Samakal:
2025-03-17@03:40:06 GMT

রক্তে রঞ্জিত ভালোবাসা!

Published: 13th, February 2025 GMT

রক্তে রঞ্জিত ভালোবাসা!

যুবকরা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলে দক্ষ ও মনোযোগী সৈনিক হয়ে উঠতে পারে না– এই যুক্তিতে তৃতীয় শতকে রোমের শাসক দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিয়ে নিষিদ্ধ করেন। ভ্যালেন্টাইন নামে এক সাহসী বীর এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করেন। গোপনে যুবক-যুবতীদের বিয়ের বন্দোবস্ত করতেন তিনি। ক্লডিয়াস এ খবর জানতে পারেন। ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে পাঠিয়ে রাষ্ট্রীয় আইন অমান্যের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। কথিত আছে, ভ্যালেন্টাইন কারাগারে অবস্থানকালে জেলারের মেয়ের প্রেমে পড়েন। মৃত্যুর আগে জেলারের কন্যাকে তিনি একটি চিঠি লেখেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয়। 


ভ্যালেন্টাইন একজন খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারক ছিলেন। শাসক দ্বিতীয় ক্লডিয়াস কারাবন্দি ভ্যালেন্টাইনকে দুটো প্রস্তাব দিয়েছিলেন– ১.

খ্রিষ্ট ধর্ম ত্যাগ করো। ২. কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাও। ভ্যালেন্টাইন দুটো প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁর সেই সাহসকে সম্মান জানাতে পরে পোপ গ্লসিয়াস কারাগারে ভ্যালেন্টাইন যেখানে ছিলেন সেই স্থানটিকে গির্জায় পরিণত করেন। একই সঙ্গে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ পালনের জন্য স্বধর্মের অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানান। যদিও দিবসটি ঘিরে এখন বাস্তবে চলছে রমরমা বাণিজ্য।
আছে ফুল নিয়ে বাণিজ্য, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কার্ড, জুয়েলারি, চকলেট। এসব বাবদ শুধু আমেরিকাতে এই দিনে প্রায় ২৫.৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। বাংলাদেশেও এই ঢেউ আছড়ে পড়েছে নব্বই দশকে। এর আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছে এক ভিন্ন ভালোবাসার গল্প, এক লড়াকু প্রেমিকের আত্মদান। 
২ 
১৯৮৩ সালের এই ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকা শহরে ঘটেছিল আরেক আত্মদানের ঘটনা। তার আগের বছর ২৪ মার্চ জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে সামরিক একনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাঁর শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল। সে কমিশন প্রস্তাব করে যে, উচ্চশিক্ষা হবে খুবই সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য। ৫০ শতাংশ ব্যয় বহন করতে পারবে যারা, তারা উচ্চশিক্ষা পাবে। এই ঘোষণা স্পষ্টতই ছিল রাষ্ট্রে বিরাজমান বৈষম্যকে স্থায়ী করার অপচেষ্টা। তবে শিক্ষার্থীরা তা মেনে নেয়নি। 


এর বিরুদ্ধে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মিছিল সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা করেছিল। দোয়েল চত্বর পেরিয়ে মিছিল হাইকোর্টের সামনে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হয়। বিনা উস্কানিতে পেটুয়া পুলিশ বাহিনী বেপরোয়া হিংস্র নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর। চলে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল ও গুলি বর্ষণ। প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহাসহ অনেকে। গণহারে গ্রেপ্তার চলে। সরকারি প্রেস নোটে ১ হাজার ৩৩১ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল।


শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি শহরে, থানায়। দীর্ঘদিনের চাপা পড়া ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ শিক্ষার্থীদের হাতেই প্রথম জ্বলে ওঠে। চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী কাঞ্চন। কাঞ্চনের মৃত্যু বারুদে আগুন দেওয়ার মতো বিস্ফোরণ তৈরি করেছিল। 
শেষমেশ জনমতের চাপে ওই শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন বাতিল করে স্বৈরাচারী শাসক। তবে ওই আন্দোলন অচিরেই সামরিক শাসনবিরোধী গণতন্ত্রের আন্দোলনে রূপ নেয়।  আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি বাম দলগুলোও মাঠে নামে। তৈরি হয় প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট। পরবর্তী সময়ে ১৫ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে বামপন্থিরা গড়ে তোলে ৫ দলীয় জোট। চলে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলের যুগপৎ ধারার আন্দোলন; যা ১৯৯০ সালে প্রলয়ঙ্করী এক গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে এরশাদের অবৈধ শাসনের অবসান ঘটায়। সাময়িক সময়ের জন্য হলেও আন্দোলনের অন্যতম শহীদ নূর হোসেনের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে মুক্তি পায় গণতন্ত্র, নিপাত যায় স্বৈরাচার।


