দীর্ঘ ২৭ বছর পর বিজেপি যে এবার দিল্লি দখল করবে, সেই দেয়াললিখন স্পষ্ট ছিল। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ললাটলিখনও। আম আদমি পার্টির (আপ) সর্বাধিনায়ক কোনো লিখনই খণ্ডাতে পারেননি। পারার কথাও ছিল না। নিজে হারলেন, দলকেও ডোবালেন। এখন তাঁর আত্মমন্থনের সময়। 

একদিকে কেজরিওয়ালের একের পর এক ভুল ও চারিত্রিক পরিবর্তন; অন্যদিকে বিজেপির যুদ্ধংদেহী মনোভাব লড়াইটা অসম করে তুলেছিল। দিল্লিবাসীর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আপ নামক ‘আপদ’ বিদায় না করলে জনতাকে পস্তাতে হবে। জনজীবন জেরবার হবে। 

দুই-আড়াই বছর ধরে দিল্লিতে রাজনীতি ও শাসনের নামে যা চলছিল, তা ছিল ওই হুংকারের সংক্ষিপ্ত ট্রেলার। শেষ পর্যন্ত দিল্লিবাসী মোদির গ্যারান্টির ওপর ভরসা রাখাকেই ঠিক মনে করেছেন। আগামী পাঁচ বছর তাঁর প্রতিশ্রুতি পালনের সময়। 

এটা ঠিক, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কেজরিওয়াল ও তাঁর দল নিরুদ্বেগে রাজ্য চালিয়েছে। বিকল্প রাজনীতির ক্যানভাসে বিরোধীদের আঁচড় পর্যন্ত কাটতে দেয়নি। উপায়ান্তর না দেখে কেজরিওয়ালের কর্তৃত্বে মোদি প্রথম রাশ টানেন ২০২১ সালের মার্চে দিল্লি শাসন-সম্পর্কিত আইন সংশোধন করে। 

ওই সময় নির্বাচিত সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান করে তোলা হয় অনির্বাচিত ও কেন্দ্র মনোনীত উপরাজ্যপালকে। ওই বছরের নভেম্বরেই কেজরিওয়াল করে বসেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম বড় ভুল। চালু করেন নতুন আবগারি (মদ) নীতি। সেই নীতি যে তাঁর গলার কাঁটা হয়ে খচখচ করবে, তা বোঝেন পরের বছর। উপরাজ্যপাল বিনয় কুমার সাকসেনার নীতি কার্যকরের ক্ষেত্রে অসম্মতি জানানোর পাশাপাশি সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করার সময়। 

কেজরিওয়ালের ধাক্কা খাওয়ার সেই শুরু। তত দিনে অভিযোগ উঠে গেছে, নতুন নীতি রূপায়ণের জন্য আপ নেতৃত্ব মদ কারবারিদের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ঢেউয়ে ভেসে ক্ষমতায় আসা আপ নেতৃত্ব সততা ও স্বচ্ছতার যে চালচিত্র তৈরি করেছিলেন, সেই প্রথম তা কালিমালিপ্ত হলো। একে একে জেলে যেতে হয় সত্যেন্দ্র সিং, মণীশ সিসোদিয়া, সঞ্জয় সিং, কেজরিওয়ালদের। বিতর্কের মুখে নীতি প্রত্যাহার করেও পার পায়নি দল। 

দিল্লিবাসী তবু কেজরিওয়ালকে ভরসা করেছিলেন জনমুখী নীতির কারণে। শুরু থেকেই দরিদ্রদের আর্থিক সুরাহার দিকে তিনি নজর দিয়েছিলেন। গরিব, প্রান্তিক, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তিনি পাড়া-মহল্লায় নিয়ে এসেছিলেন। বিনা খরচে ডাক্তার-বদ্যি ওষুধের ব্যবস্থায় খোলেন প্রায় ৫০০ মহল্লা ক্লিনিক। এর দরুন দিল্লি পৌরসভার ভোটেও বিজেপিকে হারিয়ে আপ জয়ী হয়। প্রমাদ গোনে বিজেপি। রাশ টানতে আইন বদলে পৌরসভাকেও কেন্দ্র নিয়ে আসে উপরাজ্যপালের এখতিয়ারে। গণতন্ত্রের অন্তর্জলি-যাত্রা পাকাপাকি করে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরায় কেন্দ্র। উপরাজ্যপালের সম্মতি বিনা কিচ্ছুটি করার জো রইল না দিল্লির নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর। 

