Samakal:
2025-02-13@21:07:27 GMT

গ্লিচ

Published: 13th, February 2025 GMT

গ্লিচ

৪৮/জি বাড়িটা কোনদিকে, বলতে পারবেন?
কাছেই। কার কাছে যাইবেন?
ইরেশ বিরক্ত হয়। চার্জের অভাবে মোবাইলটা বন্ধ, কাউকে ফোন করাও যাচ্ছে না। অরিনের আগের বাসা এই দিকেই কোথাও, কিন্তু সে কখনোই গলির ভিতরের অ্যাপার্টমেন্টগুলো ঠিকমতো খেয়াল করেনি। ওকে সব সময় মূল সড়কে নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। রাস্তা, গলি, বাড়িঘর– এইসব বিষয়ে ইরেশের কোনো আগ্রহ নেই।
চৈতি হাসানের বাসায় যাব। ওই যে, সরকারি কলেজে ইংরেজি পড়ান– যিনি।
ডাইনে গিয়া সোজা দুই মিনিট হাঁটবেন। তারপর বামে একটা হলুদ বাতির তিনতলা বাড়ি দেখবেন। সেইটাই।
থ্যাঙ্ক ইউ ভাই।
কিছু কিনবেন নাকি যাইবার আগে? দোকানদার একগাল হেসে বলে। ইরেশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যাকপ্যাক ঠিক করে গলির ভেতরে ঢুকে যায়।
মানুষ যা করতে চায় না, তা যে সে কতবার করে, তার হিসাব নেই। ইরেশ আসতে চায়নি। কিন্তু অরিনের জোরাজুরিতে আসতে হলো। বছর দুয়েক ধরে অরিন এই বাসায় এক রুম নিয়ে ছিল। এখন আর নেই। ব্যাঙ্ককে ভালো চাকরি পেয়েছে। যাবার আগে ঘরের প্রায় সবকিছু নিয়ে গেছে কিংবা বিক্রি করে দিয়েছে, শুধু একটা ফোল্ডেবল ল্যাপডেস্ক ফেলে গেছে। সেটা নিয়ে আসতে বলছিল বারবার।
অরিনের সাথে তার সম্পর্ক কী ছিল? সিচুয়েশনশিপ? দু’জনেই চাকরি নামের দানবটাকে বশ করতে চেয়ে হাঁসফাঁস করত আর বিরক্ত থাকত। এরপর মাঝে মাঝে একসাথে লাঞ্চ কিংবা ডিনার। শপিংমলগুলোতে ঘোরাঘুরি। সিনেমা দেখা। প্রায় তিনটা সিনেমা একসাথে দেখার পর ওরা দু’জন শারীরিকভাবে একে অন্যকে আবিষ্কার করেছিল ইরেশের বাসায়। বলা যায় বেশ সময়ই ওরা নিয়েছে। কারণ অরিন বলেছিল, ওর আগের প্রেমিকের সাথে নাকি দুই সপ্তাহে শরীর-মন সব এক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন সে সাবধানী। সাবধানী ইরেশ নিজেও। অরিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উচ্ছ্বাস আকর্ষণীয়। কিন্তু সেখানে কোনো শান্তি নেই। স্থিরতা নেই। ঘন ঘন দেখা করলে টের পাওয়া যায় কোথায় যেন ক্ষণস্থায়ী একটা ধস আছে দুজনের মাঝেই। যা টাইমপাস হিসেবে দারুণ হলেও একসাথে থাকার জন্য আত্মঘাতী। সেই অরিন এখন বিদেশে। ওর কাছ থেকে ইরেশের আর কিছুই পাওয়ার নেই। হালকা যোগাযোগ রাখা বাদে আর কোনো কিছু ইরেশের কাছে অর্থ বহন করে না। কারণ সে জানে, অল্পদিনেই নতুন বন্ধুবান্ধব, কলিগ আবার কোনো সিচুয়েশনশিপ জুটিয়ে অরিন ওকে আপাদমস্তক ভুলে যাবে। তবু কেন আসতে হলো? সম্পর্কের সমাপ্তিটুকু টানার জন্য? নাকি অন্য কিছু ওকে ডাকছিল বারবার?
রাতটা জমাট বেঁধে আসছে, বাড়িগুলো একটার পর একটা লুকিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের ভেতর। দোকানদারের কথামতো হলুদ আলোর ফ্ল্যাট খোঁজার জন্য আশেপাশে তাকায় সে। মাত্র বিশ গজ দূরেই বাড়িটা। তিনতলা, জানালায় ভারী পর্দা টানা, তবু দেখা যায় গাঢ় হলুদ আলো বাঁকা হয়ে উঁকি দিচ্ছে পর্দার ফাঁক দিয়ে।
সিঁড়ি ভেঙে তৃতীয় তলায় ওঠে সে। দরজার সামনে দাঁড়াতেই অস্বস্তি হয়। এতক্ষণ অফিসের ক্লান্তি, জ্যামের বিরক্তি, বাসা খোঁজার তীব্র অনীহা– কেমন যেন মিইয়ে যায়। একটা চাপা অনুভূতি আছে এখানে, যেন সারাটা ভবন নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আশেপাশের সব বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের মাঝে এই বিল্ডিংটাই সেকেলে, পুরোনো, ধুলো জমা। আশেপাশে নিস্তব্ধ অন্ধকার। শুধু তিনতলাই একা উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়াচ্ছে। ইরেশ পিছিয়ে আসবে কিনা ভাবতেই দরজাটা নিজে থেকে খুলে যায়। একটা ভারী শব্দ, যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে খুলে দিয়েছে। চমকে ওঠে সে।

