গামলার মধ্যে ট্যাংরা, বাইল্যা, পুঁটি, কই, শোল, টাকি, চিংড়ি, ডগরিসহ নানা প্রজাতির মাছ। মাছগুলোর গায়ে লেগে আছে কাদাপানি। কিছু মাছ একেবারে জ্যান্ত—তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। কিছু মাছের নড়নচড়ন হয়তো মাত্রই থেমেছে। সদ্য ধরা মাছের গামলা রেখে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে জাল পরিষ্কার করছেন রাজ্জাক-জোহরা দম্পতি। মাছের কিছুটা বিক্রি করবেন, বাকিটা রাখবেন নিজেদের খাওয়ার জন্য।

রাজ্জাক-জোহরা বেড়িজাল দিয়ে যে জায়গায় মাছ ধরছিলেন, সেটা একসময়ের খরস্রোতা ‘মরা পশুর নদ’। নাম শুনেই নদের এখনকার অবস্থা বোঝা যাচ্ছে। খুলনার বটিয়াঘাটা ও বাগেরহাটের রামপাল-ফকিরহাটের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এই নদে এখনো ক্ষীণ স্রোত আছে।

জাল ধুয়ে পরিষ্কারের পর মাছের গামলা নিয়ে পাড়ে উঠলেন রাজ্জাক-জোহরা। রাস্তায় উঠেই জোহরা মাছের গামলা নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন। জালে কোথাও ময়লা থেকে গেছে কি না, তা দেখছিলেন রাজ্জাক। ১২ ফ্রেব্রুয়ারি সেখানেই কথা হলো রাজ্জাকের সঙ্গে।

রাজ্জাকরা এখন থাকছেন বটিয়াঘাটার আমিরপুর গ্রামে। একসময়ের মূল পেশা মাছ শিকার হলেও এখন বছরের বেশির ভাগ সময়ই দিনমজুরি করতে হয়। রাজ্জাকের আদি নিবাস যেখানে, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ বেড়ে ওঠেন জাল, নৌকা আর মাছ সঙ্গী করে।

রাজ্জাকদের আদি বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সাগর ও সুন্দরবনঘেঁষা জনপদ গাবুরা ইউনিয়নের পাশ্বেমারী গ্রামে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জনপদগুলোর অন্যতম দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। রাজ্জাক গাজী একজন জলবায়ু উদ্বাস্তু। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা তাঁকে ভিটে ছাড়তে বাধ্য করেছে। নিজের জন্মভিটা থেকে সবচেয়ে কম পথে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরের আমিরপুরে এসে ঠাঁই নিতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে।

আবদুর রাজ্জাক গাজী বলছিলেন, ‘ওই যে আইলা হুয়োলো। বাড়ির তে রশিখানিক দূরি নাপিতখালী বাঁধ ভাঙে গেল। কপোতাক্ষের স্রোতে জিনিসপত্তর, গরু সব ভাইসে যাতি লাগল। মুহূর্তের মধ্যি ঘরের ওপরে পানি উঠে গেল। ওই সময় বাচাকাছা নে, ভাইসেপুড়ে বারইলাম, এরপর নৌকায় পাঁচ-ছয় দিন। এর কয় দিন পর ভিটেকাটা সব ফেলিয়ে থুয়ে খুলনা চুলে আইলাম।’

খুলনা শহরে এসে নগরের শ্রমিক–অধ্যুষিত এলাকা লবণচরা বান্দাবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া করেন আবদুর রাজ্জাক। এরপর চিরচেনা পেশা বদলে হয়ে ওঠেন রিকশাভ্যানের চালক। তারপর জ্বালানি কাঠের গোলায় কাজ নেন। পরে আবার কাজ নেন সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। এভাবেই কেটে যায় ছয় থেকে সাত বছর। তবে অনিশ্চয়তা আর একের একের পর এক পেশা বদলের ধকলে শহরে থাকার ছেদ টানতে হয় রাজ্জাককে। এর মধ্যে অবশ্য রাজ্জাকের মতো তাঁর ভাইসহ অনেকেই টিকেতে না পেরে গাবুরা ছেড়ে শহরে এসে পড়েন কাজের খোঁজে। এলাকার কয়েকজন মিলে চেষ্টা করতে থাকেন নতুন কোনো জায়গায় নতুন করে বসতি গড়ার।

