সংবিধান সংস্কার: প্রস্তাবনা পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে কিছু প্রশ্ন
Published: 14th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। এই কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পুরো প্রতিবেদন ৮ ফেব্রুয়ারি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনা, মৌলিক নীতিমালাসহ বেশ কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে।
এই সুপারিশগুলো এখন কেবল প্রস্তাবনা হিসেবে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগুলো চূড়ান্ত করা হবে। এরপরও সুপারিশগুলো সংলাপ ও ঐকমত্য গঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে—এমনটা ধারণা করা যায়। তাই এ সুপারিশগুলোর পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তবে আমি আমার আলোচনা শুধু সংবিধানের প্রস্তাবনা পরিবর্তনের সুপারিশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব।
সংবিধান সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনা বাদ দিয়ে নতুন একটি প্রস্তাবনা সুপারিশ করেছে। নতুন প্রস্তাবনায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়া হয়েছে; রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং সর্বোপরি ১৯৭২ সালের গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান রচনা, সংবিধান গ্রহণ ও গ্রহণের ঘোষণা ও তারিখ বাদ দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তনের তাৎপর্য কী?
প্রস্তাবনা সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে সংবিধানের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতিমালা লিপিবদ্ধ থাকে এবং মূল সংবিধানের পথনির্দেশনা দেয়। প্রস্তাবনা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। কারণ, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল। এই দলিলের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় এবং এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দেশ পরিচালিত হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের তৎকালীন প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকার এটিকে অনুমোদন দিয়েছে। কাজেই এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস জড়িত। সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়া মানে হলো পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
প্রস্তাবনায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার বিদ্যমান চারটি মূলনীতি হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এর মধ্যে গণতন্ত্র ছাড়া বাকি তিনটি মূলনীতি বাদ দিয়ে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। মূলনীতির এই ব্যাপক পরিবর্তনের তাৎপর্য কী হতে পারে?
প্রথমেই আসা যাক ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে। ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছিল।
পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে একটি অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠীর মানুষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এর ফলে অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুক্তিযুদ্ধের একটি আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেন। তা ছাড়া রাষ্ট্রের একটি অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা করা। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার উপস্থিতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একটি আইনি রক্ষাকবচ। পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এ রকম আইনি সুরক্ষা দেওয়ার উদাহরণ রয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার যুক্তি হিসেবে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাক্-সাংবিধানিক কোনো নথিতে অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ বা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার বা ১৯৭১ সালের আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত পাকিস্তানের খসড়া সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ ছিল না।
যেকোনো গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব বা সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধ একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনা-আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এ অঞ্চলের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একত্রে এনেছিল এবং তাদের চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরই ১৯৫০ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি তুলেছিলেন। ১৯৫০ সালের আন্দোলনে তিনি দুটি দাবি উত্থাপন করেছিলেন। একটি হলো বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং অপরটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। তাঁর এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। (পিটার কাস্টার্স, মাওলানা ভাসানী অ্যান্ড দ্য ট্রানজিশন টু সেকুলার পলিটিকস ইন ইস্ট বেঙ্গল, ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্টোরি রিভিউ, এপ্রিল-জুন ২০১০)
প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্যানধারণাটি বাংলাদেশে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই ছিল। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯১৮ সালে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সম্মেলনে বলেছিলেন, হিন্দু জমিদার এবং মুসলমান জমিদার, হিন্দু মহাজন এবং মুসলমান মহাজনের শোষণ-নিপীড়নের মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সব দরিদ্র কৃষক একইভাবে শোষণ-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। কাজেই মুসলমান কৃষকদের শোষণের বিষয়টি সাম্প্রদায়িক নয়, এর মূলে রয়েছে জমিদারি ও মহাজনি ব্যবস্থায়। এ জন্য হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে জমিদারি ও মহাজনি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করা উচিত।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট গণপরিষদের প্রথম সভায় তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, পাকিস্তান হবে এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রতে্যক নাগরিক সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, ‘তোমরা স্বাধীন; তোমরা তোমাদের মন্দিরে যেতে স্বাধীন, তোমাদের মসজিদে যেতে স্বাধীন অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্রের যেকোনো উপাসনালয়ে যেতে স্বাধীন। তোমরা যেকোনো ধর্ম-বর্ণের হতে পারো, এটা রাষ্ট্রের কোনো বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রাজনৈতিক বিবেচনায়, ধর্মীয় বিবেচনায় নয়।’ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা তাঁর আদর্শ থেকে সরে আসেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মকে একীভূত করে ফেলেন।
রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার আরও একটি যুক্তি দেওয়া হয়েছে এই বলে যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের বিদ্যমান বহুত্ববাদী সমাজের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং মূলত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাবিরোধী।’ বহুত্ববাদী একটি আধুনিক ধারণা, এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে একেবারে নতুন এবং এর মর্মার্থ এখনো অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক।
ধর্মনিরপেক্ষতা সব ধর্মবিশ্বাসীকে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস প্রতিপালনের নিশ্চয়তা প্রদান করে, যা প্রকারান্তরে সব ধর্মবিশ্বাসীর সহাবস্থান এবং বহুত্ববাদের জন্য সহায়ক। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি মানবিক মৌলিক অধিকার আর বহুত্ববাদ একটি আদর্শ বা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। আমরা অবশ্যই বহুত্ববাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই, কিন্তু ধর্মীয় স্বাধীনতার মতো মৌলিক মানবাধিকার বাদ দিয়ে নয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের একটি বড় স্ববিরোধিতা হচ্ছে, একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, অন্যদিকে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বর্তমান বিধান বহাল রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। বহুত্ববাদের দোহাই দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার সুপারিশ স্পষ্টতই কমিশনের বর্ণিত বহুত্ববাদ ও সাম্যের বিরোধী এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।
মুক্তিযুদ্ধের মতোই ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও বিভিন্ন ধর্ম বা বিশ্বাসের মানুষ একত্রে ‘বৈষম্যহীন’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। তাই স্ববিরোধী যুক্তি দিয়ে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থী।
সংবিধান সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনার শেষ অনুচ্ছেদে সংবিধান গ্রহণ, গ্রহণ প্রক্রিয়া, গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ, গ্রহণের তারিখ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ দিয়ে ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি’—এমন কথা যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এর অর্থ হচ্ছে এই কমিশন ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান বাদ দিয়ে একটি নতুন সংবিধান গ্রহণের সুপারিশ করেছে।
এই সুপারিশ অনেকগুলো মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন ‘জনগণের সম্মতি’ কীভাবে নেওয়া হয়েছে, এই ‘আমরা’ কারা? তাদের সংবিধান গ্রহণের এখতিয়ার কোথা থেকে এল? কারা এই সংবিধান রচনা করলেন? এবং কোন তারিখে সংবিধান গ্রহণ করেছেন? প্রস্তাবনার এই মৌলিক পরিবর্তনগুলো বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, একটি নতুন সংবিধান রচনা বা গ্রহণের এখতিয়ার এই কমিশনের আছে কি না? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৭ অক্টোবরের যে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই কমিশন গঠন করেছে, সেখানে এই কমিশনের কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করিয়া সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করিতে’ সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করিল।
সরকারের প্রজ্ঞাপন থেকে এটা স্পষ্ট, এই কমিশনের কার্যপরিধি সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করা, বিদ্যমান সংবিধান বাদ দেওয়া বা নতুন সংবিধান রচনা বা প্রণয়ন করা নয়। বিদ্যমান সংবিধানের শেষ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের সুপারিশের মাধ্যমে সংস্কার কমিশন তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ করেছে। প্রস্তাবনা সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে বলে প্রস্তাবনা পরিবর্তনের সুপারিশ করার এখতিয়ার সংস্কার কমিশনের নেই।
কমিশন ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’কে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে; যদিও এই মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা এখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এই প্রত্যয় বা ধারণাগুলো অনেক ব্যাপক; এগুলোর মর্মার্থ বহুবিধ এবং বহুমাত্রিক হতে পারে।
‘সাম্য’ ধারণাটির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আরও বহু মর্মার্থ রয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাম্য, নারী-পুরুষের সাম্য, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাম্য প্রভৃতি। ‘মানবিক মর্যাদা’ এবং ‘বহুত্ববাদ’—এই ধারণাগুলো নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ধারণাগুলো হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেখানে আমরা ক্রমান্বয়ে এবং ধাপে ধাপে সমাজকে নিয়ে পৌঁছাতে চাই। কিন্তু এগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিমালা হতে পারে না। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এক নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিমালা হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যবোধ, রাষ্ট্র পরিচালনার ‘গাইডিং ফ্রেমওয়ার্ক’ এবং জাতির আদর্শের প্রতীক। অন্যদিকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র ভবিষ্যতে পৌঁছাতে চায়।