আপনি নিশ্চয়ই ইরেশ? ভেতরে আসুন, প্লিজ।
দরজার ওপাশে এক মধ্যবয়স্ক নারী দাঁড়িয়ে। মুখ লম্বাটে, চোখে ভারী চশমা, ছোট করে কাটা চুল। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন টানটান ভঙ্গিতে, যেন ধরে না রাখলে দরজা খুলে পড়বে। ভদ্রমহিলার চোখের দৃষ্টি কেমন যেন বিচিত্র। একই সাথে চেনা ও অচেনা একটা ছায়া সেখানে।
অরিন বলেছিল আপনি আসবেন। আপনাকে কল দিয়ে পায়নি, তাই আমাকে জানাল। প্লিজ, কাম ইন।
সরি। ফোনে চার্জ নেই। এখানে আমার ফোনটা চার্জে দিতে পারব?
শিওর। ওই গ্রে কাউচের পাশে চার্জের পোর্ট আছে।
ইরেশ ঢোকে। ভেতরে ঢুকেই মনে হয়, এখানে বাতাস একটু বেশি ভারী।
লম্বাটে লিভিং রুম। দেয়ালে কিছু পুরোনো ফ্রেমে ঝোলানো ছবির মুখগুলো অস্পষ্ট। উড়ে যাওয়া রঙের নিচে চাপা পড়ে আছে কারও কারও অর্ধেক মুখ। কাউচের একপাশে বসে চারপাশে তাকায় ইরেশ। কিছু একটা যেন নড়ছে, ঘরের শেষ কোণে, আবছা অন্ধকারের ভেতর। ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোথাও যেন খুব ধীর নিঃশ্বাস শোনা যায়। এমন কেন লাগছে?
চাপা অস্বস্তি নিয়েই লিভিং রুমে বসে ইরেশ মোবাইল চার্জে লাগায়। স্ক্রিনের কালো অন্ধকারে নিজের প্রতিবিম্ব পড়ে ক্ষণিকের জন্য। এক ধরনের স্থবিরতা, ইতস্তত ভাব, একাকিত্ব ঘিরে ধরে। একবার ভাবে, উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকাবে। কিন্তু জানালার পর্দা এমনভাবে টানা যে, সে ইচ্ছা করলেও বাইরের আলো কিংবা অন্ধকার কোনোদিকেই চোখ ফেলতে পারবে না। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে মনে হয় ভালো হতো।
চা খাবেন?
চৈতি হাসান কখন ঘরে এসেছে টের পায়নি। কণ্ঠে যেন একধরনের অতি পরিচিত ভাব। মনে হয় যেন এই বাড়ির দেয়ালও এভাবেই কথা বলবে, যদি কথা বলতে পারত।
ধন্যবাদ। না, লাগবে না।
ভদ্রমহিলা একমুহূর্ত চুপ করে থাকেন। তারপর ইরেশের দিকে তাকিয়ে বলেন,
আমি এমনিতে খুব একটা কৌতূহলী মানুষ না। কিন্তু আজ আপনাকে দেখে বেশ চমকে উঠলাম।
মানে?
মানে কিছু না। অরিন চলে যাবার পর, এই প্রথম কেউ এলো এই বাসায়।
অরিনের জিনিস নিতে এসেছি।
থেমে থেমে বলল ইরেশ। ভদ্রমহিলার আচরণে ভেতরে ভেতরে কিছুটা বিস্মিতও হচ্ছিল সে।
ভদ্রমহিলা কথাটা শুনে একটু হাসলেন, তবে অচিরেই ঠোঁটের কোণে মিলিয়ে গেল সেই হাসি। ইরেশ খেয়াল করল, তার চুলে ধুলো জমে আছে, খুব সামান্য, কিন্তু আছে। এই বাড়ির দেয়ালের মতোই যেন পুরোনো হয়ে আছে মহিলা নিজেও।