আবদুর রাজ্জাক বলতে থাকেন, বাসা ভাড়া দিয়ে আর পারতেন না। একা খেটে আর সংসার চালাতে পারতেন না। আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর বাঁধার জন্য সরকার ২০ হাজার করে টাকা দিয়েছিল, ওই টাকা দিয়ে তাঁরা দুই ভাই আমিরপুরের চরে কাঠা পাঁচেক জায়গা নেন। তাঁদের মতো অনেকেই এখন এখানে থাকছেন। প্রায় সবাই টিনের ঘর করেছেন।

রাজ্জাক গাজীরা পাঁচ ভাই। রাজ্জাক গাজী, কালাম গাজী ও ইসরাফিল গাজী এখন আমিরপুরে থাকছেন। এক ভাই জলিল গাজী চলে গেছেন যশোরের বেনাপোল। অন্য ভাই খলিল গাজী শুধু টিকে আছেন গাবুরার পৈতৃক ভিটায়।

রাজ্জাকের হিসাবে খুলনার কয়রা, দক্ষিণ বেদকাশী, শ্যামনগরের গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ এলাকা থেকে দুই শতাধিক জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার এসে এখন আমিরপুর এবং পাশের এলাকায় বসবাস করছে। তাঁর ভাষ্য, গাবুরায় আগে গায়ে গায়ে বসতি ছিল। এখন বসতি হালকা হয়েছে। এখন যাঁরা গাবুরাতে আছেন, তাঁরাও খুলনা শহরে এসে কাজ করছেন। তাঁরা একসঙ্গেই কাজ করেন।

খুলনা শহরের বাসা ছাড়লেও আবদুর রাজ্জাককে কাজের খোঁজে এখনো প্রতিনিয়ত খুলনা শহরেই যেতে হয়। শহরে গিয়ে করেন দিনমজুরের কাজ। আমিরপুর এলাকাতেও মাঝেমধ্যে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। যেদিন কাজে যান না, সেদিন নদী–খালে মাছ ধরেন। আর বর্ষাকালে মাছ ধরাটাই প্রধান পেশা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আবদ র র জ জ ক

এছাড়াও পড়ুন:

সত্যের পয়গাম

প্রাচীন ইরাকে ‘মেসোপটেমিয়া’ রাজ্যের রাজধানী ছিল বাবেল। মেসোপটেমিয়ার শাসক ছিল নমরুদ। খুবই অহংকারী আর দাম্ভিক। একদিন সে স্বপ্ন দেখল—আকাশে একটি নতুন তারা উদিত হয়ে চাঁদ আর সূর্যের আলোকেও নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। স্বপ্নটি নমরুদকে আতঙ্কিত করে তুলল। সে জ্যোতিষীদের ডেকে স্বপ্নটির ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করল। তারা বলল, ‘আপনার রাজ্যে এমন এক শিশুর জন্ম হবে, যার হাতে আপনার ও আপনার রাজত্বের অবসান ঘটবে।’ সেই শিশুর জন্ম কত তারিখে হবে—জ্যোতিষীরা তা-ও বলে বলে দিয়েছিল। নমরুদ নির্দেশ দিল, ওই তারিখে যত পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবে, প্রত্যেককে হত্যা করা হবে। রাজ্যের সর্বত্র চৌকি বসিয়ে দেওয়া হলো, প্রত্যেক গর্ভধারণকারী নারীকে জেলখানায় আবদ্ধ করা হলো।

আযর নামে এক কাঠমিস্ত্রির স্ত্রীও ছিল সন্তানসম্ভবা, কিন্তু আল্লাহর কুদরতে তার শরীরে গর্ভধারণের চিহ্ন দেখা যেত না। তিনি পালিয়ে এক গুহায় চলে যান, এবং সেখানে ইবরাহিম (আ.)-এর জন্ম হয়। ওদিকে নির্দিষ্ট দিনে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ছেলেকে হত্যা করা হলে নমরুদের মন শান্ত হলো। একসময় সে স্বপ্নের কথা ভুলেও গেল।

