গ্রাম কিংবা শহর– যেখানেই থাকুন, যারা এই মুহূর্তে শহর থেকে পড়ছেন চলুন আপনাদের গ্রামে নিয়ে যাই এবং যারা গ্রাম থেকে আমাকে পড়ছেন পরে তাদের শহরে নিয়ে আসব। এক নিভৃত গ্রামে ফিরি সবাই! চারপাশে সবুজ, মাঝখানে একটিমাত্র বাড়ি, যেন গ্রামটাই বাড়িটার চারপাশে গড়ে উঠেছে। সীমানা বলতে শুধু গাছপালা আর খালের কোলঘেঁষে নরম মাটির পথ, যেখানে শিশির কিংবা বৃষ্টিতে ভেজা ঘাসে পা রাখলে মনে হয় শীতলতা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। শীতের ভোরে কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যের আলো প্রথম স্পর্শ করে বাড়িটার খোলা উঠানটাকে। মোরগের ডাকই এখানে ঘুম ভাঙার অ্যালার্ম। এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল নিমগাছটায় বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসাগুলো হাওয়ায় দুলতে থাকে। সোনালি আলোয় ঝলমল করা খালপাড়ের বুনো ঘাসে লাল ফড়িংগুলো থেমে থেমে বসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে কোথাও। খালটা শান্ত, মাঝে মাঝে বাতাসে ঢেউ খেলে যায়। একপাশে একটা বাঁশের সাঁকো, যার ওপারে ধানক্ষেত, আর এপারে শুধু এই বাড়ি। পুরো গ্রাম এই একটিমাত্র বাড়িকে ঘিরেই বেঁচে আছে– একান্ত, একাকী, অথচ জীবনের অনবদ্য ছন্দে ভরা। এ বাড়ির প্রসঙ্গ এবার রাখি! গ্রামের একমাত্র কবরস্থানটি চেনা যাক এবার। গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে, উঁচু টিলার মতো এক জায়গায়, যেখানে যেতে হলে সরু একটা মাটির পথ ধরে উঠতে হয়। কবরস্থানের পাশেই গভীর আন্ধার, গিরিখাতের মতো খাড়া খাদ, যেখানে ঝোপঝাড়ের ঘন আন্ধারের ভেতর সাপখোপ আর বনজঙ্গলের ছায়া লুকিয়ে থাকে। বড় বড় কয়েকটা কদম আর কৃষ্ণচূড়া গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ছায়ায় পুরোনো কবরগুলো ঢেকে গেছে। সন্ধ্যার পর এই জায়গাটা আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে। আন্ধির পারে বসে থাকা নিশাচর পাখিরা কেমন যেন শোকভরা ডাক দেয়, বাতাসের ভেতর একটা শিরশিরে অনুভূতি। গ্রামে কারও মৃত্যু হলে এখানেই তাকে সমাহিত করা হয়, আর নামাজ শেষে নেমে আসা মানুষগুলো হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে, এই পথ একদিন সবার জন্যই নির্ধারিত। এই গ্রামে কোনো হিন্দু পরিবার নেই, তাই শ্মশানও নেই। কবরস্থানটাই চিরদিনের মতো এখানে থাকার একমাত্র ঠিকানা। গ্রামের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত– জীবিতরা একসঙ্গে, মৃতরা আরেক সঙ্গে!
দুই.


