দু’হাত ছড়িয়ে পড়ে আছেন মানুষটি, চিৎ হয়ে। পল্টনের রাস্তায় ডান পা’টা ঈষৎ বাঁকা তাঁর, ভাঁজ হয়ে আছে; বামটা অপেক্ষাকৃত উঁচু, হাঁটু জেগে আছে আকাশে। কেবল চশমাটি আগের মতোই, সেঁটে আছে চোখে, সামান্যতম নেমে আসেনি নাকে। চোখ দুটো বোজা তাঁর, পুরোপুরি। তবু মনে হচ্ছে– কিছু একটা দেখছেন তিনি, গভীর মনোযোগে, প্রগাঢ় ভাবনায়, এবং হঠাৎ মনে হলো– কিছুক্ষণের জন্য চোখ দুটো খুলে ফেললেন তিনি, পিটপিট করলেন, ভালো করে দেখে নিলেন সামনের ওই জিনিসটা। অথচ এক ঘণ্টা সাত মিনিট আগে মারা গেছেন মানুষটি, একজন মানুষের ভালোবাসার মূল্য দিতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন নীরবে!
গল্প শুরু
প্যান্টের ডান পকেটে ডান হাত ঢোকালেন আবার মকবুল– না, জিনিসটা এখনও আছে, ছোট্ট একটা প্যাকেটে। কিছুটা নির্ভার হলেন তিনি, চোখ দুটোতেও সন্তুষ্টি, তৃপ্তির একটা আভা খেলে গেল দ্রুত। অনেকদিন পর তিনি খুঁজে পেয়েছেন এগুলো। খুব আহামরি কিছু না, দামি তো নয়ই, তবু সমস্ত অবয়ব সচেতন করে রেখেছেন, যেন হারিয়ে না যায়, অন্তত পকেট থেকে কেউ নিয়ে না নেয় চুপিচুপি।
তাঁর এই সচেতনতার একটা কারণ আছে। এই শহরে এসেছিলেন তিনি প্রায় নয় বছর আগে, চারবার পকেটমার হয়েছে নীরবে। টাকা ছিল সেই হারানোতে, মোবাইল ছিল, ছিল সদ্য কিনে আনা একটা নেইলকাটারও।
সতেরোবারের মতো পকেটে হাত ঢোকালেন মকবুল। পল্টনের এই জায়গাতেই তিনবার পকেট সাফা হয়েছে তাঁর। তাই সাবধান হলেন আরও একটু। পকেটে হাত ঢোকালেন আবার, বের করলেন না আর, ঠেসে হাঁটতে লাগলেন সামনের দিকে। আরও একটু এগিয়ে যেতেই কিছুটা ভয় পেলেন মকবুল। বাম হাতে ছোলা মেশানো মুড়ির ঠোঙাটা স্থির ছিল এতক্ষণ, পকেট থেকে ডান হাতটা বের করলেন দ্রুত, মুড়ি ঢাললেন সেখানে, মুখে দিতে নিতেই থেমে গেলেন। কিছু একটা আঁচ করলেন তিনি। বাম পাশের লম্বা দালানটা পেরোলেন ফুটপাতে রাখা জিনিসিপত্রের ফাঁক দিয়ে, মস্ত মাঠটার দিকে যাবেন, সেখান দিয়ে পাশের রাস্তা, ঠিক তখনই চোখে পড়ল দৃশ্যটা– প্রবল উত্তাপে মারামারি করছে যেন কারা, সঙ্গে পুলিশ! পকেটের জিনিসগুলোর চিন্তায় এতক্ষণ মগ্ন ছিলেন, খেয়াল করেননি অন্যকিছু এবং এতগুলো মানুষ যে অমানবিক সংঘর্ষে মেতে উঠেছে, টের পাননি তার একটুও।
প্রচণ্ড চিৎকার শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে, চারপাশে শীত শেষের ধুলো, এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছেন কাছে থাকা মানুষগুলো, পালানোর আপ্রাণ চেষ্টা সকলের। দ্বিধা এসে ভর করল পায়ে, আলস্যও হলো একটু। একধরনের আড়ষ্টতা এলো শরীরে, সামনে এগুবেন কি এগুবেন না, না পাশ কেটে যাবেন, কিংবা পেছনের রাস্তা দিয়ে লুকিয়ে পড়বেন মার্কেটে, সিদ্ধান্তহীনতায় কেটে গেল কয়েক সেকেন্ড। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল হঠাৎ মকবুলের।