মোদির মনোভাব ও আগ্রাসী নীতি আঁচ করে কেজরিওয়াল শোধরাতে পারতেন। কিন্তু ২০২২ সালে পাঞ্জাব দখল তাঁর উচ্চাশা তুঙ্গে তোলে। কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতের নীতি যত তীব্র হয়, ততই তিনি কোণঠাসা হতে থাকেন রাজনৈতিকভাবে। অথচ পূর্বসূরি শীলা দীক্ষিতের শাসনের স্টাইল দেখে তিনি কৌশলী হতে পারতেন। মানুষের স্বার্থে শীলা কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের সাহায্য নিয়েছিলেন। ডিজেলচালিত সরকারি বাস তুলে দিয়ে গ্যাসচালিত করতে, বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার বেসরকারীকরণে, রাস্তা-ফ্লাইওভারের মতো অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা হাসপাতাল গড়তে জমি পেতে। 

সমকালীন রাজনীতিতে যাঁকে কেজরিওয়াল শ্রদ্ধা করেন, নানা সময় নানা বিষয়ে যাঁর পরামর্শ নেন, পশ্চিমবঙ্গের সেই সর্বজনীন দিদির দৃশ্যমান যাপিত জীবন থেকেও তিনি শিক্ষা নিতে পারতেন। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তৈরি বাসস্থানে মমতা বা বুদ্ধদেব সহজেই উঠে যেতে পারতেন, কিন্তু যাননি। কেজরিওয়ালের বোঝা উচিত ছিল, রাজনীতিতে ‘পারসেপশন’ই প্রথম ও শেষ কথা।

অথচ কেজরিওয়াল পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়াই করে গেলেন শেষ দিন পর্যন্ত। তাতে ব্যাহত হলো পানীয় জল সরবরাহ। মেরামতের অপেক্ষায় নিষ্প্রদীপ পড়ে রইল অগুনতি ভাঙাচোরা রাস্তা। ভেঙে পড়ল নিকাশিব্যবস্থা, জঞ্জাল অপসারণ। শিকেয় উঠল যাবতীয় সরকারি পরিষেবা। বাড়তে থাকল বায়ু ও শব্দদূষণ। যমুনা হতশ্রী রূপ নিল। ভোগান্তি বাড়ল আম আদমির। বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের লেজেগোবরে করে কেজরিওয়াল আপের তরি যমুনায় ডোবালেন। 

দলের কফিনে শেষ পেরেকটিও কেজরিওয়ালেরই ঠোকা। ‘শিশমহল’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত তিনি কেন নিয়েছিলেন, কোন যুক্তিতে, সেই বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি। শিশমহল নামটি বিজেপিরই দেওয়া। পুরোনো দিল্লির সিভিল লাইনস এলাকায় ৬, ফ্ল্যাগস্টাফ রোডের এই বাংলো মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি নিবাস হিসেবে তৈরির সিদ্ধান্ত কেজরিওয়ালেরই। সেই সরকারি বাংলোর খোলনলচে বদলাতে কেজরিওয়াল ৪৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা কেন খরচ করলেন, কোন যুক্তিতে, আজও তা অজানা! কৃচ্ছ্রসাধনের কাহিনি শুনিয়ে আসা আম আদমির নেতার কেন এই অপ্রয়োজনীয় বিলাসী সিদ্ধান্ত, এর সদুত্তর কেজরিওয়াল আজও দিতে পারেননি।

অথচ কেজরিওয়ালই বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তিন–চার কামরার একটা ফ্ল্যাটই যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির সবাই প্রতিটি জনসভায় ‘শিশমহল’ প্রসঙ্গ টেনে ‘ভোগী ও ভণ্ড’ কেজরিওয়ালকে বেআবরু করেছেন। আবগারি নীতির মতো এর মোকাবিলাও তিনি করতে পারেননি।

সমকালীন রাজনীতিতে যাঁকে কেজরিওয়াল শ্রদ্ধা করেন, নানা সময় নানা বিষয়ে যাঁর পরামর্শ নেন, পশ্চিমবঙ্গের সেই সর্বজনীন দিদির দৃশ্যমান যাপিত জীবন থেকেও তিনি শিক্ষা নিতে পারতেন। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তৈরি বাসস্থানে মমতা বা বুদ্ধদেব সহজেই উঠে যেতে পারতেন, কিন্তু যাননি। কেজরিওয়ালের বোঝা উচিত ছিল, রাজনীতিতে ‘পারসেপশন’ই প্রথম ও শেষ কথা। রাজনীতির ব্যাকরণ বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা আপকে রাজনীতিই শেষ পর্যন্ত পাল্টে দিল! নিজের তৈরি ভাবমূর্তি নিজের হাতে খান খান করে ভাঙার খেসারত আগামী পাঁচ বছর কেজরিওয়ালকে দিতে হবে।