কবরস্থানটা যেন তাদের প্রেমের এক অদৃশ্য প্রেরণা। মদিনার বাড়ি ওপারে, আতার বাড়ি এপারে। মাঝখানে এই ঘাট! দিনের বেলা কবরস্থান ঘিরে থাকে নীরব ভয়, অথচ সন্ধ্যা নামতেই তার গা ঘেঁষে জীবনের সবচেয়ে লুকোনো আবেগ। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার আন্ধারের একটু আগে আতা আর মদিনা চুপিচুপি বের হয়, যেন কারও নজরে না পড়ে। গাছগাছালির আড়াল দিয়ে সরু পথ বেয়ে তারা চলে আসে কবরস্থানঘেঁষা জঙ্গলে। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে দুজন, কখনও পাশাপাশি, কখনও মুখোমুখি। আতাকে দেখলেই মদিনার চোখ চকচক করে ওঠে, যেন দিনের জমে থাকা অপেক্ষা মুহূর্তেই ঝিলিক দেয়। আতা ওর হাতটা ধরে ফিসফিস করে, ‘কেমন আছো?’ মদিনা হাসে, ‘যেমন প্রতিদিন থাকি, তোমার জন্য অপেক্ষায়।’ বাতাসে নিমপাতার গন্ধ, কোথাও বাবুই পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। আতা মদিনার গাল ছুঁয়ে বলে, ‘এত সুন্দর কেন তুমি?’ মদিনা মাথা নিচু করে হাসে, ‘সুন্দর যদি হই, তবে সেটা তোমার চোখে।’ কখনও মদিনা আতার কাঁধে মাথা রাখে, চুপচাপ শোনে বুকের ভেতরকার হৃৎস্পন্দন। কবরস্থানের পাশে বসে থাকা, যেন জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে তারা একটু ভালোবাসার আশ্রয়ে। সন্ধ্যা গাঢ় হলে আতা বলে, ‘আজ যাব না, এখানেই থাকব সারারাত!’ মদিনা চোখ বড় করে তাকায়, ‘পাগল! মরণের পর সারারাত দুজনে থাকব!’ আতা মৃদু হাসে, ‘আমাদের ভালোবাসার কথা কেউ জানুক না জানুক, এই কবরস্থান জানে। এই গাছগুলো জানে।’ ঠিক বলেছ। আমরা এখানে ছিলাম, থাকব, হয়তো একদিন এই কবরস্থানে পাশাপাশি শুয়ে থাকব ...। মদিনা আতার ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখে, ‘এসব বলে না। আমরা বেঁচে থাকব, অনেকদিন, একসাথে।’ হালকা বাতাস বয়ে যায়, আন্ধা লাল ফড়িং দুটো তাদের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে ঝোপের মধ্যে ঝাঁপ দেয়। খালপাড়ে ঝপাঝপ জল ছিটানোর শব্দ হয়। কেউ একজন টর্চের আলো ফেলে মাছ ধরছে। আলোটা কখনও পানির ওপর পড়ে চকচক করে ওঠে, কখনও ঘোর অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। আতা আর মদিনা মুহূর্তেই থমকে যায়, ঝোপের ভেতরে নিজেদের আরও গভীরে লুকিয়ে নেয়। 


মদিনার নিঃশ্বাস থেমে গেছে। আতা ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে। রাতের হালকা বাতাসে নিমপাতার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ওপরে আকাশজুড়ে গোল চাঁদ, নিখুঁত, নির্মল। আলো এসে ঝোপের পাতায় পড়ছে, আতার চোখে তারার মতো জ্বলছে মদিনাকে ঘিরে থাকা আবেগ। টর্চের আলো খালের পানিতে নেমে গিয়ে আবার উঠে আসে, একটু একটু করে কাছাকাছি আসে তাদের লুকানোর জায়গার দিকে। মদিনা কাঁপতে কাঁপতে আতার গায়ে আরও সেঁটে যায়। আতা ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করে, ‘ভয় পেয়ো না, কেউ কিছু দেখবে না।’ মদিনা তবু শিহরিত। শুধু ভয় না, ভালোবাসার এক অদ্ভুত শিহরণও মিশে আছে ওর মধ্যে। আতা এত কাছে, ওর গায়ের উষ্ণতা শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে, হৃৎস্পন্দনের শব্দও যেন শোনা যায়। মদিনার বুক ধকধক করছে, আতার নিঃশ্বাস গালে লাগছে। টর্চের আলো ধীরে ধীরে সরে যায় অন্যদিকে। ক্রমশ দূরে সরতে থাকা পা-ধারী কারও গলা শোনা যায়, ‘এদিকে মাছ নাইরে!’ আতা আর মদিনা স্থির হয়ে থাকে। ওপরে চাঁদ ঝকমক করছে, তাদের গোপন প্রেমের পাহারাদার হয়ে। মদিনা ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি থাকলে ভয় লাগে না।’ আতা মুচকি হাসে। তারপর বলে, ‘সারাজীবন পাশে থাকব, কবরের এপারে, ওপারে– যেখানেই থাকি।’ খালের পানি শব্দ করে বয়ে চলে। আরেকদিনের মতো সন্ধ্যার আন্ধারে তারা একে অপরকে একটু ছুঁয়ে নিয়ে, একটু অনুভব করে, আবার যে যার বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে, পরের সন্ধ্যার অপেক্ষায়।
তিন.