দৌড়ানো মানুষগুলোর কতগুলো মানুষ দৌড়ে আসছে তাঁর দিকে, ঠিক তাঁরই দিকে, পেছন পেছন আরও কয়জন– তাঁর অন্তত তাই মনে হলো। এ মুহূর্তে ঠিক কী করা দরকার, কী করা উচিত, ভেবে পেলেন না তিনি ঝট করে। একটু পর খেয়াল করলেন– মাঠের সমস্ত মানুষ ছুটে আসছে তাঁর দিকে, সঙ্গে পুলিশ, মাঠের ধুলো, ঝরে পড়া মেহগনি আর কড়ই পাতা, মাঠে ছড়িয়ে থাকা চিপসের প্যাকেটগুলোও। টের পেলেন– পুরো আকাশটাও ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘসহ গিলে ফেলতে চাচ্ছে তাঁর পুরো দেহ।
পকেটে হাত ঢুকাতে চাইলেন আবার মকুবল, কিন্তু হাতবোঝাই মুড়ি। যদিও পকেটের জিনিসটার চেয়ে এখন নিজেকে রক্ষা করা দরকার, মাথা সায় দিল, তাড়না পেলেন ভেতরে। এবং এও টের পেলেন– যত দ্রুত সম্ভব সরে পড়া উচিত এখান থেকে, আড়াল করা দরকার নিজেকে, সামনে সমূহ বিপদ! সম্ভবত চরম বিপদ!
পুরো শরীরটা ঘুরিয়ে ফেললেন মকবুল, বাঁ পাশের চিকন গলিটা চোখে পড়ল হঠাৎ। সামনে, ফুটপাতে সাজিয়ে রাখা ইলেকট্রিক জিনিসগুলো পেরিয়ে যেই না ঢুকতে যাবেন গলিতে, ঠিক তখনই একটা ধাক্কা খেলেন, ডান কাঁধের ইঞ্চিচারেক নিচে, একটু মেরুদণ্ডের দিকে– কী একটা ঢুকে গেল হঠাৎ! ধাতব, গরম এবং কষ্টদায়ক।
পুরোই স্থির হয়ে গেলেন মকবুল। মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন ব্যথা থেকে ব্যথাতুর হয়ে যাওয়া জায়গাটা। পারলেন না, বরং টলে উঠলেন, ঘুরে দাঁড়ালেন পুরো শরীর বাঁকিয়ে, দু-এক কদম এগিয়েও গেলেন সামনের দিকে, তারপর পড়ে গেলেন মাটিতে, একটু গড়িয়েও গেলেন ফুটপাত ঘেঁষে, তারপর চিৎ হয়ে গেলেন রাস্তায়। কেউ কিছু খেয়াল করার আগেই বিসমিল্লাহ ইলেকট্রনিক্সের কার্নিশে বসা দুটো কাক টের পেল– রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষটির হাতের ঠোঙাটা থেকে বেশ কিছু মুড়ি পড়ে গেছে রাস্তায়, বাতাসে চলে যাচ্ছে দূরে, কিছু মুড়ি পিষেও ফেলেছে দৌড়ে আসা পাগুলো। বিস্তীর্ণ পড়ে থাকা খাবারগুলোর দিকে আরও একবার আড়চোখে তাকাল কাক দুটো। একুশ ফুট উপরে, আপাত নিরাপদ ওই জায়গাটা থেকে নেমে এসে খাবারগুলো মুখে নেওয়া ঠিক হবে কি-না, তা নিয়ে একটু ভাবল তারা, দুই জোড়া ঠোঁট কাছাকাছি এনে কী যেন বললও পরস্পর, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারল না তাৎক্ষণিক।
বাতাসে সরে যাচ্ছে মুড়িগুলো, দ্রুত; দূরে, আরও দূরে।
২