‘বহুত্ববাদ’ একটি চমৎকার আধুনিক ধারণা, যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ, মত-পথ, জীবনব্যবস্থা ও আদর্শের সহাবস্থানকে বোঝায়। কিন্তু আমাদের সমাজ কি এখনো এ রকম বহুত্ববাদ ধারণা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত? আমাদের সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেক ব্যাপক ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমাজের বিদ্যমান আদর্শ ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ‘বহুত্ববাদ’ ধারণাটি আদর্শ হিসেবে চমৎকার হলেও সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে এর নজির পাওয়া কঠিন।
সংবিধানের প্রস্তাব পরিবর্তনের ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে। সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়া, রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতির ব্যাপক পরিবর্তন এবং প্রস্তাবনার শেষ অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে নতুন অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করলে তা আমাদের দ্বিধাবিভক্ত করতে পারে। বর্তমানে দেশ একটি ক্রান্তিকালীন সময় পার করছে। একদিকে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, অস্থির রাজনীতি, অস্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ রকম অবস্থায় সংবিধান সংস্কার নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা উচিত হবে না। যে প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল ও মতের লোকজন একমত হবে এবং জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সহজ হবে, সেই পথে অগ্রসর
হতে হবে।
গোলাম রসুল অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা।
ই-মেইল: [email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র স প র শ কর র স প র শ কর ছ স ব ধ ন গ রহণ স ব ধ ন রচন ১৯৭১ স ল র অন চ ছ দ র জন ত ক ম সলম ন ব যবস থ গ রহণ র ক ত কর আম দ র র জন য র র জন র পর প কর ছ ল র একট আদর শ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
চব্বিশের চেতনা নস্যাতের ষড়যন্ত্র রুখতে হবে: হাবিপ্রবি উপাচার্য
চব্বিশের চেতনা নস্যাতের ষড়যন্ত্র রুখতে সর্বদা সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. এনামউল্যা।
তিনি বলেন, “বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ফলে পঁচাত্তর সালে বিপ্লব হয়েছিল, যা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস নামে পরিচিত। একই চেষ্টা গত ১৭ বছর করা হয়েছিল, যারই ফসল চব্বিশের বিপ্লব। চব্বিশের চেতনা নস্যাতের ষড়যন্ত্র রুখতে সর্বদা সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টায় হাবিপ্রবির অডিটোরিয়াম-২ তে ‘অমর একুশের ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। মহান শহীদ দিবস ও আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত এ সভায় তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, “একুশের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। সেই সময়ও বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল আমাদের তরুণ সমাজ। চব্বিশ সালে এসেও আমাদের তরুণ সমাজকে আবার রাজপথে রক্ত দিতে হয়েছে। তারা ছিল সম্মুখ সারিতে, আর পেছনে কৃষক, শ্রমিক, জনতাসহ সাধারণ মানুষ।”
তিনি আরো বলেন, “অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল স্বাধীনতার পরপরই একটা সরকার জনগণের স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে, গণতন্ত্র ধ্বংস করে বাকশাল কায়েম করে জাতিকে একটা দুর্ভিক্ষ উপহার দেয়। আমাদের মনে আছে, বাসন্তীরা গায়ে জাল জড়িয়ে কিভাবে লজ্জা নিবারণ করেছিল।”
এ অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাবিপ্রবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম সিকদার ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম. জাহাঙ্গীর কবির।
ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. এস. এম. এমদাদুল হাসানের সভাপতিত্বে ও সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. আবুল কালামের সঞ্চালনায় সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, চেয়ারম্যান, হল সুপার, প্রক্টর, বিভিন্ন শাখার পরিচালকসহ অন্যান্য শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান আলোচক অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী তার বক্তব্যে বলেন, “পাকিস্তানি শোষকরা মাতৃভাষায় কথা বলতে দিতে চায়নি, আমাদের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল। সেই সময় ছাত্ররা বুক পেতে দিয়েছিল, রক্তে রাজপথ লাল হয়ে গিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় চব্বিশের আন্দোলনেও একজন ছাত্রের টুটি চেপে ধরে এক পুলিশ অফিসার বলেছিল, ‘কথা বলবি না।’ বায়ান্ন তে বলেছিল উর্দুতে কথা বলতে হবে, বাংলায় না। এখানেই স্বৈরশাসক তথা ফ্যাসিস্টদের চমৎকার একটি মিল। তারা কথা বলতে দিতে চায়না।”
তিনি বলেন, “একুশের চেতনা ছিল আমরা স্বাধীনভাবে মায়ের ভাষায় কথা বলবো, সেটা বলতে দিতে চায়নি পাকিস্তান। একাত্তর আসলো, আমরা স্বাধীন হলাম। ভেবেছিলাম স্বাধীনভাবে কথা বলবো, শোষিত হব না। কিন্তু ১৭ বছর এদেশে জন্মগ্রহণ করা কিছু মানুষই আমাদের শোষণ করেছে, বঞ্চিত করেছে; পাকিস্তানী বা অন্যরা না। আমাদের সন্তানদের হলে থাকতে দেয়নি, তাদের ছাত্র সংগঠন বাকশালি কায়দায় চাঁদাবাজি করেছে, সিট বাণিজ্য করেছে, মেধাবীদের বঞ্চিত করা হয়েছে।”
“আন্দোলনকে দমাতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। নিজের বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বাংলাদেশে ভয়াবহ ম্যাসাকার করলেন। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এটা কল্পনা করা যায় না। চব্বিশ এর চেতনা ধারণ করে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সব শক্তিকে এক থাকতে হবে, ছোট ছোট বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য তৈরি করা যাবে না।”
ঢাকা/সংগ্রাম/মেহেদী