অমাবস্যার রাতে ভালোবাসা আর শূন্যতার এক সাক্ষাতের জন্য চল্লিশ দিন কেটে গেছে! চল্লিশ রাত, একেকটা রাত যেন আরও দীর্ঘ, আরও ভারী। মদিনা আর আতা কবরস্থান ঘেঁষা সেই জঙ্গলে যায়নি, যেতে পারেনি। মদিনার দাদি ওকে ছোট থেকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছে, ঘুমপাড়ানি গান, ছড়া গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছে, কপালে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। সেই হাত এখন আর নেই। সেই গলার স্বর আর কোনোদিন শোনা যাবে না। আজ রাতে, চল্লিশার পরে, মদিনা আর আতা আবার এখানে এসেছে। কিন্তু আজকের রাত আলাদা। আজ অমাবস্যা। চারপাশে ঘন আন্ধার, যেন পৃথিবী আজ আলোকে ভুলে গেছে। আর সব মনে পড়া মদিনা আর আতার! কবরস্থানের বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটা আন্ধারের আবরণে আরও রহস্যময়, তার পাতার নিচে যেন হাজার বছরের পুরোনো ছায়া লুকিয়ে আছে। বাতাস থেমে আছে, যেন শোকের ভারে দম আটকে গেছে। মদিনা ধীরে ধীরে হাঁটে, খালি পায়ে, শব্দহীন। আতা একটু পেছন থেকে ওকে দেখে, এই মেয়েটাকে সে কতবার দেখেছে, কিন্তু আজ যেন ওকে চিনতেই পারছে না। মদিনা ওর দাদির কবরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। খালি চোখে কিছুই দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়, কবরের ওপরে রাখা নতুন মাটির শীতলতা, চারপাশের নীরবতা আর একরাশ হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট। মদিনা হাঁটু গেড়ে বসে, হাত বাড়িয়ে মাটিটা ছোঁয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু যেন ছুঁতে পারে না। ওর আঙুলগুলো মাঝপথে থেমে যায়, কাঁপতে থাকে। একটা নিঃশব্দ আর্তনাদ উঠে আসে ওর বুকের ভেতর থেকে, কিন্তু তা শব্দ হয়ে বেরোয় না। শুধু চোখের জল, নিঃশ্বাসের ভারী টান আর বুকের মধ্যে গুমরে ওঠা কান্না। আতা পাশে বসে, আস্তে আস্তে মদিনার কাঁধে হাত রাখে। কিন্তু কীভাবে সান্ত্বনা দেয়? কীভাবে বলে যে মৃত্যু মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়? যে মানুষটা একদিন আমাদের আঙুল ধরে হাঁটিয়েছে, তার স্পর্শহীনতাই কি সত্য?’ মদিনা ফিসফিস করে, গলার স্বর এতটাই নরম যে বাতাসও হয়তো শুনতে পায় না, ‘আতা, জানো? আমার এখনও মনে হয় দাদি ভেতর থেকে ডাকবে, মদিনা, কই গেলি?’ আতা ওর কপালের ওপর আলতো করে হাত রাখে, যেন স্পর্শ দিয়ে ব্যথা সরিয়ে দিতে চায়। তোমার দাদি তোমার ভেতরেই আছে, মদিনা। আমাদের ভালোবাসার মধ্যে, তোমার শ্বাসের প্রতিটা টানে। যাকে আমরা হারাই, সে আসলে হারায় না। সে থেকে যায়, কেবল অন্যরূপে। মদিনা চাঁদহীন আকাশের দিকে তাকায়। আজ আকাশে কোনো আলো নেই, ঠিক যেমন ওর জীবনে দাদির অস্তিত্ব নেই। আন্ধারে দাদির কবরের দিকে তাকিয়ে সে আরও গভীর আন্ধার দেখতে চায়, কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়, এক অপার শূন্যতা। একটা হালকা বাতাস আসে, যেন কারও শ্বাস ফেলবার শব্দ। নিমগাছের পাতাগুলো একটু দুলে ওঠে। দূরে কোথাও বাবুই পাখির বাসা নড়ে ওঠে, যেন কেউ নিঃশব্দে ওদের শোনার চেষ্টা করছে। মদিনা আরও শক্ত হয়ে আতার হাত চেপে ধরে। ‘আতা, খুব একা লাগছে। তোমার সাথে থেকেও।’ আতা ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন বলে, ‘তুমি একা নও, আমি আছি। যতদিন জীবন আছে, যতদিন ভালোবাসা আছে।’ কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো তাদের নীরবে দেখে, হয়তো দাদির আত্মাও। হয়তো সে মৃদু হাসে, আশীর্বাদ দেয়, আর বাতাসের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ভালোবাসা কখনও মরে না, বোইন গো! এবার বাড়িত যাহ!’ কবরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর মদিনা আর আতা আবার জঙ্গলে ফেরে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, পাতার খসখস শব্দ ছাড়া কিছুই নেই। আতাও নিঃশব্দে পকেট থেকে কিছু একটা বের করে। ‘তোমার জন্য এনেছি।’ সে ফিসফিস করে এবার। মদিনা বিস্মিত চোখে আতার দিকে তাকায়। আন্ধারে সে ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। 
আতা আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছোট্ট একটা আয়না মদিনার সামনে মেলে ধরে। মদিনা হাতে নিয়ে তাকানোর আগেই, ঠিক তখনই ঘটে গেল অবিশ্বাস্য কিছু। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি গাছের গায়ে, প্রতিটি উঠোনে এক ঝলকে আলো জ্বলে উঠল!
আজই প্রথমবার, এতদিনের আন্ধার ভেদ করে, এই গ্রামে এই সন্ধ্যায় বিদ্যুতের আলো এসে পৌঁছাল। সেই আলোই ঝলক মেরে পড়ল আতার আয়নার ওপর। হঠাৎ চিরচেনা গভীর আন্ধারে, মদিনার হাতে ধরা আয়নাটা ঝলসে উঠল! মদিনা বিস্ময়ে কেঁপে উঠল। এক ঝলক, মাত্র এক মুহূর্ত, আয়নায় দেখা গেল এক অপরিচিত মুখ! শুকনো, শূন্য চোখ, এলোমেলো চুল। মদিনা নিজেকে চিনতে পারল না। সেই মুহূর্তের আলোয় সে প্রথমবার নিজের শোকে বিধ্বস্ত চেহারা দেখল। সে হতভম্ব হয়ে এক ধাক্কায় আয়নাটা আতার হাতে ফিরিয়ে দিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘বাড়ি যাব, এখনই!’ আতা অবাক হয়ে যায়, ‘কী হলো? ভয় পেলে?’ মদিনা উত্তর দেয় না। আতা কিছু বোঝার আগেই মদিনা দ্রুত হাঁটা দেয়। আতা তার পিছু নেয়। কিছুক্ষণ বিরাম নেওয়ার পর বিদ্যুৎ চলে এলো আবার। গোটা গ্রাম এতদিন আন্ধারে ডুবে ছিল, রাতের বেলা কিছু দেখা যেত না। কিন্তু আজ হঠাৎ এত আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে গেল, যেন সন্ধ্যাটাই বদলে গেছে। ফেরার পথে আতা আর মদিনা বুঝতে পারল, আজ তারা আর লুকিয়ে নেই। তারা যে লুকিয়ে ছিল, সেই গোপনতা বিদ্যুতের আলোয় এক নিমেষে ধরা পড়ে গেল। গ্রামের কিছু মানুষ দূর থেকে তাদের হাঁটতে দেখল। মুহূর্তে জড়ো হওয়া কৌতূহলী চোখগুলো, কেউ হয়তো দূর থেকে ফিসফিস করে বলল, ‘ওই যে, মদিনা আর আতা! একসাথে ফিরছে!’ এতদিনের লুকোনো ভালোবাসা, এত সন্ধ্যার গোপন সাক্ষাৎ– এক ঝলক আলোর সঙ্গে শেষ হয়ে গেল কী! মদিনার বুক কাঁপছিল। সে আতার হাত শক্ত করে ধরল, ফিসফিস করে কিছু বলার চেষ্টা করল। আতা ধীরে ধীরে মদিনার হাতটাকে নিজের হাতে মুঠো করে ধরল। আন্ধার আবার নেমে এলো, বিদ্যুৎ চলে গেল, কিন্তু সেই কয়েক মুহূর্তের আলো যা দেখিয়ে দিয়ে গেছে, তা আর ফিরিয়ে নেওয়া
যাবে না।
চার.