রাস্তায় পড়ে গিয়েই ঝট করে সামনে তাকালেন মকবুল। হালকা ধোঁয়ার মতো বায়বীয় কী যেন একটা বের হয়ে যাচ্ছে তাঁর শরীর থেকে, অনেকটা বুকের মাঝখান থেকে। কিন্তু প্রথমদিকে বোধগম্য হলো না– জিনিসটা কী। চোখ দুটো সামান্য প্রসারিত করলেন, কষ্ট হলো এতে অবশ্য, কিন্তু বুঝতে পারলেন তখনই– ওটা তাঁর আত্মা, তাঁর বেঁচে থাকার আদি ও অকৃত্রিম উপাদান।
চোখ দুটো সরু হয়ে এলো মকবুলের, চৌত্রিশ বছর বুকের ভেতর থাকা জিনিসটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাঁকে, মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে! কী মনে করে আত্মাটা একবার ফিরে তাকাল মকবুলের দিকে, তাঁর আধো বুজে আসা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে করুণা হলো, ভালোবাসাও অনুভূত হলো খানিকটা। চলে যাওয়া থামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে, দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে ফিরে এলো মকবুলের কাছে, সরাসরি ঢুকে গেল বুকের ভেতর, যেখানে এতদিন ছিল, ঠিক সেখানে।ডান হাতের তর্জনীটা একটু নড়ে উঠল মকবুলের। সঙ্গে সঙ্গে তিনি টের পেলেন– কে যেন ফিসফিস করছে কানের কাছে।
কানটা আরও একটু পেতে দিলেন তিনি, স্থিরও হলেন খানিকটা। যদিও চারপাশে বেশ কোলাহল। এরই মধ্যে কেডস পায়ের একজন দৌড়ে গেল তাঁর পাশ দিয়ে, অল্পের জন্য বাঁ হাতটা চাপা পড়েনি, আলতো সরিয়ে নিলেন তিনি তার আগেই।
‘মকবুল?’
‘উহ্।’ অস্ফুট স্বর মকুবলের।
‘পানি খাবে?’
‘খাবো।’
‘ঠান্ডা দেব?’
‘আপনি কে?’
গাম্ভীর্যময় একটা হাসি শোনা গেল কানের কাছে, অনেকটা রিনিরিনি শব্দের মতো। কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর আগের মতো ফিসফিসানি, ‘কী আশ্চর্য, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না! অথচ চৌত্রিশটা বছর তোমার সঙ্গে ছিলাম আমি, তোমার খুব নিকটে, ভেতরে।’
‘কাছের জনদের মানুষ সাধারণত চিনতে পারে!’
‘ঠিক।’ আবার থেমে গেল কণ্ঠটা, ‘তোমার পকেটের জিনিসটার কী হবে এখন?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘জিনিসগুলো তুমি যার জন্য তীব্র ভালোবেসে নিয়ে এসেছিলে, তাকে দিতে চাও?’
‘চাই।’
‘তুমি নিজে দিতে চাও?’
‘জি।’
‘ওকে, তোমাকে সেই সুযোগটা দিতে চাই আমি, কেবল তোমার এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে, যদিও মৃতদের কোনো সুযোগ থাকে না।’
ডান হাতের আঙুল আরও একবার নড়ে উঠল মকবুলের। তাঁর যে প্রচণ্ড পানি পিপাসা পেয়েছে, বুঝতে পারল সেটাও। ঠোঁট দুটো চাটার চেষ্টা করল একবার, পারল না। গলার কাছে কী একটা পোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে, শিরশির করছে জায়গাটা। একবার মনে হলো চুলকিয়ে নেবে, পারল না সেটাও।
‘তুমি কি কিছু ভাবছ?’
