মহিমান্বিত রজনী শবে বরাতের তাৎপর্য ও ফজিলত
Published: 14th, February 2025 GMT
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী। ‘শবে বরাত’–এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’।
হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা ও হিন্দি ভাষায় এটি ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল এবং এ উভয়ের মাঝে যা আছে, সবার রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবু তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা করো সে দিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধূম্রাচ্ছন্ন হবে।’ (সুরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-১০)
হজরত ইকরিমা (রা.
হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা অর্ধশাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫৬৬৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৯০, ইমাম রাজিন, হাদিস: ২০৪৮; সহিহ ইবনে খুজাইমা, কিতাবুত তাওহিদ, পৃষ্ঠা: ১৩৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা এ রাতে বিদ্বেষ পোষণকারী ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারী ছাড়া বাকি সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৬) ‘এ রাতে আল্লাহ তাআলা মুশরিক ও ব্যভিচারিণী ছাড়া সবার ইচ্ছা পূরণ করে থাকেন।’ (শুআবুল ঈমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮৩) ‘যখন অর্ধশাবানের রাত আসে, তখন আল্লাহ তাআলা মাখলুকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদিগকে ক্ষমা করে দেন, কাফিরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং হিংসুকদের হিংসা পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না।’ (কিতাবুস সুন্নাহ, শুআবুল ঈমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হয়েছিল, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, “হে আয়েশা! তোমার কী আশঙ্কা হয়েছে?” আমি উত্তরে বললাম, “ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।” নবীজি (সা.) বললেন, “তুমি কি জানো, এটা কোন রাত?” আমি বললাম, “আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।” তখন নবীজি (সা.) বললেন, “এটা হলো অর্ধশাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।”’ (শুআবুল ঈমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)
নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়ার বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের পর রজব ও শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও অধিক নফল রোজা পালন করতেন; শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা বা কখনো আরও বেশি রাখতেন। উম্মুহাতুল মুমিনিন বা মুমিন মাতাগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন নফল রোজা রাখা শুরু করতেন মনে হতো তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল ল হ ত আল
এছাড়াও পড়ুন:
ঋণ থেকে মুক্তির জন্য যে আমল করবেন
আর্থিক দুরবস্থায় পড়লে মানুষ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ঋণের টাকায় প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করে। তবে সাধ্যের বাইরে ঋণ দেওয়া-নেওয়া দুটিই ইসলাম নিষেধ করেছে। কারণ, তাতে সময়মতো ঋণ পরিশোধের সম্ভাবনা কমে যায়। এর ফলে ঋণদাতাকে যেমন হতাশাগ্রস্ত হয়, ঋণগ্রহীতার আত্মমর্যাদাও ক্ষতির শিকার হয়।
মহানবী (সা.) আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন যাতে তিনি ঋণে জড়িয়ে না পড়েন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) নামাজের পরে দোয়া করতেন—হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে গুনাহ ও ঋণ থেকে পানাহ চাচ্ছি। এক প্রশ্নকারী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি ঋণ থেকে বেশি পানাহ চান কেন? রাসুল (সা.) জবাব দিলেন, মানুষ ঋণগ্রস্ত হলে মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা ভঙ্গ করে। (বুখারি, হাদিস: ২,৩৯৭)
হাদিসে ঋণ থেকে মুক্তির আরও কয়েকটি দোয়া রয়েছে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাজানি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল-আজযি ওয়াল-কাসালি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল-বুখলি ওয়াল-জুবনি, ওয়া আউজুবিকা মিন দ্বালায়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’ অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমনপীড়ন থেকে। (বুখারি, হাদিস: ২,৮৯৩)
আরও পড়ুনবদলে দিতে পারে জীবনে চলার ধরন সুরা লোকমানের উপদেশগুলো০৯ জানুয়ারি ২০২৪রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল কাসালি, ওয়াল হারামি, ওয়াল মাছামি, ওয়াল মাগরামি।’ হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে অলসতা, অধিক বার্ধক্য, গুনাহ এবং ঋণ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (বুখারি, হাদিস: ৬,০০৭)
হজরত আনাস (রা.)–এর বরাতে একটি হাদিস জানা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাজানি, ওয়াল আজযি ওয়াল-কাসালি, ওয়াল বুখলি ওয়াল-জুবনি, ওয়া দ্বালায়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’ অর্থাৎ, হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমনপীড়ন থেকে। (বুখারি, হাদিস: ২৮৯৩)
একজন বিশ্বাসী লোকের কাছে ঋণের বোঝার চেয়ে ভারি কিছু নেই। কারণ, ঋণ বান্দার হক। ক্ষমা না পেলে ঋণ থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। তাই কেউ ঋণ মাফ করে দিলে ওই ব্যক্তির জন্য আখিরাতে অনেক বড় পুরস্কারের ঘোষণা এসেছে হাদিসে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু রবিআ আল-মাখযুমি (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা.) হুনাইন যুদ্ধের সময় তাঁর কাছ থেকে ৩০ বা ৪০ হাজার দিরহাম ঋণ নিয়েছিলেন। নবী (সা.) যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তাঁর পাওনা পরিশোধ করেন। এরপর নবী করিম (সা.) তাঁকে দোয়া করে বললেন, ‘আল্লাহ–তাআলা তোমাকে তোমার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। নিশ্চয়ই ঋণের প্রতিদান হলো, তা পরিশোধ করা ও প্রশংসা করা।’ (ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)
আরও পড়ুনআবু জাহেলের মা ছিলেন সাহাবি০১ নভেম্বর ২০২৩একবার এক লোক ঋণ পরিশোধের জন্য ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)–এর কাছে কিছু সাহায্য চাইলেন। আলী (রা.) তাঁকে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে কয়েকটি শব্দ শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আমি কি তোমাকে সেটা শিখিয়ে দেব? সেটা পড়লে আল্লাহ তোমার ঋণমুক্তির দায়িত্ব নেবেন। তোমার ঋণ যদি পর্বতপ্রমাণ হয়, তাহলেও।’ এরপর আলী (রা.) ওই ব্যক্তিকে কথাগুলো শিখিয়ে দিলেন, ‘আল্লাহুম্মাক ফিনি বি হালালিকা আন হারামিকা, ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক।’ অর্থাৎ, হে আল্লাহ, হারামের পরিবর্তে তোমার হালাল রুজি আমার জন্য যথেষ্ট করো। আর তোমাকে ছাড়া আমাকে কারও মুখাপেক্ষী কোরো না এবং তোমার অনুগ্রহ দিয়ে আমাকে সচ্ছলতা দান করো। (তিরমিজি, হাদিস: ৩,৫৬৩; মুসনাদে আহমদ: ১,৩২১)
আরও পড়ুনআত্মীয়তা ভাঙতে রাসুল (সা.)–এর সতর্কতা১৯ জুন ২০২৩