রংপুরের গঙ্গাচড়ার মোহাম্মদ সরকারের বয়স তখন ১৫ কি ১৬ বছর। দশম শ্রেণিতে পড়তেন। একদিন এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়েছিলেন রেডিওতে গান শুনতে। তখন ওই বাড়ির গৃহকত্রী তাঁকে কটু কথা বলেছিলেন। রেডিও তাঁকে শুনতেই হবে—এমন জেদ নিয়ে তিনি চলে যান বগুড়ার আদমদীঘিতে মামার কাছে।

মামার কাছে থাকার সময় বগুড়ার সান্তাহারে খোঁজ পান রেডিও মেকার রশিদ মাস্টারের। তিনি তাঁর কাছে রেডিও সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখতে শুরু করেন। অনেক রেডিও আসে। গান আর খবর শোনা হয়, কাজটাও শেখা হয়। এভাবে ছয় মাস কাজ শিখে বাড়িতে ফিরে আসেন মোহাম্মদ সরকার।

আশির দশকে মোহাম্মদ সরকার গঙ্গাচড়া বাজারে রেডিও মেরামতের দোকান দেন। দোকানের নাম রাখেন, ‘মোচারু বেতার’। এমন নামের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুবক বয়সে তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল। বড় গোঁফ রেখেছিলেন। তখন থেকে সবাই তাঁকে ‘মোচারু’ নামে ডাকতেন। সেটাই এখন স্থায়ী হয়ে গেছে। মোচারু সরকার নামেই সবার কাছে এখন পরিচিত তিনি।

৬ ফেব্রুয়ারি গঙ্গাচড়ায় কথা হয় মোহাম্মদ সরকারের সঙ্গে। অতীতের স্মৃতিচারণা করে ষাটোর্ধ্ব এই রেডিওপ্রেমী বলেন, তখন তাঁর দোকানে প্রতি সন্ধ্যা ও রাতে রেডিওতে বিবিসি বাংলা, রেডিও চায়না, রেডিও জাপান, রেডিও তেহরান ও আকাশবাণী কলকাতার খবর শোনা হতো। একসময় বিশ্বসংবাদ শোনা তাঁরা নেশা হয়ে যায়। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক তিনটি প্রজাতন্ত্র রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের দৈনন্দিন বিশ্বসংবাদ তাঁর মধ্যে আগ্রহ তৈরি করেছিল। বিশ্বরাজনীতির উল্লেখযোগ্য ঘটনা এখনো তাঁর স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে।

কালে কালে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রেডিওর সেই রমরমা আর নেই। মোহাম্মদ সরকারের দোকানও গঙ্গাচড়া বাজার থেকে গঙ্গাচড়া মহিলা কলেজ মোড়ে চলে এসেছে। রেডিও মেরামতের পাশাপাশি একসময় মাইক ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। তখন দোকানের নাম খানিকটা বদলে রাখেন ‘মোচারু রেডিও ও মাইক সার্ভিস’।

গঙ্গাচড়া বাজারের ব্যবসায়ী গোলাম ফারুক বলেন, একসময় রেডিওতে সংবাদ শোনা অনেকের অভ্যাস ছিল। মোচারুও (মোহাম্মদ সরকার) এমন একজন। তিনি এই বাজারের প্রথম রেডিও ও মাইক সার্ভিসের ব্যবসায়ী। কিন্তু রেডিওর শ্রোতা কমে যাওয়ায় তাঁর পেশা সংকটে পড়েছে। এ ছাড়া মাইক ও সাউন্ডবক্সের ব্যবসায় এখন লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ দরকার। এত টাকা তাঁর নেই। ফলে তাঁর মতো লোকজন আর এই পেশায় থাকতে পারছেন না।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে রেডিও মেরামতের কাজ করলেও মোহাম্মদ সরকারের নিজের কোনো রেডিও নেই। লোকের মেরামত করতে দেওয়া রেডিওতেই খবর শুনতেন। এখন আর কেউ রেডিও সার্ভিসিং করতে আসেন না। গত বছরে তাঁর মামা আবদুল মালেক একটি রেডিও মেরামত করতে দিয়েছিলেন, সেটা আর নেননি। সেই রেডিওতেই তিনি এখন খবর শোনেন।

একসময় আয়রোজগার থাকলেও মোহাম্মদ সরকারের রেডিও ও মাইক সার্ভিসের দোকান এখন চলে না। পুঁজির সংকটে মাইক ও সাউন্ডবক্স নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বললেন, দিনে এক শ টাকাও আয় হয় না।

গঙ্গাচড়া বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বললেন, দোকান থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার ধারে টিনের চালায় পরিবার নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ সরকার। স্ত্রী, চার মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছেলে মাকে নিয়ে বদরগঞ্জে চলে গেলে তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেন।

ঘরে অভাব থাকলেও ‘মোচারু’ কারও কাছে সহযোগিতা চাওয়ার লোক নন উল্লেখ করে গঙ্গাচড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রাজু আহমেদ বলেন, সরকার পরিবারটিকে খাসজমি বন্দোবস্ত দিলে থাকার ব্যবস্থা হতো।

