টিসিবির পণ্য কিনতে গিয়ে ক্রেতাদের পাঁচ অভিযোগ
Published: 15th, February 2025 GMT
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। মাঝখানে কিছুটা বিরতির পর গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে পুনরায় এ কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি। গত সপ্তাহের সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঢাকা শহরের আটটি স্থানে টিসিবির ‘ট্রাক সেল’ কার্যক্রম ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। এ সময় ক্রেতারা টিসিবির পণ্য বিক্রি নিয়ে অন্তত পাঁচটি অভিযোগের কথা জানান। অভিযোগগুলো এখানে তুলে ধরা হলো—
ক্রেতার তুলনায় পণ্য কমটিসিবির ট্রাক থেকে একজন ভোক্তা ৫৮৮ টাকা খরচ করে ২ লিটার ভোজ্যতেল (সয়াবিন বা কুঁড়ার তেল), ২ কেজি মসুর ডাল, ১ কেজি চিনি, ২ কেজি ছোলা ও ৫০০ গ্রাম খেজুর কিনতে পারেন। প্রতিটি ট্রাকে ২০০ জনের পণ্য থাকে। অথচ প্রায় প্রতিটি ট্রাকের পেছনেই ৩০০-৪০০ মানুষের সারি দেখা যায়। জনবহুল আবাসিক এলাকায় মানুষের সংখ্যা আরও বেশি থাকে।
টিসিবির ট্রাক থেকে এসব পণ্য কিনলে একজন ভোক্তার ৪০০ টাকার মতো সাশ্রয় হয়। মূলত এই অর্থ সাশ্রয়ের জন্যই তীব্র ভিড় সত্ত্বেও মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু ক্রেতার তুলনায় পণ্য কম থাকায় শেষ পর্যন্ত অনেকে পণ্য কিনতে না পেরে খালি হাতে ফেরত যান।
যেমন গত বুধবার বেলা তিনটার দিকে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে টিসিবির ট্রাকের পণ্য শেষ হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত অন্তত ৫৫ জন মানুষ পণ্য কিনতে না পেরে খালি হাতে ফিরে গেছেন। সেদিন শেওড়াপাড়াতেও এভাবে ৩৮ জন মানুষ খালি হাতে ফিরেছেন।
স্থান ও সময় জানেন না ক্রেতারাটিসিবির নিবন্ধিত ডিলার বা সরবরাহকারীরা ট্রাকে করে প্রতিদিন ঢাকা শহরের ৫০টি ও চট্টগ্রামের ২০টি স্থানে ভর্তুকি মূল্যের পণ্য বিক্রি করেন। তবে প্রতিদিন একই জায়গায় পণ্য বিক্রি হয় না; একই ওয়ার্ডের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ট্রাক যায়। ফলে সীমিত আয়ের অনেক ক্রেতা ঠিক কোথায় পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তা জানেন না। আবার লম্বা সময় নিয়ে ট্রাক খোঁজাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
এ বিষয়ে টিসিবির বক্তব্য হচ্ছে, একই স্থানে প্রতিদিন পণ্য দিলে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ বারবার পণ্য কেনার সুযোগ নেন। এটি এড়াতে প্রতিদিনই স্থান বদল করা হয়। তবে টিসিবির স্থান পরিবর্তনের এই পদ্ধতি খুব কার্যকর হয় না। সরেজমিনে দেখা গেছে, স্থান পরিবর্তন সত্ত্বেও বিভিন্ন এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু মানুষ প্রতিদিন টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কেনেন। এই মানুষেরা জোটবদ্ধ হয়ে সম্ভাব্য বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেন। ট্রাক এলে একে অন্যকে খবর পাঠান। তাঁদের অনেকে এসব পণ্য বাইরে বেশি দামে বিক্রি করেন বলেও অভিযোগ আছে। অন্যদিকে কর্মজীবী, সীমিত বা নিম্ন আয়ের মানুষেরা স্থান ও সময় না জানায় টিসিবির পণ্য কেনার সুযোগ সেভাবে পান না।
গত সোমবার কাজীপাড়ায় টিসিবির পণ্য নিতে আসা রাফায়েত চৌধুরী বলেন, ‘স্থানীয় দোকানদার ও আশপাশে থাকা মানুষেরা প্রতিদিনই ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে পণ্য নেয়। এই পণ্য নেওয়ার জন্য একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেছে। তারা একে অপরকে খবর দিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের মতো নিম্ন আয়ের ও ছোট চাকরি করা মানুষেরা লাইনে ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জানতেই পারি না, কোথায় ও কবে পণ্য বিক্রি হচ্ছে।’
টোকেন ছাড়া পণ্য বিক্রিটিসিবির ট্রাকের পেছনে নারী ও পুরুষেরা সাধারণত দুটি সারিতে দাঁড়ান। অনেক পরিবেশক ট্রাক নিয়ে আসার পর উপস্থিত মানুষের মধ্যে টোকেন বিতরণ করেন। তখন টোকেনের সিরিয়াল অনুসারে ক্রেতারা পণ্য কেনেন। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক পরিবেশক টোকেন ছাড়াই পণ্য বিক্রি করেন। টোকেন না থাকলে অনেক ক্রেতা আগে পণ্য নেওয়ার জন্য লাইন ভেঙে সামনে চলে যান। তাতেই শুরু হয় হট্টগোল।
গত বুধবার শেওড়াপাড়ায় টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে আসেন সুলতানা বেগম। কিন্তু চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও এই নারী পণ্য কেনার সুযোগ পাননি। তিনি বলেন, ‘ট্রাকের লোকেরা টোকেন দেয়নি। এ কারণে বুঝতেও পারছিলাম না যে শেষ পর্যন্ত পণ্য পাব কি না। আশায় আশায় চার ঘণ্টা অপেক্ষা করে পণ্য না কিনেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। শুরুতেই উপস্থিত লোকজনের মধ্যে দিলে এই সময় আর নষ্ট হতো না।’
বিশৃঙ্খলা, মারামারিটিসিবির ট্রাকের পেছনে আরেকটি নিয়মিত চিত্র হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, ধাক্কাধাক্কি ও মারামারির ঘটনা। গত সপ্তাহের চার দিনে রাজধানীর আটটি স্থান ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। প্রতিটি স্থানেই পণ্য বিক্রিতে চরম বিশৃঙ্খলা ও ক্রেতাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা দেখা গেছে। এই চিত্র সবচেয়ে প্রকট নারীদের সারিতে।