‘জি।’
‘কী ভাবছ?’
‘মৃতদের কোনো সুযোগ থাকে না, সম্ভবত এজন্যই মানুষ জীবিতকালে সব সুযোগ বুঝে নিতে চায়।’
‘সেটা অন্যায় করে হলেও।’
‘অমি কি একটু উঠে বসতে পারি?’
‘না, সেই সুযোগ নেই তোমার। ওই যে বললাম– মৃতদের কোনো সুযোগ থাকে না। তবে তোমাকে একটা সুযোগ দেব আমি, অন্য সুযোগ।’ কণ্ঠটি কিছুটা বিমর্ষ স্বরে বলল, ‘একটা গন্ধ পাচ্ছ তুমি?’
নাক টানার চেষ্টা করল মকবুল, পারল না। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে কিছু বুঝে ওঠার চেষ্টা করল, পারল না এবারও। কিছুটা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘না, পাচ্ছি না। আচ্ছা, কীসের গন্ধের কথা বলছেন আপনি?’
‘তোমার নিজের গন্ধের। তোমার ভেতরটা পচে যেতে শুরু করেছে, আস্তে আস্তে পচে যাচ্ছে, তার একটা গন্ধ বের হচ্ছে একটু একটু।’
‘মানুষ শেষ পর্যন্ত পচে যায়!’
‘বেঁচে থাকতেও যায়, মরে গেলেও তো যায়-ই। আপাতত থাক ওসব। তুমি বরং একটা কাজ করো।’
‘কী?’
‘বাড়ি চলে যাও।’
‘কীভাবে?’ আশা-নিরাশা মিশ্রিত গলা মকবুলের, ‘আমি তো মরে গেছি!’
‘যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করছি।’
‘আমি কি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারব?’
‘না।’
‘আমার মেয়ের সঙ্গে?’
‘না।’
‘আমার অন্ধ মায়ের সঙ্গে, বাসায় ফিরলেই, পায়ের শব্দ পেয়েই যে মা চিৎকার করে ওঠে– মকবুল, বাপ আইছস? দুপুরে ঠিকমতো খাইছিলি?’
কণ্ঠটি কিছু বলছে না। মকবুল দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করল, ‘আমার মায়ের সঙ্গে?’
‘না-আ-আ।’ প্রলম্বিত গলায় উত্তর দিল কণ্ঠ।
‘তাহলে?’
‘তুমি তোমার সঙ্গে কথা বলবে।’
‘আমার সঙ্গে!’
কণ্ঠটি হেসে উঠল, রহস্যময় হাসি। গলার কাছে পোকাটা আবার ফিরে এসেছে, বিড়বিড় করছে ওটা, শিরশির করছে জায়গাটা। মকবুল নিজের ঠোঁট দুটো চাটার চেষ্টা করলেন আবার, পারলেন না এবারও।
‘আমি কি এখনই বাড়ি যাব?’ উদগ্রীব হয়ে বলল মকবুল।
‘তার আগে একটা কাজ করতে হবে তোমাকে।’
‘মৃত মানুষ তো কোনো কাজ করতে পারে না।’
‘তুমি পারবে।’
মকবুল টের পেল– কে যেন হাত টেনে ধরল তাঁর, উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বাম দিকে তাকালেন, একটা হাত টেনে ধরছে তাঁর বাম হাত, বুঝতে পারছেন, কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন না হাতটা। পেছনের দিকে একটা ফুটপাত, সেটা ঘেঁষে একটা কড়ইগাছ। হাতটা সেখানে নিয়ে এলো তাঁকে, দাঁড় করাল, ফিসফিস করে কণ্ঠটি এবার বলল, ‘তাকাও, নিজেকে দেখো।’
পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তায় পড়ে আছেন মকবুল, দুই হাত দু’দিকে ছড়িয়ে। তার ঠিক বাইশ-তেইশ হাত দূরে, অল্প পাতার কড়ইগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আরেক মকবুল– দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান মকবুল, দুজন মকবুল।
হঠাৎ বিকট চিৎকার!
