হামলা–নৈরাজ্যে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার নিন্দা গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির
Published: 13th, February 2025 GMT
দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, নৈরাজ্য এবং এসব ঘটনায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তার নিন্দা জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। এখনো নানা প্রকাশনীর ওপর যেভাবে খবরদারি করা হচ্ছে উল্লেখ করে এই কমিটি বলেছে, এটা যদি অব্যাহতভাবে চলতে থাকে, তাহলে শেখ হাসিনার আমলের সঙ্গে এই সরকারের পার্থক্য কীভাবে তৈরি হবে?
আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সাধারণ সভা হয়। সভায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, চিকিৎসক হারুন অর রশিদ, শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, সামিনা লুৎফা, মাহা মির্জা প্রমুখ অংশ নেন। এই সভা থেকে সম্প্রতি শাহবাগে শিক্ষকদের ওপর বর্বরোচিত পুলিশি হামলার নিন্দা জানানো হয়। আগাগোড়া সংস্কার ছাড়া পুলিশের আচরণের যেকোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়, সে বিষয়েও সভায় সবাই একমত পোষণ করেন।
সভা শেষে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বইমেলায় যেভাবে আগাম ঘোষণা দিয়ে স্টলে হামলা হচ্ছে, পুলিশের উপস্থিতিতে মাস্তানি দেখানো হচ্ছে এবং সরকার যে এই গোষ্ঠীকে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ করছে না— সভায় তার তীব্র সমালোচনা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এখনো নানা প্রকাশনীর ওপর যেভাবে খবরদারি করা হচ্ছে, সেটা যদি এভাবে অব্যাহতভাবে চলতে থাকে, তাহলে হাসিনার আমলের সঙ্গে এই সরকারের পার্থক্য কীভাবে তৈরি হবে? বইমেলার এসব ঘটনায় গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি গভীর উদ্বেগ জানায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানায়।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শন বিষয়েও সভায় আলোচনা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কিছু ভুক্তভোগী ও অল্প গণমাধ্যম সহযোগে হলেও শেষ পর্যন্ত যে সরকার আয়নাঘর পরিদর্শন করতে পেরেছে, সে জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি সরকারকে অভিনন্দন জানায়; কিন্তু কমিটি এটাও সরকারকে মনে করিয়ে দিতে চায় যে আয়নাঘরের আলামত যারা নষ্ট করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও সরকারকে অবস্থান নিতে হবে। শুধু তা–ই নয়, দেশের সব গোপন আয়নাঘরকে উন্মুক্ত করা এবং যেসব বাহিনীর কার্যালয়ে এসব আয়নাঘর ছিল, সেসব গুমের সঙ্গে জড়িত বাহিনীকে বিলুপ্ত করার দাবি জানায় কমিটি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হাসিনার আমলে ফ্যাসিবাদের অন্যতম সহযোগী হেফাজতে ইসলামের হুমকিতে টাঙ্গাইলে লালন স্মরণানুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। কমিটি মনে করে, সরকারের উচিত অবিলম্বে লালনের স্মরণে যে অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে, সেটি পুনরায় আয়োজনের ব্যবস্থা করা এবং যারা এটা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্বীকৃত দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের নামে থাকা বিভিন্ন ভবনের নাম পরিবর্তন করার ঘোষণা নিয়েও সভায় আলোচনা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা মনে করি, দেশবরেণ্য বিজ্ঞানী, কবি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামে থাকা ভবনের নাম পরিবর্তন করতে পারেন একমাত্র তাঁরাই, যাঁরা চরম সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যাকারীদের অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন। কমিটি এর তীব্র নিন্দা জানায়।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র
এছাড়াও পড়ুন:
বন্ধ হউক সংস্কৃতির উপর খবরদারি
