আমাদের এক সহকর্মী থাকেন মোহাম্মদপুরের আদাবরে। বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বের হয়ে দেখেন, রাস্তায় কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা নেই। অগত্যা তিনি কতকটা পথ রিকশায়, কতকটা হেঁটে কারওয়ান বাজারের অফিসে এলেন। এ রকম সমস্যায় কেবল তিনি নন, আরও অনেকে পড়েছেন। সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন তাদের নানা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অটোরিকশার চালকেরা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন কম। বিআরটিএর এক সিদ্ধান্তের পর এমন প্রভাব পড়েছে ঢাকার রাস্তায়। বিআরটিএ সম্প্রতি ডিএমপিকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, কোনো অটোরিকশার চালক মিটারে চালাতে রাজি না হলে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে হবে।

নগরে যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে আইন কার্যকর হওয়া জরুরি; কিন্তু বিআরটিএ কি সংশ্লিষ্টদের আইন মানাতে পারছে? এর সরল ও সহজ উত্তর—পারেনি।

বিআরটিএ বলেছে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো যানবাহন সড়কে নামতে পারবে না; কিন্তু সড়কে যত্রতত্র লাইসেন্সবিহীন যানবাহন চলছে। বিআরটিএ বলেছে, লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া চালকেরা রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারবেন না। আমরা দেখছি, মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে চালকেরা হামেশা গাড়ি চালাচ্ছেন। বিআরটিএ বলেছে, ব্যস্ত সড়কে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নেওয়া যাবে না, বাসগুলো নিচ্ছে। বিআরটিএর আইন অনুযায়ী, ফিটনেসবিহীন যান সড়কে চলতে পারবে না। তবে হরদম চলছে। কালো ধোঁয়ায় পুরো এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।

বিআরটিএ দেখেও না দেখার ভান করছে। সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা থেকে জনগণেকে ১৬ ধরনের সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে আছে লাইসেন্স গ্রহণ, নবায়ন, ফিটনেস সনদ প্রদান, মালিকানা বদল ইত্যাদি। এসব সেবা বাসায় বসে অনলাইনে পাওয়ার কথা থাকলেও সেটি পাওয়া যায় না। দিনের পর দিন একটি লাইসেন্স পেতে বা নবায়ন করতে বিআরটিএ অফিসে ধরনা দিতে হয়। আর প্রতিটি স্তরে দালালদের টাকা দিতে হয়।

সড়ক পরিবহন আইনে ভাড়াসংক্রান্ত অপরাধে চালকের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮–এর ধারা ৩৫(৩) অনুযায়ী কোনো কন্ট্রাক্ট ক্যারিজের মালিক বা চালক রুট পারমিট এলাকার মধ্যে যেকোনো গন্তব্যে যেতে বাধ্য থাকবেন এবং মিটারে প্রদর্শিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ দাবি বা আদায় করতে পারবেন না। এর ব্যত্যয় হলে আইনের ধারা ৮১ অনুযায়ী অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রয়েছে।

যারা পয়েন্ট কাটবেন, তাদের পয়েন্ট তো শূন্য। আইন অমান্য করার কারণে পুলিশ চালকদের ধরছেন, মামলার ভয় দেখাচ্ছেন। আবার টাকার বিনিময়ে ছেড়েও দিচ্ছেন। কয়েকজন অটোচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে পুলিশ টাকা নিত প্রকাশ্যে, এখন নিচ্ছে আড়ালে। সন্ধ্যার পর উৎকোচের মাত্রা বেড়ে যায়। সরকার বদল হয়েছে। সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি।

এখানে উল্লেখ করা দরকার, বিআরটিএ অটোচালকদের মিটারে চালানোর পাশাপাশি মালিকের ভাড়াও ঠিক করে দিয়েছিল দৈনিক ৯০০ টাকা। অথচ মালিকেরা সেটি মানছেন না। চালকদের অভিযোগ, দিনে দুই বেলায় তাঁদের ভাড়া হিসেবে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। অর্থাৎ নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ। তাহলে চালকেরা মিটারে চলবেন কীভাবে? মালিক চালকদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। আর চালকেরা যাত্রীদের কাছ থেকে। মিটারে অটোরিকশার সর্বনিম্ন (প্রথম দুই কিলোমিটার) ভাড়া ৪০ টাকা। চালকেরা বলছেন, যখন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ২৫ টাকা। এখন চালের দাম ৫৫–৬০ টাকা। গত কয়েক বছরে গ্যাসের দামও বেড়েছে।

এ অবস্থায় বিআরটিএকে চালকদের কথাও ভাবতে হবে। আর আইন যদি মানাতে হয়, আগে মালিকদের ভাড়া কমাতে হবে। সাম্প্রতিককালে যেকোনো সিএনজি স্টেশনে দেখা যায়, অটোরিকশাচালকদের লম্বা লাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের অপেক্ষা করতে হয়। এ বিষয়েও বিআরটিএ নিশ্চুপ। তাহলে আইন কি কেবল অটোচালকদের জন্য?

১৯৮৩ সালের ‘মোটরযান আইন’ অনুযায়ী কোন অপরাধে কী শাস্তির বিধান, তা এখানে তুলে ধরা হলো: ১.