আচ্ছা, আপনি একাই থাকেন এই বাসায়? আচমকা না চাইতেও জিজ্ঞেস করে বসল ইরেশ।
আমি আর আমার স্বামী থাকি। সারাদিন ও বাসাতেই থাকে, সাধারণত সন্ধ্যার পরে কোনো কোনো দিন একটু বের হয়।
ভদ্রমহিলা এবার একমুহূর্ত চুপ থেকে বললেন,
ও খুব অসুস্থ। আমার সাহায্য ছাড়া বিছানা থেকে উঠতে পারে না।
ইরেশ কি জবাব দেবে ভেবে পায় না। হঠাৎ একটা আলগা বাতাস ঘরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। যেন খুব ধীরে চলা একটা প্রবাহ, অস্বাভাবিক শীতল।
আপনি একটা কাজ করুন, ইরেশ।
ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে বললেন,
আপনি একটু জানালার কাছে যান।
কেন?
কারণ, আমার মনে হচ্ছে আপনি শুধু জিনিস নিতে নয়, কিছু একটা জানতেও এসেছেন। আর জানার জন্য কখনও কখনও নিজেকেই এগিয়ে যেতে হয়।
ইরেশ এই কথার উত্তরে বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। শুধু টের পায় তার হাতের তালু ঘামে ভিজে উঠেছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ায়। বাইরে অন্ধকার। নিচের গলি নিস্তব্ধ, এক-দুইটা সাদা স্ট্রিটলাইট, তার নিচে কয়েকটা ছেঁড়া ছায়া। সে হাত বাড়িয়ে পর্দা সরায়। ঘরের ভেতরের হলুদ আলো বাইরের অন্ধকারের সাথে মিশে যায়। পোস্টারের মতো কিছু একটা কি নড়ছে জানালার বাইরে? উড়ে যাচ্ছে? শব্দহীন, ছায়ার ভেতরে।
কী ছিল ওটা?
হঠাৎ ইরেশের মনে হয় পায়ের নিচের মেঝেটা যেন নরম হয়ে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে জানালার আরেক পাশে খুব ধীরে চক্কর দিচ্ছে একটা ছবি, শূন্যে ভাসতে ভাসতে, যেন বাতাসের অদৃশ্য স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ছবিটা। ছবিতে একজোড়া নারী-পুরুষ। যদিও তাদের চেহারা পুরোপুরি বোঝা যায় না। ইরেশ হতবিহ্বল হয়ে যায়। ঘরের ভেতর একটা মৃদু শব্দ বেজে ওঠে, টিক-টিক-টিক।
ছবিতে থাকা মানুষগুলোকে কি আপনি চিনতে পারছেন?
গলা দিয়ে কেন যেন কোনো শব্দ বের হয় না ইরেশের। মনে হয়, দুই পা জমে গেছে। শরীরের ভেতর কোথাও একটা শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। বাতাসে বেশ বড় সাইজের ছবিটা কি সত্যিই উড়ছে! কিন্তু বাইরে তো এমন তীব্র কোনো বাতাস নেই। তার গা শিরশির করে। কিছু বলার জন্য মুখ খোলে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না।
আবার দেখুন ছবিটা …
ইরেশ বাইরে তাকায় আবার।
এবার চেনা যাচ্ছে?
এ .