প্রতি বৎসরের ন্যায় এইবারও রাজধানীতে বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হইতে যাইতেছে। উপরন্তু, অন্তর্বর্তী সরকার রাজধানীতে এইবারের শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করিয়া এক ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ আয়োজনের প্রস্তুতি লইতেছে। বিশেষত ইহাতে বাঙালির পাশাপাশি পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের বিশেষ উপস্থিতি ঘটাইবার চেষ্টা চলিতেছে। স্বাভাবিকভাবেই সর্বমহল উক্ত সরকারি প্রয়াসের প্রশংসা করিতেছে। তবে দুঃখজনকভাবে, এইবারের বাংলা বর্ষবরণও যেন বিতর্ক এড়াইতে পারিতেছে না। বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়াছে পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আয়োজিত শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন ঘিরিয়া। শনিবার প্রকাশিত সমকালের সংবাদ অনুযায়ী, শুক্রবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত অনুষদের ডিনের ঘোষণা অনুসারে মঙ্গল শোভাযাত্রার নূতন নাম হইতেছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হইতে পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান– সর্বত্র ইহা লইয়া চলিতেছে আলোচনা-সমালোচনা। শুধু উহা নহে, প্রতিবেদন অনুসারে শোভাযাত্রার প্রস্তুতি হিসাবে নানা আকারের মুখোশ, মাটির সরায় রঙের আঁচড় বসাইতে চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থী বরাবরের ন্যায় ব্যস্ত থাকিলেও বিগত বৎসরসমূহের তুলনায় এইবারের শোভাযাত্রার প্রস্তুতির রং যেন কিছুটা মলিন; কারণ চারুকলা প্রাঙ্গণে নাই সেই চিরচেনা জমজমাট কর্মযজ্ঞ ও প্রাণের উচ্ছ্বাস। একই চিত্র যদি বর্ষবরণের শোভাযাত্রায়ও দেখা যায়, তাহা হইলে ইহা হইবে অতীব হতাশাজনক।
আমরা জানি, মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয় ১৯৮৫ সালের পহেলা বৈশাখে যশোরে। তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামের অংশ হিসাবে অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয় কামনাই ছিল উক্ত আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। উহাতে লোকজ সংস্কৃতির নানা মোটিফ ব্যবহৃত হয় মানুষের মধ্যে মাতৃভূমির প্রতি প্রেম জাগাইবার জন্য। একই উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সালে বাংলা বর্ষবরণের অংশ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হইতে অনুরূপ শোভাযাত্রা বাহির হয়, যদিও তখন ইহার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে দেশ স্বৈরশাসকমুক্ত হইলে নূতন প্রেক্ষাপটে এবং শোভাযাত্রার মূল লক্ষ্যের সহিত সংগতি বিধানে ইহার নাম হইয়া যায় মঙ্গল শোভাযাত্রা। তখনও দেশে দৃশ্যমান অশুভ শক্তি ছিল, যাহারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী তো বটেই, ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়াইয়া জনগণকে বিভাজিত করিবার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। সরকার বা কোনো করপোরেট সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে সাধারণ মানুষের দান-অনুদানে এবং অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রস্তুতকৃত নানা মোটিফ, বাঁশি, ঢোল ইত্যাদি সরঞ্জাম বিক্রয়লব্ধ অর্থের উপর ভিত্তি করিয়া চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীই এতদিন ইহার সকল কাজ সম্পন্ন করিয়া আসিয়াছেন। অর্থাৎ সম্পূর্ণ জনসাধারণনির্ভর এই আয়োজন স্বতঃস্ফূর্ত উৎসবের অনন্য এক নিদর্শন হইয়া দাঁড়ায়। এই কারণে উক্ত শোভাযাত্রা লইয়া বিশেষত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতি সক্রিয়তাকে নাগরিক মহল একটা সম্পূর্ণ নাগরিক উদ্যোগে সরকারি হস্তক্ষেপ হিসাবে দেখিতেছে। শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করিলেও ইহার অবতারণা কিন্তু সংস্কৃত মন্ত্রণালয় করিয়াছে, যাহা তাহাদের এখতিয়ারবহির্ভূত। ‘মঙ্গল’ শব্দটি লইয়া আপত্তির ভিত্তিও খুব দুর্বল। আর মঙ্গলের স্থলে আনন্দ শব্দটি কোন আলাদা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে? উভয়েই তো সংস্কৃতজাত এবং বাঙালির জীবনে নিবিড়ভাবে জড়িত, কোনো অজুহাতেই ইহাদের বর্জনের সুযোগ নাই। হ্যাঁ, মঙ্গল শব্দটি বলিলে অমঙ্গলেরও একটা ধারণা শ্রোতার মনে জাগে। আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় অমঙ্গলের প্রতীক বলিয়া কোন অপশক্তিকে চিহ্নিত করা হইত, তাহার কথা তো পূর্বেই বলা হইয়াছে। সম্ভবত শব্দটির ব্যাপারে আপত্তি সেই কারণে।
অন্ধ হইলে যদ্রূপ প্রলয় বন্ধ হয় না, তদ্রূপ মঙ্গল শব্দটি নিষিদ্ধ করিলেও সমাজ হইতে অমঙ্গলের শক্তি উধাও হইয়া যাইবে না। স্মরণে রাখিতে হইবে, বর্তমানে মঙ্গল শোভাযাত্রা সমগ্র দেশে তো বটেই, দেশের বাহিরেও পহেলা বৈশাখের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক আয়োজনে পরিণত হইয়াছে– যাহা আক্ষরিক অর্থেই বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। এই কারণে ইউনেস্কো ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করিয়াছে। সংস্কৃতির উপর খবরদারি কোনো দিন কাহারও জন্যই ভালো কিছু বহিয়া আনে নাই। সংশ্লিষ্ট সকলে বিষয়টি দ্রুত অনুধাবন করিবেন, ইহাই প্রত্যাশা আমাদের।