যা হবার ছিল, তাই হলো।
গ্রামের আলো আসার রাতেই তাদের লুকিয়ে থাকার দিন শেষ হয়ে গেল। মদিনার মা যখন ওকে বাড়ির উঠান পেরিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল, তখনই বোঝা গিয়েছিল, এ সম্পর্ক আর টিকবে না। একদিন পরে, দুই দিন পরে, হয়তো এক সপ্তাহ, তারপর মদিনাকে ওর মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। মদিনা তখনও বোঝেনি, এ শুধু দূরে পাঠানোর জন্য না, এ এক নির্বাসন। আতা এপারে বসে থাকত, কবরস্থানের পাশে, যেখানে তাদের প্রতিটি সন্ধ্যার স্মৃতি গেঁথে আছে। একদিন, দু’দিন, তিন দিন– মদিনার ফেরার অপেক্ষায়। কিন্তু অপেক্ষা শেষ হলো এক দুঃসংবাদে। রাতে খবর এলো, মদিনার বিয়ে হয়ে গেছে। সেই রাতের কথা পরে অনেকেই বলত! মদিনা কিছু বোঝার আগেই, কোনো এক নিকষ কালো রাতে, তার মামারা তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সাজিয়ে বসিয়ে দিল। সে কান্না করেছিল, হাত জোড় করেছিল, অনুরোধ করেছিল, কিন্তু কেউ শোনেনি। মা বলেছিল, ‘এটাই ঠিক, এটাই হওয়া উচিত, এটাই তোমার কপাল।’ সেই রাতে চাঁদ ছিল না, ছিল না কোনো বাতাস। আন্ধারের ভেতর মদিনার কণ্ঠরুদ্ধ কান্না শোনা যাচ্ছিল শুধু তার ঘরের ভেতর। এদিকে আতা যখন সেই খবর পেল, তখন তার ভেতরের সমস্ত আলো নিভে গেল। যদিও গ্রামময় তখন অনেক আলো! সে সোজা শহরের দিকে হাঁটা দিল। গ্রামের কাঁচা পথ পেরিয়ে, খালপাড়ের সরু সেতু পার হয়ে, যেখানে একসময় তারা একসাথে দাঁড়িয়ে থেকেছে, সেই পথ ধরে, আতা একা একা হেঁটে গেল। কেউ তাকে ডাকল না, কেউ পেছন ফিরিয়ে নিল না। পেছনে কবরস্থানের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দাঁড়িয়ে রইল, কেবল বাতাসের অভাবে তার ফুলগুলোও ঝরল না। যেন তার শোকার্ত হওয়ারও অধিকার নেই। আতা শহরে চলে গেল, কিন্তু হৃদয় ফেলে গেল কবরস্থানের জঙ্গলে। যা হবে শেয়াল-কুকুরের খাবার! প্রেমে ব্যর্থ হলে প্রতিটি মানুষই বুঝি এভাবে হৃদয় দান করতে চায়! 
পাঁচ.
এবার শহরে যাওয়া যাক।
শহর মানুষকে নানাভাবে গিলে খায়, কিন্তু আতা বেঁচে থাকল শুধু স্মৃতির মধ্যে। সে ভাবে, মদিনা একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখল। অথবা দেখল না! যদিওবা দেখল, সেই চেহারা; যা এক অমাবস্যার রাতে এক ঝলকের আলোয় দেখেছিল।
ছয়. 