.. এটা কীভাবে সম্ভব?
ভদ্রমহিলা এবার জানালার কাছে এগিয়ে এসে ইরেশের পাশে দাঁড়ালেন। তার মুখের ছায়া কাচের ওপর পড়ে কিছুটা বিকৃত হয়ে যায়। ছবিটা তখনও বাতাসে ভাসছে দেয়ালে আটকানো কোনো পোস্টারের মতো, যেন মাধ্যাকর্ষণ সেটাকে নিয়মের বাইরে রেখেছে।
সব সম্ভব, যদি আপনি বিশ্বাস করেন।
কিন্তু ...
জানেন, ছবিটার মানুষগুলো পরস্পরকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আপনি কি তাদেরকে ছুঁতে চান?
ইরেশ এবার ভয়ে কেঁপে ওঠে। না, সে কিছুই ছুঁতে চায় না। বলে,
এটা স্বাভাবিক কিছু হতে পারে না! সম্ভবত আমার হ্যালুসিনেশন।
ভদ্রমহিলা এবার একটা চাপা হাসি দিয়ে বলেন, তাও হতে পারে।
চৈতি হাসান এবার আস্তে আস্তে জানালার কাচে হাত রাখলেন। ছবিটা যেন সেই স্পর্শ টের পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায়, তারপর ধীরে ধীরে ভেসে ভেসে জানালার দিকে নামতে শুরু করে।
স্বাভাবিকতা ব্যাপারটা আপেক্ষিক, ইরেশ। আপনি যদি একবার বিশ্বাস করেন যে মানুষ উড়তে পারে, তাহলে তাও আপনার জন্য স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
ইরেশের মুখ শুকিয়ে যায়। তার মনে পড়ছে ছোটবেলায় শোনা গল্পগুলো– উড়ন্ত অশরীরীরা গভীর রাতে আসে, পুরোনো বাড়ির জানালা খুলে কেউ ঢুকে পড়ে, একাকী মানুষদের গলায় ফিসফিস করে কিছু বলে যায়। কিন্তু সেগুলো তো রূপকথা। আজকে সে যা দেখছে তা ভিন্ন কিছু। এই বাড়িটা ... এই মানুষ দুজনের ছবি। এখানে কিছু একটা লুকানো আছে।
অরিনের জিনিস দিয়ে দিন প্লিজ।
এখনই? একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন তিনি, যেন এই মুহূর্তটা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
হ্যাঁ।
ভদ্রমহিলা এবার সরে গেলেন। দরজার কাছে গিয়ে বললেন,
বেশ।
তারপর লম্বা করিডোর পেরিয়ে আরেক ঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন খানিক বাদেই একটা বড় ব্যাগ নিয়ে। ইরেশ একমুহূর্তও দেরি করল না। ব্যাগ নিয়েই দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। নামতে নামতে অনুভব করল যেন চারপাশ থেকে তাকে অদৃশ্য কিছু শুষে নিচ্ছে। সে পেছনে তাকাল। তৃতীয় তলার জানালায় তখন হলুদ আলো জ্বলছে। তবে, আরেক পাশের জানালার কাচে কিছু একটা আছে। দ্বৈত ছায়ার মতো …
সেটা কি মানুষ? নাকি অন্য কিছু?
ইরেশ আর ভাবতে চায় না। কিন্তু গলির বাইরে বেরোতেই সে থমকে যায়। রাস্তার মোড়ে দোকানদার তখনও বসে আছে। কিন্তু দোকানের পেছনের একটা পুরোনো, বিবর্ণ পেইন্টিং। একজোড়া উড়ন্ত কপোত-কপোতী। হাসছে দুজনেই। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুক ধক করে ওঠে। পুরুষটির চেহারা সে দেখে প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়ালেই। আর নারী, এই নারীর উপস্থিতিটুকু সে ফেলে এসেছে একটু আগেই। দোকানে এই ছবির অর্থ কী? এটা কখন এলো? দোকানদার তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
কেমন লাগল, ভাই?
ইরেশ কিছু বলে না। তার মুখে কথা আসছে না।
দোকানদার এবার একটু ঝুঁকে এসে নিচু স্বরে বলল,
আপনি কি জানেন, আগেও অনেকে চৈতি ম্যাডামের সাথে দেখা করতে গেছিল?
তারপরে?
দোকানদার এবার আস্তে হাসল।
তারপর ... আর কেউ তাদের দেখে নাই।
ইরেশের বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে।
তারপর আর কেউ তাদের দেখেনি?
দোকানদারের মুখে সেই রহস্যময় হাসি।
হুমম। মাঝে মাঝে কেউ আসে। কখনও তারে দেখতে, কখনও অন্য কিছু নিতে। কিন্তু যারা আসে আর ফেরা যায় না।
ফেরা যায় না মানে?
দোকানদার কিছুক্ষণ চুপ করে ইরেশের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল,
আপনি ঠিক আছেন তো?
সে কি সত্যিই ঠিক আছে? তার মনে হচ্ছে সে এখনও সেই তৃতীয় তলার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, হলুদ আলোর নিচে, অদ্ভুত ভারী বাতাসের মধ্যে।
