জনবিচ্ছিন্ন হয়ে লেখার বিলাসিতা আমার নেই: কিযী তাহ্নিন
Published: 15th, February 2025 GMT
কিযী তাহ্নিন এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। তার লেখায় জীবনের জটিলতাকে সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর আগে কিযী তাহ্নিনের পাঁচটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এ প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম উপন্যাস ‘চনর্কি’। নতুন উপন্যাসের প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয় নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন কিযী তাহ্নিন। সাক্ষাৎকার গ্রহণে স্বরলিপি।
রাইজিংবিডি: ৬ষ্ঠ বইটি উপন্যাস হয়ে উঠলো? উপন্যাস লেখার প্রস্তুতিটা কীভাবে এগিয়ে নিয়েছেন?
কিযী তাহ্নিন: হুম। এই গল্পটি আসলে উপন্যাসে রূপ পেতই। সেটি ষষ্ঠ বই নাকি দশম বইয়ে যেয়ে হবে তা আগে ভেবে রাখিনি। চনর্কির গল্পের পট, ভাবনা মাথায় এসেছে প্রায় বছর চারেক আগে, কিংবা তারও আগে। বছর চারেক ধরে সিরিয়াসলি ভাবছিলাম এ নিয়ে। সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা শুরু করি আড়াই বছর কিংবা তিন বছর আগে। সময় নিয়েছি নিজের কাছে, চরিত্রদের কাছে, কাহিনী বিন্যাসে, কল্পনা আর যুক্তির বোঝাপড়ায়। আস্তে আস্তে লিখেছি। পাহাড় বা সমুদ্রে যেয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে লেখার বিলাসিতা আমার নেই। এবং অমন আয়োজন করে লিখতে হবে ভাবলে আমার লেখা হয় না। নগর জীবন যাপন করে কোলাহলের ফাঁকে যে সময়টুকু পাই লেখার জন্য তা আদর্শ আমার কাছে। প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে অবসরে, লম্বা ছুটির দিনগুলোকে বেছে নিয়েছি লেখার জন্য। একসময় লেখা থামিয়ে দিলাম। মনে হল ভাবনায় মন্থরতা আসছে। একটা লম্বা সময় লিখিনি। মাথার মধ্যে সাজিয়েছি, একসময় চরিত্ররা ছটফট করেছে, গল্পের বাঁক বদলাচ্ছে টের পাচ্ছি। লেখার নেশা তীব্র হলো, তখন আবার বসলাম লিখতে এবং শেষ করলাম চনর্কি।
রাইজিংবিডি: চনর্কির প্রেক্ষাপট জানতে চাই।
কিযী তাহ্নিন: ৯০ দশকে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার সরকারি কলোনি, তার ভেতরে জমতে থাকা ঘটনার ভাঁজে ভাঁজে যে কাহিনী তা নিয়েই চনর্কি এগোয়। চনর্কি পাঠ করেছেন যে পাঠকেরা তারা ৯০-কে ঘিরে স্মৃতিকাতরতায় জড়িয়েছেন। ৯০ এর গল্প চনর্কি। কিন্তু চনর্কির গল্পের বীজ কিন্তু চনর্কিমন্ত্রে। এ গল্পের মূল চরিত্র কাজলি, কৈশোরের খোলস ভাঙছে একটু একটু করে। অনুরাগের সূত্র আর সুঁই ফোটা বিষণ্ণতার তিরতিরে অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ছে সে। তার জীবন জুড়ে লেপ্টে থাকে একান্ত বৃত্তের মানুষেরা আর কলোনির জলপাইরঙা নিজস্ব দুপুর। এর মাঝে কাজলী তার মায়ের কাছ থেকে খুঁজে পায় চনর্কি মন্ত্র। রেশমপোকার খাঁচা চনর্কি। সেই চনর্কির আতসকাঁচে কাজলী জীবনকে দেখতে থাকে, চলমান ধারণাকে ভাঙতে থাকে। পাঠকেরা সেই চনর্কির মাঝে নিজেকে খুঁজেছেন। তারা জানিয়েছেন বলে জেনেছি। চনর্কি খুঁজে না পেলেও আফসোস ছিল না। সম্পূর্ণ অধিকার আছে পাঠকের নিজের মতন করে গল্পকে ভাঙবেন, ধারণ করবেন। বরং পাঠকের নতুন করে দেখার ধরণ গল্পকে আরো সমৃদ্ধ করে।
রাইজিংবিডি: প্রকাশনীগুলোর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
কিযী তাহ্নিন: এখন পর্যন্ত তিনটি প্রকাশনীর সাথে কাজ করেছি। তারা স্বনামধন্য। মোটাদাগে অভিজ্ঞতা ভালো। সবার সাথে প্রফেশনাল একটি সম্পর্ক রাখবার চেষ্টা করেছি। আমার গল্পের ভাবনা, প্রচ্ছদ নিয়ে বোঝাপড়া এখন পর্যন্ত ভালো। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যদি প্রকাশনী ইন্ডাস্ট্রির কথা বলি, লেখক এবং প্রকাশকের কাজের সম্পর্ক সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। লেখকের অধিকার বিষয়ে যথাযথ পলিসি থাকা উচিত। রয়্যালটি নিয়ে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার যে ক্ষোভ লেখকদের আছে, তা আমারও খানিকটা আছে। তবে সবার ক্ষেত্রে নয়। কিছু প্রকাশনী খুব নিয়ম মেনে লেখকের পাওনা বুঝিয়ে দেন।
রাইজিংবিডি: আপনার পেশা আপনার লেখার জন্য কতটুকু সহযোগী, কতটুকু প্রতিযোগী?