নিষিদ্ধ হর্ন/হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করলে জরিমানা গুনতে হবে ১০০ টাকা। ২. ওয়ানওয়ে সড়কে বিপরীত দিকে গাড়ি চালালে ১৪০(২) ধারায় গুনতে হবে ২০০ টাকা জরিমানা ৪. অতিরিক্ত গতি বা নির্ধারিত গতির চেয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে গেলে জরিমানা ৩০০ টাকা। ৫. নিরাপত্তাবিহীন অবস্থায় গাড়ি চালানো ১৪৯ ধারায় ২৫০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে ৬. কালো বা অতিরিক্ত ধোঁয়া বের হওয়া মোটরযান সড়কে ব্যবহার করলে ১৫০ ধারায় জরিমানা ২০০ টাকা ৯. রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বা ফিটনেস সার্টিফিকেট অথবা রুট পারমিট ব্যতীত মোটরযান চালালে জরিমানা ১ হাজার ৫০০ টাকা। ১০. বিমা ব্যতীত যানবাহন চালানো ১৫৫ ধারায় জরিমানা দিতে হবে ৭৫০ টাকা।

অন্যান্য আইন ভাঙলে যেখানে ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা জরিমানা, সেখানে মিটারে অটো না চালালে চালকদের ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা কতটা ন্যায়সংগত, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। বেশি জরিমানা হলে সেটা সবার জন্যই হওয়া উচিত।

আরেকটি কথা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে গত দুই দশকে নতুন কোনো অটোরিকশার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ফলে অটোরিকশা মালিকানায়ও সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। নতুন অটোরিকশা আমদানির অনুমোদন দিলে প্রতিযোগিতা বাড়ত এবং মালিকেরাও ভাড়া কমাতে বাধ্য হতেন। এখন মালিকেরা যেই ভাড়া নির্ধারণ করেন, চালকদের সেটা মানতে হয়। আইন মানানোর ক্ষেত্রে বিআরটিএ কঠোর হলে সব ক্ষেত্রেই হতে হবে।

ঢাকার বেহাল গণপরিবহন নিয়ে অনেক বছর ধরেই আলোচনা চলছে। ঢাকায় মানুষ বাড়ছে। গণপরিহন বাড়ছে না। সেই তুলনায় সড়ক বাড়ছে বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে সমন্বিত বাস চালুর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তাদের সেই উদ্যোগও সফল হয়নি। লাল রঙের বদলে এখন গোলাপি রঙের বাস নামিয়েছে। অর্থাৎ বিআরটিএ রং বদল করেছে, যাত্রীসেবায় কোনো গুণগত পরিবর্তন আসেনি।

সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অংশীজনের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করে না। বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন সম্প্রতি বলেছেন, ‘সড়ক পরিবহন খাতে নৈরাজ্য বন্ধে আরও কঠোর কিছু করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। দু-এক মাসের মধ্যে সিএনজির মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল, নির্ধারিত মালিকের জমা মেনে চলার বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কিন্তু সেই ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই তাঁরা সিএনজিচালকদের ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দিলেন কেন? এটা কি হটকারী সিদ্ধান্ত নয়? সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে সবাইকে আইন মানাতে হবে। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ কোনো কাজে দেবে না।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ৫০ হ জ র ট ক ব আরট এ চ লকদ র অন য য় সরক র স এনজ

এছাড়াও পড়ুন:

‘বাঘের থাবার দাগ’ সময়ের স্মারক হয়ে আছে যে মসজিদের দেয়ালে

জায়গাটিতে তখন এত মানুষের বসতি ছিল না। ঝোপ-জঙ্গলে স্থানটি দুর্গম ছিল, অন্য রকম ছিল। বাঘসহ অন্য সব বন্য প্রাণীর বিচরণ ছিল এই স্থানটিতে। এটা অনুমান করা যায় পাঁচ শতাধিক বছর আগের তৈরি মসজিদের দেয়ালের একটি চিহ্ন থেকে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, ওই চিহ্নটি ‘বাঘের পায়ের থাবার’। সেই দাগ এখনো দেয়ালটিতে সময়ের স্মারক হয়ে আছে। মসজিদটিতে সময়ে সময়ে নানা রকম সংস্কার ও উন্নয়নকাজ হয়েছে। তবে পুরোনো আদল, ‘বাঘের থাবার চিহ্ন’, ফুলের নকশা এখনো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

মসজিদটির নাম ‘গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ’। অবস্থান মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নে। প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে এখনো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় টিকে আছে। শুধু স্থানীয় মানুষই নয়, আশপাশের এলাকাসহ দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন মসজিদটি দেখতে, নামাজ পড়তে। মসজিদকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনিরও কমতি নেই।

গত বুধবার (২৬ মার্চ) বিকেলে মসজিদটিতে গিয়ে দেখা গেছে, তখন সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। আসরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আজান পড়তেই চারদিক থেকে মুসল্লিরা নামাজ পড়তে ছুটে এসেছেন। স্থানীয় লোকজন জানালেন, পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের সময় এ রকমই হয়ে থাকে। তবে শুক্রবারে জুমার নামাজে প্রচুর মুসল্লির সমাগম ঘটে। ঐতিহাসিক মসজিদে নামাজে শামিল হতে অনেক দূরের মানুষ এখানে ছুটে আসেন। তখন অনেক সময় মুসল্লিদের স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে পড়ে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় মসজিদের পুরোনো ভবন অক্ষুণ্ন রেখে মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দিকে জায়গা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দক্ষিণ পাশেও অস্থায়ীভাবে শামিয়ানা টাঙিয়ে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মসজিদের ভেতরের পূর্ব দিকের দেয়ালের থামে এই দাগটি বাঘের থাবার বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গত বুধবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গয়ঘরে

সম্পর্কিত নিবন্ধ