আগামী দিনগুলো কেজরিওয়ালের পক্ষে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের। প্রতিহিংসাপরায়ণ বিজেপি আবগারি মামলায় তাঁকে আরও ব্যতিব্যস্ত করবে। আম আদমির কাছে হারানো জমি ফেরত পেতে কংগ্রেসও আরও তৎপর হবে। ইতিমধ্যেই পাঞ্জাবে সরকার ফেলার তৎপরতা শুরু হয়েছে।

কংগ্রেসের দাবি, আপের অন্তত ৩০ জন বিধায়ক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ইন্ডিয়া জোটের কার্যত পঞ্চত্বপ্রাপ্তি বিজেপির ক্ষিপ্রতা আরও বাড়াবে। ধর্মীয় মেরুকরণের তীব্রতাও বেগবান হবে। দান–খয়রাত নীতির তীব্র বিরোধিতা করেও কেজরিওয়ালের জনমুখী অস্ত্রে তাঁকে বধ করার পর কত দিন তা চালানো হবে, আজ বা কাল সেই সংশয় দেখা দেবেই। মহারাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই তা দেখা গেছে। এতে সবচেয়ে সংকটে পড়বে তাঁরাই, যাঁদের সুরাহা দিয়ে আম আদমি পার্টি দিল্লিকে তার খাসতালুক বানিয়েছিল।

সংকট সুযোগেরও জন্ম দেয়। ২০২০ সালের তুলনায় এবার আপের ভোট ১০ শতাংশ কমেছে। এত প্রতিরোধ সত্ত্বেও এবার তারা ভোট পেয়েছে ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মানে, দিল্লির প্রান্তিক ও আম আদমি কংগ্রেসের মতো আপকে ছুড়ে ফেলেনি। দরজাও পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়নি। ভুল শুধরে আমজনতার রাজনীতি আঁকড়ে থাকলে কেজরিওয়ালদের জন্য ফেরার পথ খোলা থাকবে। পরাজিত তাঁরা অবশ্যই, কিন্তু শোকগাথা লেখার সময় এখনো আসেনি। ‘ডাউন’ হলেও তাঁরা ‘আউট’ নন এখনো।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম খ যমন ত র র ত র র জন র জন ত ত র জন য প রথম সরক র র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

পাগলা মসজিদের ব্যাংক হিসাবে ৮০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা

কিশোরগঞ্জ শহরের আলোচিত পাগলা মসজিদের ব্যাংক হিসাবে বর্তমানে আছে ৮০ কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৬ টাকা। সর্বশেষ শনিবার দান বাক্সের টাকা রূপালী ব্যাংকে জমার পর পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিাটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। 

প্রতি তিন মাস বা তার কিছু বেশি সময় পরপর মসজিদের দান বাক্সগুলো খোলা হয়। তাতে প্রতিবারই কয়েক কোটি টাকা পাওয়া যায়। সর্বশেষ শনিবার ১১টি দান বাক্স খুলে মিলেছে ২৮ বস্তা টাকা। গণনা শেষে পাওয়া গেছে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ ৯ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭ টাকা। পাওয়া গেছে বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার। 

সেনা সদস্য, পুলিশ ও আনসারের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ও রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মিলে মোট ৩৯৪ জন মানুষ টাকা গণনায় অংশ নেন। সব টাকা রূপালী ব্যাংকের হিসাবে জমা করা হয়েছে। বিদেশি মুদ্রা আর অলংকারের মূল্য নির্ধারণ করে সেসব টাকাও ব্যাংকে রাখা হবে।

জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান বলেছেন, দান বাক্সে পাওয়া টাকার লভ্যাংশ থেকে অসহায় জটিল রোগীদের অনুদান দেওয়া হয়। মসজিদ কমপ্লেক্স মাদ্রাসার এতিম ছাত্রের সব খরচ, আনসার সদস্যদের বেতনসহ মসজিদ পরিচালনার যাবতীয় খরচও মেটানো হয়। জমানো টাকা থেকে পুরুষ ও মহিলাদের নামাজের আরও দুটি শেড নির্মাণ করা হবে। এছাড়া একটি আধুনিক পাগলা মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। এর জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। ৬ তলা বিশিষ্ট নতুন মসজিদ কমপ্লেক্সে একসঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। ৫ হাজার নারী মুসল্লির জন্যও পৃথক ব্যবস্থা থাকবে।

কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিম দিকে নরসুন্দা নদীর দক্ষিণ তীরে হারুয়া এলাকায় প্রায় পৌনে দুইশ’ বছর আগে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসন মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে ১৯৭৯ সাল থেকে। তখন থেকে পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হন। সাধারণত পৌর মেয়ররা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