কিযী তাহ্নিন: দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রচার ও বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করা আমার পেশাগত দায়িত্বের অংশ। দেশের সাধারণ মানুষ যারা বংশ পরম্পরায় তাদের জীবনধারণের মূল অনুসঙ্গ হিসেবে ঐতিহ্যের সংরক্ষণের চর্চাকে বেছে নিয়েছে তারা আমার কাজের মূল জায়গা। কত উপাদান কত বৈচিত্রময়তার সন্ধান পাই। আমার লেখার জন্য সহায়ক তো বটেই। যে প্রতিবেশ আমার চারপাশে তৈরি হয়েছে এ কাজের মাধ্যমে তা আমাকে লিখতে আরো অনুপ্রাণিত করে। আর দাপ্তরিক কাজের ব্যস্ততা, সময়ের সংকট, প্রতিদিনের যানজট আছে, সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে প্রতিযোগী বলি না, বরং আছে বলেই চ্যালেঞ্জড ফিল করি, নিজের কাছে ফায়ার আসবার সময়টুকুতে লেখবার তাড়না বোধ করি।
রাইজিংবিডি: একজন লেখকের প্রচার কৌশল কেমন হওয়া উচিত?
কিযী তাহ্নিন: লেখকদের প্রচার কৌশলের চিন্তা না করতে হলেই ভালো হত। কিন্তু এ দেশের সাহিত্য জগতের কালচার তো ওভাবে গড়ে ওঠেনি। নতুনেরা কিছু প্লাটফর্ম তৈরী করছে বটে বইয়ের প্রচারের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে। প্রকাশকেরা অল্পবিস্তর করছে। তবে প্রচারের অনেকখানি এখনো লেখককে করতে হয়। পরিমিতির মধ্যে থেকে যতটুকু করা যায় আর কি। আলাদা করে আমার কোন কৌশল নেই। বা যা করি তা খুব কার্যকর কি না জানিনা। সব তো ওই সোশ্যালমিডিয়া কেন্দ্রিক। বই আসলে জানান দেই। কিছু ইন্টারভিউ দিতে হয় আর বুক রিভিউগুলো শেয়ার করি। তাও ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার সময়টুকুতেই যা করা হয়। এর বেশি করতে সংকোচ হয়।
রাইজিংবিডি: এখন কি নিয়ে কাজ করছেন?
কিযী তাহ্নিন: ঈদসংখ্যার জন্য গল্প লিখছি।
রাইজিংবিডি: একটি বিষয়কে কখন লেখার উপযুক্ত মনে করেন?