কড়ইগাছের ছায়ায় দাঁড়ানো মকবুল দেখলেন– কতগুলো মানুষ এলো তাঁর লাশের কাছে, ভাগ হয়ে গেল তারা দু’দলে। এক দল বাম হাত টেনে ধরল তাঁর, ডান হাত আরেক দল। দুই পা চেপে ধরল দু’দল। তারপর টানাটানি– এ আমাদের লোক; না, আমাদের লোক .
মকবুল আরও দেখলেন– তাঁর দেহ থেকে ছিঁড়ে গেল প্রথমে পরনের শার্টটা, টুকরো হলো, খুলে গেল প্রায় পুরোটা, ঝুলে রইল ছোটকালে গাছের ডালে সুতা কাটা ঘুড়ির মতো। খুলে গেল তাঁর প্যান্টটাও, সঙ্গে জুতো জোড়াও। কেবল ছোট্ট অন্তর্বাসটা সেঁটে রইল শরীরের সাথে, যার কোনার দিকটায় ছোট্ট একটা ফুটো হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।
চিৎকার করে উঠতে চাইলেন মকুবল, পারলেন না। বাম হাত চেপে ধরা হাতটা পিঠে উঠে এলো তাঁর, বুলাতে লাগল সেখানে– সান্ত্বনা আর প্রশ্রয়ের মিশ্রণে যা বোঝাতে চাইল, তা বুঝতে পারলেন তিনি, কিন্তু মানলেন না, মেনে নিতে পারলেন না।
টানাটানির শেষ পর্যায়ে অর্ধনগ্ন মকবুলকে ছিনিয়ে নিল এক দল, চিৎকার দিয়ে উঠল তারা– আমাদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, বৃথা যেতে দেব না ...। বিসমিল্লাহ ইলেকট্রনিক্সের কাক দুটো মুগ্ধ বিস্ময়ে সবকিছু দেখছিল এতক্ষণ, এই প্রথম কা কা করে উঠল তারা। তাদের কা কা-তে বিরক্তি আছে, মানুষের প্রতি করুণা আছে, লজ্জা পাওয়ার আভাও আছে।
দু’চোখ ভিজে উঠতে চাইল মকবুলের, কিন্তু মুশকিল হলো– মৃত মানুষ কাঁদতে পারে না, মৃত মানুষ কখনও কাঁদে না।
৩
বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন মকবুল, এ তাঁর নিজের বাড়ি। প্যান্টের পকেটে যথারীতি হাত ঢোকানো আছে তাঁর। কিন্তু সামনে তাকিয়েই চমকে উঠলেন তিনি। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল তাঁর, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো, পাতা ঝরা মৃত গাছের মতো স্থির হয়ে রইলেন একেবারে– তাঁর লাশটার পা কাটা হয়েছে, দু-দু চার টুকরো; হাত দুটোও চার টুকরো। কী এক অদ্ভুত কৌশলে সেগুলো দিয়ে সিঁড়ি বানালেন তারা, অনেকটা মইয়ের মতো। সেই মই বেয়ে উপরে উঠলেন সবাই, অন্যরকম সেই জায়গাটা, ঝলমলে, রঙিন। সবার চোখে-মুখে আনন্দ, আলো ঝলকানি।
মকবুলের হাত-পা-শরীরের মইটা নিয়ে কী একটা চমৎকার প্রক্রিয়ায় একটা চেয়ার বানিয়ে ফেললেন তারা একটুপর। চেয়ারের পেছন দিকটা উঁচু, দুটো হাতল আছে, পা চারটা নকশা-কাটা, আর বসার জায়গাটা নরম কুশনের, মখমল কাপড়ের।
সবার মাঝখান থেকে সামনে থাকা মানুষটা এগিয়ে এলেন, চেয়ারে বসলেন, সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠল সবাই। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল প্রত্যেকে– আমার নেতা তোমার নেতা ...।
চেয়ারে বসা নেতার মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল, আমুদে হয়ে উঠল তাঁর পুরো চেহারা, ঠোঁট দুটোতে কেমন একটা বিজয়ীর হাসি। ডান হাতটা উঁচু করলেন তিনি। অভিবাদনের জবাবে শব্দ আরও বেড়ে গেল, লম্বা হলো বাক্য– মহান মহান মহান নেতা, আমার তোমার জানের নেতা ...।