এই ছবি আগে দেখিনি তো?
সবকিছু সব সময় চোখে পড়ে না, ভাই।
একটা গা ছমছমে অনুভূতি শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। দোকানদারের চোখের ভাষা বদলে গেছে। যেন সে জানে কিছু একটা। আপনি কি দরজার বাম পাশের রুমটায় গেছিলেন?
কোন রুম?
মানে, চৈতি ম্যাডামের বাসার ভেতরে আরেকটা রুম আছে, যেইখানে তার স্বামী থাকে। জানেন তো?
ইরেশের মনে পড়ে না। সে বসেছিল লিভিং রুমে। আশেপাশে তাকিয়েছিল, কিন্তু বামের কোনো দরজার কথা মনে পড়ছে না।
আমি তো কিছু দেখিনি ...
তাইলে তো ভালোই।
কেন? । 
দরজাটা খোলা থাকলে ... আর বাইর হওয়া যাইত না। আপনারে তারা ছাইড়া দিসে। অবশ্য আপনে আসবেনই ওগো কাছে।
শুনেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল ইরেশের।
ধ্যাত! কী আবোল-তাবোল বকছেন আপনি?
বলেই এবার সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। মাথার ভেতর যেন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অরিন বলেছিল, শুধু একটা ফোল্ডেবল ল্যাপডেস্ক পড়ে আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিয়তি তার জন্য অন্য কোনো পরিকল্পনা করে রেখেছিল। বাড়ির দরজা বন্ধ হবার আগে কি সত্যিই সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে?
হাঁটতে হাঁটতে পথের মাঝে হঠাৎ থেমে গেল। মনে হলো, কোথা থেকে ফিসফিস করে কেউ ডাকছে তার নাম ধরে। গলির মোড়ে, হলুদ বাতির নিচে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। একটা মানুষ ... না, হয়তো মানুষ না। শুধুই ছায়া। ফিসফিসানিটা বাড়তে থাকে। তার নাম ধরে কেউ ডাকছে, সদ্য চেনা একটা স্বরে। চৈতি হাসান? এবার ইরেশের কানে আরেকটা শব্দ এলো– একটা নরম, খসখসে আওয়াজ। তারপর হঠাৎ দেখল, কোথাও কেউ নেই। এমন সময় অন্ধকারের ভেতর কোথাও একটা বিড়াল মিউ মিউ করে উঠল করুণ সুরে।
ইরেশের বুকের ভেতর ধকধক করতে লাগল। মনে পড়ল, চৈতি হাসানের ফ্ল্যাটের সেই ভারী বাতাস, জানালার ফাঁক গলে ছড়িয়ে পড়া হলুদ আলো, পোস্টার, দরজার ওপাশের অদেখা রুম। সে কি ওখান থেকে সত্যিই বের হতে পেরেছে? মাথার ভেতরটুকু দুলছে। হয়তো আজ রাতের পর থেকে নিজের জীবন আর আগের মতো খুঁজে পাবে না। হয়তো তার চারপাশে সবকিছু আগের মতোই থাকবে– শুধু সে ছাড়া। কিন্তু সত্যিটা কী? কী মনে করে, ব্যাগের চেইন খুলে ভেতরে হাত রাখল। তার আঙুলের ডগায় কিছু একটা ঠেকল।
ইরেশ ধীরে ধীরে ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে সেটা বের করল। একটা ভারী ছবির ফ্রেম। ফ্রেমে থাকা ছবিটা বর্তমানের। ছবিতে লম্বাটে মুখের সেই নারী, সাদা-কালো শাড়ির ভেতর থেকে যে ভারী চশমাওয়ালা চোখ দিয়ে তাকে দেখে গিয়েছিল গভীরভাবে এবং তার অসুস্থ স্বামী। তবে কি এরাই ইরেশের ভবিষ্যৎ জীবনের অংশ? নাকি এরা বর্তমান? নাকি ইরেশ শুধু চৈতি আহমেদের স্বামীর নবীন ছায়া?
“ছবিটার মানুষগুলো পরস্পরকে প্রচণ্ড ভালোবাসে ...” কেউ যেন আবার পুনরাবৃত্তি ঘটায় সেই কথাটার।
ইরেশ দেখতে পায় দূরে ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোর নিচে একটা বিড়াল বসে আছে। বিড়ালের চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে, যেন তার ভেতর বাস করছে অন্য কিছু। ইরেশ সেই চোখজোড়ার দিকে তাকায়। সে জানে এমন এক নিয়তি তাকে ডাকছে, যা বালির ওপরে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দের মতো রহস্যময়। সেখানে অসুখ, ভালোবাসা ও বিস্মৃতি বড় নিবিড়ভাবে ঘেরা। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অন য ক ছ র স মন র জন য সবক ছ র একট দরজ র ত রপর বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশে স্টারলিংক আনার বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস ও ইলন মাস্কের মধ্যে আলোচনা