কিযী তাহ্নিন: যখন সেই বিষয়ের অতলে প্রবেশ করে ভাঁজগুলোকে ভাঙবার ইচ্ছা জাগে। কোন চরিত্রকে নিজের মতন করে গড়বার আকাঙ্খা গাঢ় হয়। এবং প্রতিকূলতা ভেঙে লিখবার ইচ্ছা তীব্র হয়ে ওঠে।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ল খ র জন য উপন য স ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
দুপুরের আড্ডায় বাড়ে সম্পর্কের উষ্ণতা
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) দুপুর মানেই ব্যস্ততার শেষভাগ আর সম্পর্কের উষ্ণতার শুরু। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশনের চাপ—সবই দুপুর গড়িয়ে এলেই যেন মিলিয়ে যায়। প্রতিটি বিভাগেই এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা এসে খুঁজে পায় নিশ্বাস নেওয়ার ফুরসত, কিছু গল্প এবং অনেকটা হাসি।
তেমনই দৃশ্য দেখা যায় যবিপ্রবির অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম (এআইএস) বিভাগের বারান্দার ব্যালকনিতে; যেখানে কয়েকজন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে উপভোগ করেন দিনের সবচেয়ে প্রাণবন্ত সময়টি। কেউ রেলিং ধরে আছেন, কারো হাতে পানির বোতল, কারো হাতে চায়ের কাপ, কারো চোখ স্থির দূরের পানে। বাতাসে দোল খাওয়া গাছের পাতা, নিচে সবুজের বিস্তার; সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক প্রশান্তি। দৃষ্টি আরো দূরে গেলে দেখা যায় যশোরের গ্রামাঞ্চলের অংশ বিশেষ, যা মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা বাড়ি আর পেরিয়ে আসা কৈশোরের স্মৃতি। এই সময়টুকুই তাদের দৈনন্দিন চাপ আর ক্লাসের ব্যস্ততার আড়ালে এক কোমল বিশ্রামের মুহূর্ত।
বিভাগের শিক্ষার্থী শাওন কবির বলছিলেন, ক্লাস শেষে আড্ডা দিলে যেন সব ক্লান্তি গলে যায়। আজ কী খেলা, কালকের ক্লাসে কী হবে কিংবা একদম অপ্রয়োজনীয় তর্ক; সবই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই মনে হয়, দিনের অর্ধেক স্ট্রেস কোথায় হারিয়ে গেল।”
তিনি আরো বলেন, পরীক্ষা সামনে বলে এখন পড়াশোনার চাপ একটু বেশি। কিন্তু, আড্ডায় ঢুকলেই সেই চাপ কোথায় মিলিয়ে যায়। হাসাহাসি, খুনসুটি, কারো সমস্যার কথা শোনা, কারো নতুন প্রেম বা নতুন আইডিয়ার গল্প—এসব মিলিয়ে ক্যাম্পাস যেন তখনই সবচেয়ে জীবন্ত মনে হয়।”
বন্ধুত্বও এখানে তৈরি হয় খুব সহজে। আগে চেনা ছিল না, একদিন ক্লাস শেষে দাঁড়িয়ে থাকা, তারপর কয়েকদিন আড্ডা, কোনো এক দুপুরে মনে হয়, এরা শুধু সহপাঠী নয়, বরং নিজের মানুষ। সম্পর্কের উষ্ণতা যেন এই আড্ডার মধ্যেই জন্ম নেয়।
শিক্ষার্থীরা বলেন, এসব আড্ডাই তাদের ক্যাম্পাস জীবনের প্রাণ। মনোরম পরিবেশ, শীতের মৃদু রোদ, নিরিবিলি হাওয়া—সব মিলিয়ে যে আবহ তৈরি হয়, তা না দেখলে বোঝানো কঠিন। শীতের দুপুরে রোদে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের হাসির শব্দ দূর পর্যন্ত ভেসে যায়। তখন মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে সহজ সুখ হয়ত এই কয়েকটি মুহূর্তেই লুকানো।
শিক্ষার্থীদের কথায় বার বার একই অনুভূতি ফিরে আসে। এই আড্ডা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অর্ধেক ফাঁকা হয়ে যেত। কারণ, এই চত্বরগুলোতে দাঁড়িয়ে শুধু গল্পই হয় না, বোনা হয় প্রতিদিনের স্মৃতি, অভ্যাস এবং একসাথে বেড়ে ওঠার সময়গুলো।
একদিন তারা হয়ত এই আড্ডার জায়গা থেকে অনেক দূরে যাবে, থাকবে চাকরি, ব্যস্ততা, পরিবার, শহরের চাপ। কিন্তু, কোনো দুপুরে হঠাৎ বাতাসে পরিচিত গন্ধ ভেসে এলে মনে পড়বে আজকের সেই ব্যালকনিটা, হাসির শব্দ, ক্লাসের পরের তর্ক আর সেই মুহূর্তের উষ্ণতা। তখন মনে পড়বে ব্যালকানিতে সেই সোনালি আড্ডাগুলোর স্মৃতিগুলো।
ঢাকা/ইমদাদুল/জান্নাত