এ ছাড়া গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর চারটি স্থানে টিসিবির পণ্য বিক্রেতাদের (ট্রাক ড্রাইভার ও তাঁর সহকারী) ক্রেতারা মারধর করেছেন বলে জানিয়েছেন টিসিবির কর্মকর্তারা। যেমন গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুর-৬ নম্বর কাঁচাবাজারের সামনের সড়কে টিসিবির পণ্যবোঝাই ট্রাকের চালক ও তাঁর এক সহকারীকে মারধর করেন স্থানীয় লোকেরা। মূলত পণ্য বিক্রি নিয়ে হট্টগোলের জেরে তাঁদের মারধর করা হয়। পরে ট্রাকটি সেখান থেকে চলে যায়।
করা হয় খারাপ ব্যবহারটিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। তাঁদের অভিযোগ, ট্রাকের বিক্রেতারা (পরিবেশক, চালক ও সহকারী) সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এর মধ্যে গালাগাল যেন নিয়মিত ঘটনা। কখনো কখনো পানি ছুড়ে মারেন এবং সজোরে ধাক্কা দেন।
গত বুধবার দুপুরে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে দেখা যায়, টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এক বিক্রেতা সজোরে ধাক্কা দেন। এতে লাইনে দাঁড়ানো কয়েকজন রাস্তায় পড়ে যান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবির শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেতাদের অভিযোগ আমরা জেনেছি। তাদের সঙ্গে যেন দুর্ব্যবহার করা না হয়, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে পণ্যের তুলনায় মানুষের ভিড় বেশি থাকায় বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। সে জন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়ার কথা ভাবছি।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৫ দফা দাবিতে রংপুরের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’, সড়ক অবরোধ
এমবিবিএস ও বিডিএস ছাড়া চিকিৎসকের স্বীকৃতি দেওয়া বন্ধসহ ৫ দফা দাবিতে রংপুরে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের পাশাপাশি সড়ক অবরোধ করে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেছেন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী, চালক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একই দাবিতে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাও কর্মবিরতিতে আছেন।
আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ গেট থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহীদ মুখতার ইলাহী চত্বরে (মেডিকেল মোড়) সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ কর্মসূচিতে রংপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ, প্রাইম মেডিকেল কলেজ, রংপুর আর্মি মেডিকেল কলেজের কয়েক শ শিক্ষার্থী অংশ নেন। এক ঘণ্টার সড়ক অবরোধ শেষে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা রংপুর মেডিকেল কলেজের ভেতর পথসভা করেন। পরে মহাসড়কটিতে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, একই দাবিতে ১৭, ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এই তিন দিন ধারাবাহিক বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা করেছেন তাঁরা। ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি ও শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করছেন। এসব দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
রংপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আবু রায়হান প্রথম আলোকে জানান, ৫ দফা দাবিতে তাঁরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেছেন। তাঁরা আন্দোলন করছেন যাতে মানুষের সঙ্গে স্বাস্থ্য নিয়ে প্রতারণা করা না হয়। দেড় বছর বা ৬ মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ চিকিৎসক লিখে মানুষের সঙ্গে যাতে প্রতারণা করতে না পারে।
শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবি হলো,
১. এমবিবিএস/বিডিএস ব্যতীত কেউ চিকিৎসক লিখতে পারবে না। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) বিরুদ্ধে করা রিট ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে। বিএমডিসি নিবন্ধন শুধু এমবিবিএস/বিডিএস ডিগ্রিধারীদের দিতে হবে। ২০১০ সাল থেকে হাসিনা সরকার ম্যাটসদের (মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল) বিএমডিসি থেকে নিবন্ধন দেওয়া শুরু করেছে। এই ম্যাটসদের বিএমডিসি থেকে নিবন্ধন দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
২. উন্নত বিশ্বের চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি ড্রাগ লিস্ট আপডেট করতে হবে। এমবিবিএস বা বিডিএস ছাড়া অন্য কেউ ওটিসি লিস্টের বাইরের ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারবে না। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিগুলো ওটিসি লিস্টের বাইরের কোনো ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না।
৩. স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসকের সংকট নিরসনে দ্রুত ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে সব শূন্য পদ পূরণ করতে হবে। আলাদা স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করে আগের মতো সপ্তম গ্রেডে নিয়োগ দিতে হবে। প্রতিবছর ৪-৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। চিকিৎসকদের বিসিএসে বয়সসীমা ৩৪ বছর করতে হবে।
৪. সব মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্কুল (ম্যাটস) ও মানহীন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে পাস করা ম্যাটস শিক্ষার্থীদের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) পদবি রহিত করে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. চিকিৎসক সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।