গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ এ মন্তব্য করেন।

নির্বাচিত সংসদ ছাড়াই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গণভোটে সংবিধান সংশোধন সম্ভব কি না, জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা (কমিশন) সংস্কারগুলো কী কী করতে হবে, সেটা বলেছি। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কীভাবে করবেন, সেটা ঠিক করবেন। সম্ভব কি না—এই মতামত সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা দেব না। এটা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে।’

গণভোটের যৌক্তিকতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আলী রীয়াজ বলেন, দেশে একাধিকবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে দুই–তৃতীয়াংশের মাধ্যমে। অর্থাৎ যে দল ক্ষমতায় থাকেন, তারাই সংবিধান সংশোধন করেছেন। অনেক সময় তারা দেশের ৫০ শতাংশ জনগণেরও প্রতিনিধিত্ব করেন না। এর অপব্যবহারের মোকাবিলা করতেই গণভোটের সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে কোনো দল ক্ষমতায় থাকলেও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। অতীতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে জনগণের মত নেয়নি।

অভ্যুত্থান–পরবর্তী ছয় মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের যে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, বিভিন্ন মতপার্থক্য সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের ক্ষেত্রে একধরনের ঐকমত্য আছে। এ ছাড়া বহুদিন ধরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা করে আসছে। দলগুলো তাদের সংস্কার প্রস্তাবও পেশ করেছে। সংস্কারের রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা রয়েছে বলেই বিশ্বাস ও আস্থা আছে। বিশেষভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে।

সংবিধান সংস্কারের সুপারিশে কোটা ও বৈষম্যের ছাপ রয়েছে বলে আলোচনা হচ্ছে উল্লেখ করে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণী মনোনয়ন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বয়স ২১ বছর করার সুপারিশ নিয়ে আলোচনা ছিল। এখন আন্দোলনকারী ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে। তাদের সুবিধা দিতেই এ সুপারিশগুলো করা হয়েছে কি না?

এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ১০ শতাংশ মনোনয়ন বাধ্যতামূলক নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যেন তরুণ-তরুণীদের মনোনয়ন দেয়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তরুণদের অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়তে পারে, নতুন নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়; আর ২১ বছরের কথা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিলেও, সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলেও, তাতে যে এই শিক্ষার্থীরাই মনোনীত হবেন, এ নিশ্চয়তা কে কাকে দিচ্ছে? তিনি বলেন, বিশেষভাবে কোনো একটি রাজনৈতিক দল তৈরি হবে, এই বিবেচনা করে সুপারিশ করা হয়নি।

বহুত্ববাদের সুপারিশ ও প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানের পরেও ভিন্নমতের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। এমন বাস্তবতায় বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ধর্ম—সবকিছুর মধ্যেই যে পার্থক্য আছে, সেগুলোকে শুধু স্বীকার বা স্বীকৃতি দেওয়া নয়, সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠার জন্যই বহুত্ববাদিতার কথা বলা হয়েছে। বহুত্ববাদের সঙ্গে ধর্মের ব্যাখ্যা যেভাবে করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা সঠিক ব্যাখ্যা নয়। ধর্মের একত্ববাদের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কার্যত এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সেখান থেকে বেরোতে চেষ্টা করেছি। এনসিসির ধারণা মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোকাবিলা করা।

নির্বাচনের জন্য কী কী সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ—জানতে চাইলে রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে যেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলো শনাক্ত করে সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে যে নির্বাচনের কথা হচ্ছে, এর জন্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে জালিয়াতির নির্বাচন বন্ধ সম্ভব হবে।

এর আগে অধ্যাপক আলী রীয়াজ একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এতে তিনি বলেন, শক্তিশালী গণতন্ত্র তৈরি এবং এটাকে স্থায়ী করতে হলে ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদী শাসনের আশঙ্কা মোকাবিলার উপায় হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি, সেগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় পর্যায় থেকে শাসনব্যবস্থার সর্বস্তরে নাগরিকদের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব কার্যকর করে তোলা।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে কমিশনের সদস্য সুমাইয়া খায়ের, মুহাম্মদ ইকরামুল হক, ইমরান সিদ্দিকী, শরীফ ভূঁইয়া, এম মঈন আলম ফিরোজী, ফিরোজ আহমেদ ও মুস্তাইন বিল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র য় জ বল ন র জন য ক ষমত গণভ ট

এছাড়াও পড়ুন:

বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি কারা, তাদের জন্ম কীভাবে?

পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তানে এক ভয়াবহ নাটকীয় ঘটনায় ১১ মার্চ সশস্ত্র বিদ্রোহীরা একটি যাত্রীবাহী ট্রেন দখল করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত অভিযান চালিয়ে শত শত জিম্মিকে মুক্ত করেছে। ট্রেনটি বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে উত্তরের পেশোয়ারে যাচ্ছিল, আর তাতে ছিলেন বেশ কিছু সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্য।

বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) কোনো বিলম্ব না করেই হামলার দায় স্বীকার করে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান-এ পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা জানায়, এটি পাকিস্তানের ‘দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক দখলদারত্ব এবং বেলুচ জনগণের বিরুদ্ধে চালানো যুদ্ধাপরাধের’ প্রতিশোধ।

১৯৪৮ সালে ভারত বিভক্তির কয়েক মাস পর বেলুচিস্তান পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলে তখন থেকেই অঞ্চলটি পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অবহেলার শিকার। দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারকে একের পর এক বিদ্রোহ দমন করতে হয়েছে।

সাম্প্রতিক এই ট্রেন অপহরণের ঘটনায় বিএলএ দাবি করে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে বেলুচ রাজনৈতিক কর্মী, নিখোঁজ ব্যক্তি ও বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে, নইলে তারা জিম্মিদের হত্যা করবে। এরপর সেনাবাহিনী দুই দিন ধরে কঠোর অভিযান চালায়। অভিযানে ৩৩ জন বিদ্রোহী, ২১ যাত্রী ও ৪ সেনাসদস্য নিহত হন।

এই নজিরবিহীন হামলা আবারও পাকিস্তান সরকারকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে—বেলুচিস্তানের বাড়তে থাকা অসন্তোষ ও সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনে তাদের কৌশল আসলে কতটা কার্যকর?

বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) একটি স্বাধীনতাকামী সংগঠন। ২০০০-এর দশকের শুরুতে তারা আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান সরকার ও বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ একে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

আরও পড়ুনবেলুচিস্তান কেন স্বাধীন হতে চায়১৪ মার্চ ২০২৫

অন্যান্য তুলনামূলক নরমপন্থী বেলুচ জাতীয়তাবাদী দলের মতো বিএলএ পাকিস্তানের অংশ হিসেবে টিকে থাকতে চায় না। তারা চায় সম্পূর্ণ স্বাধীন বেলুচিস্তান।

বেলুচ জনগণের অসন্তোষের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনীতে পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব না থাকা। জাতীয়তাবাদীরা অভিযোগ করে, পাকিস্তান সরকার বেলুচিস্তানের কয়লা, সোনা, তামা ও গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করছে। অথচ স্থানীয় বেলুচ জনগণ তাতে কোনো সুবিধা পাচ্ছে না।

উদাহরণস্বরূপ, সোনা ও তামার খনির রাজস্বের বেশির ভাগ অংশই যায় এটি পরিচালনাকারী চীনা কোম্পানি ও পাকিস্তান সরকারের পকেটে। বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক সরকার পায় মাত্র ৫ শতাংশ।

চাঘাই পাকিস্তানের সবচেয়ে খনিজসমৃদ্ধ জেলা। অথচ এ জেলা পাকিস্তানের সবচেয়ে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর একটি। স্থানীয় শ্রমিকেরা অভিযোগ করেন, খনিতে তাঁদের শুধু নিম্ন মানের কাজ দেওয়া হয়। তাঁরা ভয়াবহ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হন।

দীর্ঘদিনের অবহেলার কারণে বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ প্রদেশ হিসেবে রয়ে গেছে। মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) ২০১৭ সালে এটি ০.৪২১ স্কোর করে, যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। তুলনায় সবচেয়ে উন্নত প্রদেশ পাঞ্জাবের এইচডিআই ০.৭৩২।

২০০৬ সালে বিশিষ্ট বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর বুগতি সেনা অভিযানে নিহত হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এরপর পাকিস্তান সরকার বিএলএকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং প্রদেশটিতে সামরিক অভিযান আরও তীব্র হয়।

বেলুচিস্তানের বোলান জেলায় লিবারেশন আর্মির পুড়িয়ে দেওয়া ট্রাক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি কারা, তাদের জন্ম কীভাবে?
  • দলগুলোর নানা মত গুতেরেস চান ঐক্য
  • সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্যের ওপর জোর
  • আগামী সংসদ নির্বাচন ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে হওয়া দরকার: জোনায়েদ সাকি
  • টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পাশে থাকবে: গুতেরেস
  • বাংলাদেশের সন্ধিক্ষণে সহায়তা দিতে প্রস্তুত জাতিসংঘ
  • ঐকমত্য কমিশন ও রাজনীতিকদের সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠক
  • ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব
  • সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে মতামত দিয়েছে ৭ রাজনৈতিক দল
  • সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে মতামত দিয়েছে ৭টি দল