আরও পড়ুনআবু বকরের (রা.) মা যেভাবে মুসলমান হন০৫ এপ্রিল ২০২৫

ইবরাহিম (আ.) গুহাতেই বড় হতে থাকেন, আল্লাহ-তাআলা সেখানেই তাকে হেদায়েত দেন। তিনি কৈশোরে উপনীত হলে মা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখেন শহরের সব মানুষ এক আল্লাহর পরিবর্তে কাঠের দেবদেবীর পূজা করে। আর সেই মূর্তি তৈরি করে কিনা তারই পিতা আযর! (সিরাত বিশ্বকোষ, ১/৩০১-৩০২, ইফাবা)

তিনি সর্বপ্রথম নিজ পরিবারে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। তিনি পিতাকে বলেন, ‘আপনি কি মূর্তিকে উপাস্য বলে মানেন? আমি তো আপনাকে আর আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে দেখছি।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৭৪)

কিন্তু আযর তার কথা শুনল না। ইবরাহিম (আ.) ক্ষান্ত হলেন না, তিনি যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন।

বাবেলের অধিবাসীরা বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রে বিশ্বাস রাখত। মনে করত এরাও খোদা। কিন্তু গ্রহ-নক্ষত্র তো আল্লাহর মাখলুকমাত্র, উদিত হয় আবার অস্ত যায়। যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক, তার উদয়-অস্ত হতে পারে না। তিনি চিরঞ্জীব, তার কোনো আদি-অন্ত নাই। এই কথাগুলো বোঝানোর জন্য ইবরাহিম (আ.) কৌশলের আশ্রয় নিলেন, এক সন্ধ্যায় লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই যে তারকা, (ধরে নিলাম) এটা আমার প্রভু!’ একটু বাদে যখন তারকাটি ডুবে গেল, তিনি বললেন, ‘যেসব জিনিস ডুবে যায়, তার প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা নাই!’ তারপর সব গ্রহ-নক্ষত্রকে আলোহীন করে চাঁদের উদয় হলো। তিনি বললেন, ‘এটাই আমার প্রভু!’ কিন্তু একসময় চাঁদও ডুবে গেল। তিনি বললেন, ‘আমার প্রভু যদি আমাকে পথ না দেখান, তবে নিশ্চয় আমি পথহারাদের দলে শামিল হব।

আরও পড়ুনইসলামের শত্রু আবু জাহেলের মা তিনি ০৪ এপ্রিল ২০২৫

পরদিন যখন সবদিক আলোকিত করে সূর্য উঠলো, তিনি বললেন, ‘এটাই আমার প্রভু, এটাই সবগুলোর চেয়ে বড়!’ এক পর্যায়ে সূর্যও ডুবে গেল, তিনি বললেন, ‘হে আমার জাতি, তোমার যেসব জিনিসকে আল্লাহর অংশীদার মনে করো, আমি তা থেকে মুক্ত। আমি একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (তাফসীরে তাবারী, ৯/৪৫৬, ইফাবা)

এ কথা শুনে তার জাতি বাদানুবাদ শুরু করে দিল। তারা বলল, তুমি দেবতাদের ভয় করো, এ ধরনের কথাবার্তা বোলো না। ইবরাহিম (আ.) বললেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে আমার সঙ্গে বাদানুবাদ করছ, অথচ তিনি আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন? তোমরা যে জিনিসকে তার অংশীদার বানিয়েছ, আমি তাকে ভয় করি না। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন। প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে আমার প্রতিপালকের জ্ঞান পরিব্যাপ্ত, তোমরা কি তা বুঝবে না?’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৭৬-৮০)

কিন্তু তারা সত্যকে অস্বীকার করল। কাফেরেরা এমনই। তারা না মানে ‘যুক্তি’ আর না মানে যুক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে ‘বিশ্বাস’। তারা কেবল অন্ধের মতো নফসের অনুসরণ করে যায়।

আরও পড়ুনমদিনায় মুনাফেকির উদ্ভব কেন হয়েছিল০৩ এপ্রিল ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিদেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডে খরচ কমেছে
  • গাজীপুরে ত্রেখাইল্লা খালের মুখ ভরাট, জলাবদ্ধতার শঙ্কায় কৃষকরা
  • সত্যের পয়গাম