সামনে দাঁড়ানো আম পাবলিকের দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে মহান নেতার আটকে গেল চোখ দুটো, স্থির হলেন তিনি মকবুলের দিকে, করুণা আর ক্ষমতা মেশানো হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঠিক সেই মুহূর্তে চেয়াররূপী মকবুল সোজা হলেন, দাঁড়িয়ে পড়লেন নিজ পায়ে, এগিয়ে এলেন পকেটে হাত রাখা মকবুলের দিকে। আলতো করে হাত রাখলেন তাঁর গালে, চিবুকে, চোখে। তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘মৃত মানুষ কোনো কাজ করতে পারে না ঠিক, কিন্তু মানুষকে ক্ষমতায় বসানোর ক্ষমতা রাখে সে।’
দুই মকবুল তাকিয়ে আছেন পরস্পরের দিকে, মুখোমুখি তারা এখন। পকেটে হাত ঢোকালেন আবার মকবুল, ঘুরে দাঁড়ালেন। ঠিক সেই মুহূর্তে সেই কাক দুটো উড়ে গেল তাঁর উপর দিয়ে, পিচিং করে কিছু ঢেলে দিল তাঁর মাথায়, যেমনটা ফুলার রোডে থাকা নূর হোসেনের পাথুরে মাথায় ঢালে তারা প্রতিদিন।
হাতটা এখনও পকেটে ঢোকানো মকবুলের। তাঁর বউটা আবার পোয়াতি। পুরান ঢাকার অশ্বিনী কার্তিকের শুকনো টক বরইয়ের আচার খেতে চেয়েছিল সে একদিন, ভালোবাসতে বাসতে মিষ্টি হেসে তা বলেছিল তাঁকে ফিসফিসিয়ে।
আচারটা আর দেওয়া হলো না বউকে!
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল ন মকব ল ল মকব ল র ত র একট আম দ র ক জ কর একব র উঠল ত ত রপর করল ন
এছাড়াও পড়ুন:
নাইকো মামলার রায় ১৯ ফেব্রুয়ারি
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে করা নাইকো দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার জন্য ১৯ ফেব্রুয়ারি ধার্য করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার দুদক ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম এ তারিখ ধার্য করেন।
এদিন আসামি পক্ষ আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে। পরে বিচারক দিন ধার্য করেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবী হান্নান ভূঁইয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এ মামলায় ৬৮ সাক্ষীর মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৩৯ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। ৫ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়।
কলেজ শিক্ষক মুকিবসহ পাঁচজন রিমান্ডে
নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের লিফলেট বিতরণের অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় কলেজ শিক্ষক মুকিব মিয়াসহ পাঁচজনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
রিমান্ডে নেওয়া অন্যরা হলেন– যুবলীগের সদস্য কপিল হালদার সজল, মতিঝিল থানা যুবলীগের সদস্য কেএম সাইফুল খান, ফতুল্লা থানা যুবলীগের সদস্য শেখ মোহাম্মদ হাফিজ ও মোনালিসা জুঁই। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম মনিরুল ইসলাম এ আদেশ দেন।