তবে ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার নিপাত গেলেও স্বৈরতন্ত্র নিঃশেষ হযনি। ১৯৯৫-৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আন্দোলন, ২০০৭-০৮ সালে ১/১১ রূপী ছদ্মবেশী সেনাশাসন এবং সর্বশেষ ২০২৪-এর শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান সে কথাই বলে। বর্তমানে রাষ্ট্র একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনও নিশ্চিত নয়, সেই ক্লডিয়াসের মতো কোনো স্বৈরশাসক ভবিষ্যতে এখানে আবারও চেপে বসবে কিনা। এরশাদের মতো কোনো সামরিক শাসকও যে ফিরে আসাবে না, তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। ফলে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি এখানে যেমন স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস প্রাসঙ্গিকভাবেই পালিত হয়, তেমনি ভ্যালেন্টাইন ডে পালনও অপ্রয়োজনীয় নয়।


আমাদের প্রত্যাশা স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের মতো ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ও যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে পালিত হবে। বাণিজ্য নয়, মানুষের অধিকার সুরক্ষার প্রতিজ্ঞা এতে প্রাধান্য পাক। সবার মুখে হাসি ফোটানোর প্রেরণাকে দৃঢ় করতে মানুষে মানুষে ভালোবাসার সানাই বেজে উঠবে– এটিই কামনা।   


রিয়াজ মাহমুদ: কবি ও প্রাবন্ধিক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ য ল ন ট ইন ১৪ ফ ব র য় র দল য় জ ট র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

এত বড় লোকসানের বোঝা সইবেন কী করে

ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে সাড়ে সতেরো কোটি মানুষের খাবারের জোগান নিশ্চিত করা যেকোনো সরকারের জন্যই বিশাল চ্যালেঞ্জের কাজ। রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, মূল্যস্ফীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি—এ সবকিছু ছাপিয়ে বড় কোনো বিপর্যয় ছাড়াই এ দেশের মানুষ এখনো টিকে আছে, তার সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের। অথচ দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে সবচেয়ে অবহেলার শিকার হন তাঁরা। এবার আলুচাষিরা তাঁদের উৎপাদিত আলু নিয়ে যে সীমাহীন দুর্ভোগ ও লোকসানের মুখে পড়েছেন, তাতে মনে হতেই পারে, আলু উৎপাদন করে তাঁরা কি অপরাধ করে ফেলেছেন?

আমনের মৌসুমে দফায় দফায় বন্যা হওয়ায় চালের উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় বাজারে চালের দাম এখন গত বছরের তুলনায় কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি। এ অবস্থাতেও শীতের সবজির ওপর ভর করে প্রায় দুই বছর পর গত মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১০-এর নিচে নেমেছে। এ ক্ষেত্রেও প্রধান অবদান কৃষকের। কিন্তু শীতের সবজি চাষে এ বছর তাঁরা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন। এবার পেঁয়াজ উৎপাদনেও কৃষকেরা চমক দেখিয়েছেন, ফলে ভোক্তারা তুলনামূলক কম দামে পেঁয়াজ কিনতে পারছেন। কিন্তু পেঁয়াজেও কৃষকেরা উৎপাদন খরচ তুলতে পারেননি। আলুর ক্ষেত্রেও কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না।

এবার যে আলুর উৎপাদনও বেশি হবে, সেই পূর্বাভাস আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। আগাম বুঝতে পেরে হিমাগারের মালিকেরা সিন্ডিকেট করে হিমাগারের ভাড়া বাড়িয়ে দেন। কৃষকেরা মানববন্ধন করে, রাস্তায় আলু ফেলে প্রতিবাদ করে হিমাগারের ভাড়া কমানোর দাবি জানান। সরকার কিছুটা ভাড়াও কমান। কিন্তু প্রথম আলোসহ অন্যান্য গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, আলু সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে হিমাগারের মালিকেরা কৃষকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। আলু সংরক্ষণের অনুমতিপত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত কতটা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে পারবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অধিকাংশ আলুচাষি।

হিমাগারের ভাড়া বৃদ্ধি এবং হিমাগারে সংরক্ষণের অনুমতিপত্র না পাওয়ায় কৃষকদের মাঠ থেকেই তাঁদের আলু বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। ১ কেজি আলু উৎপাদনে যেখানে কৃষকদের খরচ হয়েছে ২২ থেকে ২৫ টাকা, সেখানে মাঠ থেকে মাত্র ১৪ টাকায় বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। এত বড় লোকসানের বোঝা তাঁরা সইবেন কী করে!

শীতের সবজি, পেঁয়াজ ও আলুর দাম এতটা পড়ে যাওয়ার পেছনে হঠাৎ করেই হিমাগারের ভাড়া বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি উঠেছে। সরকার যদি একের পর এক ফসলে কৃষকের এই ক্রমাগত লোকসানের দিকে নজর না দেয়, তাহলে স্বল্প মেয়াদে বাজারে স্বস্তির দেখা মিললেও দীর্ঘ মেয়াদে বড় সংকট তৈরি করবে। হিমাগারের মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে কেন হাজার হাজার কৃষক লোকসানের মুখে পড়বেন? সরকারকে অবশ্যই কৃষকদের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