে পদক্ষেপটা নেবে কে?
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পেরিয়েছি। জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র ও সরকারে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসন, লুটপাট, দুর্নীতি ও অপরাধে সমাজের বিশাল অংশের মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ ছিল, তাতে প্রতিশোধ অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ছয় মাস পরে এসে ‘মবতন্ত্র’ কোথাও কোথাও যেভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে, তার ব্যাখ্যা কী?
এখানে সরকারের নীতিকেই প্রধানভাবে দায়ী করতে হবে। কেননা, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী অংশ বাদে অভ্যুত্থানের পক্ষে রাস্তায় নেমে আসেনি কিংবা অভ্যুত্থানকে সমর্থন দেননি—এমন মানুষ বিরল। বিশেষ করে যাঁদের বয়স ৩০-এর মধ্যে, তাঁদের মা–বাবা ও পরিবারের বয়স্করা কোন দলের সমর্থক, সেটা বিবেচনা তাঁরা করেননি। বুলেটের সামনে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, দলনির্বিশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের জনসমর্থন ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে কোনো কোনো পক্ষ নিজেদের অতি ক্ষমতায়িত গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হলো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠল ঘৃণাচর্চা, আর যাকে–তাকে ধরে ট্যাগ দেওয়ার জায়গা। অভ্যুত্থানের সামনের কাতারের মুখগুলোও হরেদরে আক্রান্ত হতে লাগল। শুধু ভার্চ্যুয়াল জগতে নয়, বাস্তবেও ভিন্নমতের মানুষেরা আক্রান্ত হলেন। পাঠ্যবইয়ে ঠাঁই পাওয়া গ্রাফিতিতে আদিবাসী থাকায় সেটা বাদ দেওয়ার দাবি জানানো হলো। এনসিটিবি কোনো নিয়ম–পদ্ধতিতে না গিয়ে সেটা বাদ দিল। আদিবাসী শিক্ষার্থী ও বামপন্থী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে তাঁরা আক্রান্ত হলেন। ঘোষণা দিয়েই তাঁদের পেটানো হলো। নানাভাবে আক্রান্ত হতে থাকলেন নারীরা। মেয়েদের ফুটবল খেলাতেও বাধার ঘটনা আমরা দেখলাম।
ভারতে পালিয়ে যাওয়া পতিত স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার ভার্চ্যুয়াল বক্তব্য দেওয়ার ক্ষোভে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা হলো। বুলডোজার এল কোত্থেকে সেটিও আমরা জানলাম। আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়িঘর ভাঙা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ম্যুরাল, ভাস্কর্যও ভাঙা হলো। কৃষকভাস্কর্যও ভাঙা হলো। কাউকে কোথাও থামানো হলো না। থামানোর চেষ্টা করা হলো না। ভাঙাভাঙির পর বিবৃতি এল। এখানেই থেমে থাকল না। ঘোষণা দিয়ে বইমেলায় মানুষ জড়ো করা হলো, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি জানালেন কিছু শিক্ষার্থী।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় নানাভাবে উসকানি তৈরি করছেন। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রও আছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক লাভ–লোকসানের সমীকরণ থেকেই নেওয়া জরুরি। রাজনীতিতে একটি ভুল সিদ্ধান্ত রিপেল ইফেক্টের মতো আরও অনেক ভুলের জন্ম দিতে বাধ্য।
তিন.একটি বিষয় বেশ প্রবলভাবে চোখে পড়ছে। পুলিশ যে সব ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়, তা তো নয়। শিক্ষার্থীদের পেটানো, ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের সড়ক থেকে সরাতে তারা আগের আমলের মতোই পারদর্শিতা দেখিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে যেভাবে সন্তান কোলে থাকা শিক্ষক মায়েদের দিকে জলকামান থেকে পানি ছুড়েছে, সেটা আমাদের পুরোনো আমলের স্মৃতিকেই জাগিয়েছে।
মানুষ চায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রকৃতপক্ষে সরকার হিসাবে ক্রিয়াশীল হোক। এভাবে বিবৃতি দিয়ে তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তার জন্য দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস থ সরক র র ক ষমত আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই হতে হবে
এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়, সংস্কার চায় না। তাদের মনে রাখা উচিত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল ক্ষমতার পালাবদলের জন্য হয়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো সংস্কার এবং নির্বাচন দুটিই হতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নিজেদের স্বার্থে রাজনীতি করেছে। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। এ ধারার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ শীর্ষক একটি অধিবেশনে এসব কথা বলেন বক্তারা। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আছে। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রবিধান সংযুক্ত করা হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করে তোলার ওপর। বিগত সরকারের সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরমভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়, যা প্রধানমন্ত্রীকে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ধারার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য সংবিধানে বিশেষ অনুচ্ছেদ যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আলী রীয়াজ আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থাকে কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ বলেন। আদতে এটা বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব হলে বিভিন্ন কমিশন গঠন করার দরকার হতো না। তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে তারা কতটুকু গ্রহণ করবে।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অতীতের ক্ষমতার চর্চা ছিল অর্থের ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। আদর্শের চর্চার প্রভাব খুব একটা ছিল না। জাতীয় সংসদের প্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত সবাইকে এ ধারায় চলতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ চলে গেলেও সেই টাকার প্রভাবের শূন্যতা পূরণ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা এবং সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে।
অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, সবাই সংস্কার চান। তবে কী সংস্কার চান, তা সুস্পষ্ট করা উচিত। সংস্কার কেবল আইনের পরিবর্তনের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। আইন অনেক আছে। সমস্যা রাজনৈতিক চর্চার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেকগুলো সংস্কারের জন্য কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেক সংস্কার প্রস্তাবও এসেছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবের অনেকগুলো আইন পরিবর্তনের জন্য। সত্যিকার অর্থে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইলে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তনের জন্য অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার ব্যবস্থাকেও রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখার চর্চাও দেখা গেছে। প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে– ‘দিন বদলের’ কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। কীভাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করবে, রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি রাখবে।
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিগত সরকারের সময়ও অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই কথা শোনার বা শুনে তা আমলে নিয়ে কাজ করা হয়নি। সংবিধান সংশোধনের কথা হচ্ছে। এটা করতে হলে তা কীভাবে যুগোপযোগী হয়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
৫৩ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি এবং এ কারণে নব্বই বা চব্বিশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বলে মত দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গভীরে বৈষম্য রয়ে গেছে। মানুষ শান্তি চায়, ভয়ের পরিবেশে বাঁচতে চায় না। তারা চায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের কথা শোনা হোক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে জবাবদিহি করার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনগণের মতকে প্রতিষ্ঠা করার পথে এগোনো সহজ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান বলেন, অর্গানাইজেশন এবং ইনস্টিটিউশনের মধ্যকার পার্থক্য করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে কঠোরভাবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সহআহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অতীতের সরকার ব্যবস্থায় মানুষের কথা শোনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা কেবল নির্বাচনে আটকে নেই। অতীতের সরকার ব্যবস্থাগুলোতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ মানুষের ভোট নিয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়েছিল এবং তারা সংবিধান বদলের অধিকার পেয়ে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করেছে। নতুন বাংলাদেশের মানুষ এর বদল চান। কেবল ক্ষমতার পালাবদল করে দিতে এ গণঅভ্যুত্থান হয়নি।
বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি বিষয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, তারা হয়তো সংস্কার চায় না। তিনি উল্লেখ করেন, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নামে আছে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা। এর বদল করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, নিজেদের পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিনিধি পাঠানোর পর যদি জনগণ দেখেন তাদের পক্ষে ওই প্রতিনিধি কথা বলছেন না, তাহলে তাকে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। রাজনৈতিকগুলো গণতন্ত্রের কথা বললেও নিজেরা গণতন্ত্রের চর্চা করে না। মুখে জনগণই সব ক্ষমতা উৎস– এমনটা বললেও সংসদে নিজ দলের বিরুদ্ধেই কথা বলতে পারে না।