বহু বছর পর, যখন আতার হৃদয়ে অভিমান কিছুটা মিইয়ে আসে, তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় শহর থেকে বাড়ি ফিরবে। মনে মনে ভাবে, হয়তো গ্রামের মানুষ বদলেছে, সময়ের সাথে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। লোডশেডিং কি বেড়েছে? কিন্তু একটাই ছিল, যা পাল্টায়নি, তার পুরোনো প্রেম, মদিনার স্মৃতি। এমনকি শহরের সমস্ত কোলাহল, রাতের বাল্বে ভরা উজ্জ্বল আলোর মাঝে, আতা কখনোই মদিনাকে ভুলতে পারেনি। তাকে ফিরে পেতে, তাকে শেষবারের মতো দেখতে, সে আবার ফিরে আসে। গ্রামে ফিরে এসে, আতা প্রথমে পুরোনো বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রামের মাটির গন্ধ, পুরোনো গাছের ছায়া, বাবুই পাখির বাসা, কবরস্থান– সব যেন আগে মতোই। কিন্তু যখন সে মদিনার কথা জিজ্ঞেস করে, তখন কানে আসে এক বিস্ময়কর খবর। ‘মদিনা বিয়ের পরপরই পালিয়ে গেছে, কেউ জানে না কোথায়। আতার খোঁজে কি!’ এটা শুনে আতা স্তম্ভিত হয়ে যায়। এতদিন তার মনে যে বেদনা ছিল, তা আবার জাগ্রত হয়ে ওঠে। আতার মনে পড়ে যায়, সে গ্রাম ছেড়ে যখন চলে গিয়েছিল, তখন শেষবারের মতো মদিনার সাথে দেখা হয়নি। সে একাই চলে গিয়েছিল, তার হৃদয়ের ক্ষত নিয়ে, মনের শূন্যতা নিয়ে। কিন্তু মদিনা? সে তো কোথাও পালিয়ে চলে গেছে, এমনকি নিজের শ্বশুরবাড়ির বেঁধে দেওয়া নিয়মকানুন থেকেও। আতা ঘুরেফিরে শহরের পথে গিয়ে মদিনাকে খুঁজতে থাকে। তার মনে হয়, যে ছোট্ট কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো আয়নাটা একদিন মদিনার হাতে ছিল, সেটাও হয়তো এখন তার সাথে থাকবে হয়তো, কোথাও মদিনার সাথেই দেখা হবে তার।
সাত.
এমন সময়, এক সন্ধ্যায়, আতা শহরের এক নির্জন রাস্তায় হাঁটছিল, নেই সেদিনের কোনো আন্ধার। তখন তার চোখে পড়ে পুরোনো সেই কাঠের ফ্রেমের আয়না। আয়না, সেই একই আয়না, যেটা মদিনা একদিন আন্ধার রাতে হাতে নিয়েছিল। তার চোখে এক ঝলক ছিল, তার আত্মবিশ্বাসে একটা ভাঙন ছিল, আর আতা তাকে বুঝতে পেরেছিল। সেই আয়নাটা কোথা থেকে এলো? আতা আয়নাটা হাতে তুলে নেয়। তার হৃদয় হঠাৎ এক মুহূর্তে কেঁপে ওঠে। সে জানে, এই ছোট্ট কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো আয়না আর কিছুই নয়, মদিনার হৃদয়ের এক অমোচনীয় চিহ্ন। মুহূর্তেই আতা দেখে, একটা শূন্য হাতের আঙুলসমূহ নিজের দিকে ফিরিয়ে জড়ো করে রেখেছে সে!
এখন, এই বেলা, শহরের আলোতে, সে যদি আবার মদিনাকে খুঁজে পায়, তার হাতে এই আয়নাটা থাকবে, শুধু এই স্মৃতির জন্য– যে স্মৃতি, একদিন কবরস্থানের আন্ধারে, এক ঝলক আলোয় তার জন্য জেগে উঠেছিল– গ্রামের প্রথম বৈদ্যুতিক সন্ধ্যা! 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কবরস থ ন র প শ র জন য র স মন ত র আল এতদ ন শহর র একদ ন কবর র আয়ন ট র ওপর প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

অসমাপ্ত আধা কিলোমিটারে দুর্ভোগ

১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের সাড়ে ১৫ কিলোমিটারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৫০০ মিটারের কাজ না করেই ঠিকাদার হাওয়া। এই ৫০০ মিটারই দুর্ভোগে ফেলেছে এলাকাবাসীকে। তারা ধুলায় একাকার হচ্ছেন। ঘটছে ছোটখাটো দুর্ঘটনা।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার টুঙ্গিপাড়া-ঘোনাপাড়া সড়কের চিত্র এটি। স্থানীয়রা দ্রুত এ সড়কের নির্মাণকাজ শেষ করে তাদের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে সড়ক বিভাগের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের গোপালগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে,  পিরোজপুর-নাজিরপুর-মাটিভাঙ্গা-পাটগাতী-ঘোনাপাড়া সড়কটি পিরোজপুর, নাজিরপুর, টুঙ্গিপাড়া, জিয়ানগর ভাণ্ডারিয়া উপজেলা থেকে ঢাকা-গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলায় যাতায়াতের সহজ পথ। এ সড়কের মধ্যে  সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ চক্ষু হাসপাতাল ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ডেন্টাল কলেজ, আঞ্চলিক ধান গবেষণা কেন্দ্র, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিআরটিসি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও বাস ডিপো, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টুঙ্গিপাড়া সরকারি কলেজ উল্লেখযোগ্য। তাই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির টুঙ্গিপাড়া থেকে ঘোনাপাড়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সার্ভিস লেনসহ ৪ লেনে চওড়া করার কাজ শুরু করা হয় ২০২২ সালের জুলাই মাসে। এতে ব্যয় ধরা হয় ৩৪৭ কোটি টাকা। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই সড়কের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গিমাডাঙ্গা থেকে পাটগাতী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৫০০ মিটার সড়কের কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায়। তার পরই এ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল, পণ্য পরিবহন ও মানুষের যাতায়াতে ভীষণ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে হচ্ছে যানজট। ঘটছে দুর্ঘটনাও।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গিমাডাঙ্গা গ্রামের ফোরকান আলী বলেন, সড়কটির প্রায় সব কাজ শেষ হয়েছে। মাত্র আধা কিলোমিটার কাজ না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চলে গেছে। এ সড়ক দিয়ে চলাচল করতে গেলে ভোগান্তির শেষ নেই। কখনও কখনও যানজট, ধুলাবালির মধ্যে পড়ে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে এখানে ঘটে ছোটখাটো দুর্ঘটনা। তাই তিনি দ্রুত এই আধা কিলোমিটার সড়কের কাজ সম্পন্ন করার দাবি জানান।
পাটগাতী গ্রামের ভ্যানচালক রইচ বিশ্বাস বলেন, সড়কের সব জায়গা ভালো। কিন্তু গিমাডাঙ্গা থেকে পাটগাতী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত কাজ শেষ হয়নি। এখানে ভ্যান চালাতে গেলে প্রচুর ঝাঁকুনি হয়। এতে বয়স্ক যাত্রীর অসুবিধা হয়। মাঝেমধ্যে ভ্যানের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যায়। ঘটে দুর্ঘটনা। এ সড়কের ৫০০ মিটার অংশটুকুর কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।
বাসচালক ইব্রাহিম মিয়া বলেন, সড়কটি খুবই সুন্দর হয়েছে। কিন্তু মাত্র আধা কিলোমিটারের কাজ বাকি রয়েছে। এই আধা কিলোমিটার অতিক্রম করার সময় ধুলাবালি ওড়ে। এতে পথচারী ও ছোট যানবাহনের যাত্রীদের কষ্ট হয়। এ ছাড়া বাসের জানালা বন্ধ করতে হয়। কখনও কখনও যানজটে আটকা পড়তে হয়। আধা কিলোমিটার সড়কের কাজ সম্পন্ন করা হলে এলাকাবাসী দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে।
টুঙ্গিপাড়ার শ্রীরামকান্দি গ্রামের সাইফুল শেখ বলেন, যাতায়াত ও উৎপাদিত কৃষিপণ্য পাটগাতী হাটে পরিবহনে তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। তাই ওই সড়কের গুরুত্বপূর্ণ ৫০০ মিটার এলাকার কাজ দ্রুত শুরু করে শেষ করার দাবি জানান তিনি। 
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর পরও ওই সড়কের ৫০০ মিটারের নির্মাণকাজের সব বাধা অপসারিত হয়েছে। ২-১ দিনের মধ্যে ফান্ড ছাড় করছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। দ্রুত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করবে। কাজ শুরু হলে শেষ করতে বেশি সময় লাগবে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বেলীর অভাবের ঘরে আলো হয়ে এলো ফুটফুটে ছেলে
  • ধোঁয়ার ঝুঁকিতে শিশুস্বাস্থ্য
  • ‘র‍্যাব পরিচয়ে’ নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন সাগর, অবশেষে ধরা
  • ভয় শব্দ দিয়ে গাজার পরিস্থিতি তুলে ধরা যায় না
  • অসমাপ্ত আধা কিলোমিটারে দুর্ভোগ
  • জীবন বদলে দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্যোগ