‘আল্লায় আমার কতা হোনছেন, আমি আমার জাদুর লাশ খুঁইজ্জা পাইছি’
Published: 14th, February 2025 GMT
গত বছরের ৬ আগস্ট ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখে বাবা-মা জানতে পারেন, তাঁদের সন্তান হাসান (১৮) গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। খোঁজ না পেয়ে রাজধানী ঢাকায় ছুটে যান। সেখানে সব হাসপাতাল খুঁজেও ছেলের সন্তান পাননি তাঁরা। পরে নানাভাবে প্রচার চালিয়ে জানুয়ারি মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এক তরুণের লাশের খবর পান। প্রাথমিকভাবে সেটিকে হাসানের বলে দাবি করেন তাঁরা। অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার ডিএনএ প্রতিবেদন পেয়ে নিশ্চিত হন লাশটি নিজেদের ছেলের।
আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে হাসানের মরদেহের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টায় ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের সাহমাদার গ্রামে দ্বিতীয় জানাজার পর হাসানের দাফন করার কথা আছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে হাসানের বাবা মো.
মনির হোসেন আরও জানান, দুই ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীর সংসারে হাসানের উপার্জনের অনেকটা নির্ভর করতে হতো। নদীভাঙনে সব হারিয়ে কাচিয়া ইউনিয়ন পরিষদ–সংলগ্ন অন্যের বাড়িতে ঘর তুলে বসবাস করছেন। দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালান। সংসারে অভাবের কারণে হাসান আট বছর আগে রাজধানীর গুলিস্তানে কাপ্তানবাজার এলাকায় একটি ইলেকট্রনিকসের দোকানে কাজ নেন। সেখানে কাজ করে নিজের খরচ চালিয়ে মাসে মাসে কিছু টাকা সংসারের জন্য পাঠাতেন। আর থাকতেন যাত্রাবাড়ীর বালুর মাঠের কাছে ধলপুর এলাকায় ভগ্নিপতি ইসমাইলের বাসায়।
এ পর্যায়ে কান্নারত অবস্থায় মনির জানান, হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে তাঁর সর্বশেষ কথা হয়েছে ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে। বিকেলে তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর ছেলের সঙ্গে আর কথা হয়নি। ঢাকায় আত্মীয়স্বজনও হাসানের খবর পাননি। ইসমাইলের কাছে জানতে পারেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় গত ৫ আগস্ট দুপুরের পর কয়েক দফায় গোলাগুলি হয়েছে। হাসান তখন গোলাগুলির মধ্যে পড়েন। ওই সময় তাঁর কাছে দুটি মুঠোফোন ছিল। সেগুলো নিয়ে যায় কেউ। পরদিন গত ৬ আগস্ট ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখে হাসানের গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হন।
হাসানের খোঁজ চেয়ে ঢাকা ও ভোলার বিভিন্ন স্থানে তাঁর নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির পোস্টার সেঁটে দেন। দুই শহরেই মাইকিং, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাঁর পরিবার সরকারের কাছে দাবি করেন, জীবিত বা মৃত হোক, তাঁর ছেলেকে যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পোস্টারে হাসানের নাম-ঠিকানা ও যোগাযোগের মুঠোফোন নম্বর দেন। একপর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে এক তরুণের লাশের খোঁজ পেয়ে আবার ছুটে যান। গত মাসের শুরুর দিকে সেখানে মরদেহটি হাসানের বলে শনাক্ত করেন তাঁর বাবা-মা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গতকাল মরদেহটি বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন হাসানের মা গোলনূর বেগম। আরও ভেঙে পড়েন তাঁর লাশের খোঁজ না পেয়ে। তবে ছেলের লাশ পাওয়াকেই এখন তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা বলে মনে করে তিনি বলেন, ‘আল্লার কাছে আবেদন করছিলাম, আমার পুতেরে আমার কোলে ফিরাইয়া দেন। যদি বাইচ্চা থাহে, তাও খুঁইজ্জা দেন। আর যদি মোইররা যায়, তা–ও লাশ খুঁইজ্জা দেন। আল্লায় আমার কতা হোনছেন, আমি আমার জাদুর লাশ খুঁইজ্জা পাইছি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করুন
এ দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিট বিশেষত পুলিশ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত নিয়মিত বাহিনী, গোয়েন্দা দপ্তরসহ র্যাবের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ; তারা প্রতিনিয়ত আইনের ব্যত্যয় করছে। গত দুই দশকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে প্রায় চার হাজার নাগরিক। এর মধ্যে হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে এক হাজারেরও বেশি।
ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধের কথা বলে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আমরা নাগরিকরা সব সময় চেয়েছি ক্রসফায়ারে নয়, বরং আইনগত প্রতিকারে সমস্যাগুলোর সমাধান হোক। রাষ্ট্রের মদদে যখন আইশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে এসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, প্রকৃত অর্থে তখন রাষ্ট্রের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পায়। কোনো সমাজ ব্যবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়মুক্তি দেওয়া চলতে পারে না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকা অনিয়ম, নিষ্ঠুর আচরণে সম্পৃক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তখন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কার্যত বাংলাদেশে তা-ই ঘটেছে। যখন আমরা জানতে পারি একজন আসামিকে হেফাজতে রেখে আসামির স্ত্রীকে ধর্ষণ করার মতো ঘটনা ঘটেছে, তখন আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আমরা একটি সভ্য সমাজে বসবাস করছি! এ ধরনের আচরণ যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের দুঃসাহস আমাদের হতবাক করে। কাজেই উত্থাপিত অভিযোগটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে। প্রয়োজনে অভিযোগটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের আওতায় নিয়ে ন্যায়সংগত বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কী করে এতটা অধঃপতন হলো? তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তারা কি তাহলে রাজনৈতিক প্রচ্ছন্ন বলয়ে ঢুকে এই ধরনের জঘন্য অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে বা পেয়েছে? এভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মবহির্ভূত আচরণ ও কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ হয়তো উঠতেই থাকবে।
বিনা পরোয়ানায় আসামি বা সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার বা আটকের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও মহামান্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ না করাটা যে অন্যায় কিংবা বলা যায় আইনের ব্যত্যয়, এই বার্তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনে রাখতে হবে। আসামিকে না পেয়ে স্ত্রী কিংবা সন্তানদের আটক করে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্বাভাবিক পদ্ধতি বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে মনে হয়। সম্প্রতি কক্সবাজার জেলায় পিতাকে আটক করতে গিয়ে না পেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেসন্তানকে আটক করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলাও দেওয়া হয়েছে। যদিও হাইকোর্টে মামলা হওয়ার পরে সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে।
আমরা চাই আমাদের নিরাপত্তা। একই সঙ্গে যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন বা থাকবেন, তাদের কর্মকাণ্ড ও আচরণ যেন আইন ও বিধিসম্মত হয়। অন্যথায় আইনের শাসন ও জবাবদিহি শব্দ দুটি অকার্যকর হয়ে ওঠার সমূহ আশঙ্কা রয়ে যাবে। নির্দয়-নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয়ে দেশের কোনো মানুষের প্রাণহানি ঘটুক, সেটি কারও কাম্য নয়। কেননা, জীবনের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
এ দেশে ক্রসফায়ারে হত্যা বন্ধ হোক চিরতরে। কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করে থানা হেফাজতে নিষ্ঠুর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। ‘গুম’-এর মতো ঘটনা যেন এ দেশে আর কখনও ফিরে না আসে সেই অঙ্গীকার করতে হবে। বিগত দিনে কে কী করেছে তা আমরা স্পষ্টভাবে জানতে চাই। সামনের দিনে এ পরিস্থিতি যেন কোনো ক্রমেই না ঘটতে পারে সেই পথে চলতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় তাদের নিয়ে যে সামাজিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা গভীর ক্ষত তৈরি করবে।
আবু আহমেদ ফয়জুল কবির: মানবাধিকারকর্মী