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্পেসএক্স, টেসলা এবং এক্স-এর মালিক ইলন মাস্কের সঙ্গে এক ভিডিও আলোচনায় ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ক্ষেত্র অন্বেষণ এবং বাংলাদেশে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

আজ বৃহস্পতিবার ভিডিও আলোচনা চলাকালে বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা সংকট এবং অগ্রাধিকার ইস্যু বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং স্পেসএক্সের পক্ষে ভাইস প্রেসিডেন্ট লরেন ড্রেয়ার এবং গ্লোবাল এনগেজমেন্ট অ্যাডভাইজার রিচার্ড গ্রিফিথস উপস্থিত ছিলেন।

তাদের কথোপকথনে অধ্যাপক ইউনূস এবং ইলন মাস্ক স্টারলিংকের স্যাটেলাইট যোগাযোগে বিশেষ করে বাংলাদেশের উদ্যোগী যুবক, গ্রামীণ ও পিছিয়ে থাকা নারী এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর রূপান্তরমূলক প্রভাবের ওপর জোর দেন।

কম খরচে কীভাবে উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সংযোগ বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষমতায়ন অনুন্নত অঞ্চলে এবং এর লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে জাতীয় সীমানার বাইরে প্রবেশাধিকার দিতে পারে সে বিষয়ে তারা আলোচনা করেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের অবকাঠামোতে স্টারলিংকের সংযোগ লাখ লাখ মানুষের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে এবং দেশকে বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অর্থনীতিতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংহত করবে। তিনি বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে প্রযুক্তি-চালিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচন করতে মাস্কের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, স্টারলিংক হবে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণফোনের একটি সম্প্রসারণ, যা গ্রামের নারী ও যুবকদের বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করার পথপ্রদর্শক হতে পারে।

জবাবে ইলন মাস্ক দারিদ্র্য বিমোচনে এর বৈশ্বিক প্রভাব স্বীকার করে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ মডেলের প্রশংসা করেন।

টেসলা মোটরসের প্রতিষ্ঠাতা মাস্ক বলেছেন, তিনি বহু বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ ভিলেজ ফোনের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। স্টারলিংকের মতো প্রযুক্তিগত অগ্রগতিগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ উদ্ভাবন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে আরও এগিয়ে নিতে পারে বলে তিনি আস্থা প্রকাশ করেন 

জাতীয় উন্নয়নে এই উদ্যোগের তাৎপর্য তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস স্টারলিংক পরিষেবার সম্ভাব্য প্রবর্তনের জন্য ইলন মাস্ককে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। মাস্ক তাতে ইতিবাচক সাড়া দেন।

মাস্ক বলেন, ‘আমি এর অপেক্ষায় আছি।’ বাংলাদেশে উন্নত স্যাটেলাইট সংযোগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি এবং সারা দেশে উদ্ভাবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