তবে এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই মোহাম্মদ সরকার ওরফে মোচারু সরকারের। অভাবের কথা খুব একটা বলতেও চান না। তাঁর যত আগ্রহ বিশ্বসংবাদ ঘিরেই। চলমান ফিলিস্তিন–ইসরায়েল ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আদ্যোপান্ত নিয়ে তিনি এখনো মশগুল। বিশ্বরাজনীতিতে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব। এর কারণ হিসেবে বললেন, ফুমিও কিশিদা যুদ্ধ চান না, শান্তি চান।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ড ও ম র মত র ব যবস ব যবস য় খবর শ ন

এছাড়াও পড়ুন:

শত বাগানে ১৩ লাখ গোলাপ, অপেক্ষা ভালোবাসা দিবসের

কক্সবাজার শহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়ন। একসময় বরইতলীর বিভিন্ন গ্রামে বরই চাষ হতো। তবে এখন হচ্ছে গোলাপের চাষ। এ কারণে ইউনিয়নটি পরিচিত হয়ে উঠেছে গোলাপ গ্রাম নামে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে মহাসড়কের ওপর দিয়ে যেতে অতিক্রম করতে হয় চকরিয়ার এই বরইতলী এলাকা। মহাসড়কের কয়েক কিলোমিটার অংশে দুপাশে চোখে পড়ে লাল গোলাপের বাগান। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা গোলাপের ঘ্রাণ মোহিত করে সড়কের যাত্রীদেরও।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মহাসড়কের দুপাশে বিভিন্ন বাগানজুড়ে ফুটে আছে লাল গোলাপ। দূর থেকে দেখে মনে হয়, কেউ যেন সবুজের ওপর লালগালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বেলা ১১টার দিকে সড়কের পূর্বপাশের একটি বাগানে ঢুকে দেখা যায়, সাতজন শ্রমিক বাগান থেকে গোলাপ কাটছেন। দূরে দাঁড়িয়ে গোলাপ কাটার কাজ তদারক করছেন বাগানের মালিক ইদ্রিস আহমদ।

রিপন দে (৪০) নামে বাগানের এক শ্রমিক বলেন, সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ৮ শতাধিক গোলাপ কেটেছেন (সংগ্রহ) তিনি। রিপন জানান, প্রতিদিন সকালের দিকে গোলাপ কাটেন তিনি। তারপর সেই গোলাপ গাড়িতে করে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম। বাগানের নারী শ্রমিক শিল্পী রানি দে (৫৫) বলেন, তিন ঘণ্টায় তিনি সাত শতাধিক গোলাপ কেটেছেন। ১০ বছর ধরে তিনি বাগানে গোলাপ কাটছেন।

বাগানের মালিক ইদ্রিস আহমদের (৬০) সঙ্গেও কথা হয়। তিনি বলেন, ২৩ বছর ধরে তিনি গোলাপ চাষ করে আসছেন। প্রতিবছর তিনি ৫০ লাখের বেশি গোলাপ বিক্রি করেন। আয় করেন ২৫ লাখ টাকার বেশি। অনেক সময় গোলাপ বিক্রি হয় না, গাছেই নষ্ট হয়। তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। এ ধরনের সময়ে ফুল বিনা মূল্যে বিতরণের জন্যও কাউকে পাওয়া যায় না।

বাগানটির মালিক ও শ্রমিকেরা জানান, ৬ কানির (কানিতে ৪০ শতক) বাগানটিতে গাছ আছে ২৪ হাজার। প্রতিটি গাছে ফুটেছে দুই থেকে পাঁচটি গোলাপ। প্রতিদিন ৬ হাজার গাছ থেকে প্রায় ৩০ হাজার গোলাপ কাটা হয়। তারপর সেই ফুল পাঠানো হয় চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকার ফুলের দোকানগুলোয়। প্রতিটি গোলাপ সাধারণত পাইকারিতে বিক্রি হয় দেড় টাকায়। ইদ্রিস আহমদ বলেন, গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি করেছেন ১০ টাকা দরে। এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হতে পারে। ওই দিন তিনি ৬০ হাজার গোলাপ বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ইদ্রিস আহমদের দক্ষিণ পাশে আবদুল মান্নানের তিন কানির আরেকটি গোলাপবাগান। এই বাগানের প্রতিটি গাছে ফুটেছে তিন থেকে চারটি লাল গোলাপ। সকালের কয়েক ঘণ্টায় গাছগুলো থেকে কাটা হয় দেড় হাজারের বেশি গোলাপ। এই ফুলও চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় এলাকায় সরবরাহ করা হবে জানিয়ে আবদুল মান্নান (৫৫) বলেন, একসময় বাগানের এ জমিতে তামাকের চাষ হতো। লাভজনক তামাক চাষ বাদ দিয়ে তিনিসহ গ্রামের ৪০ জন চাষি ৬০ কানি জমিতে ছোট-বড় ১৫টি গোলাপবাগান সৃজন করেন। প্রথম দিকে চাষিরা লাভবান হলেও এখন ফুলের বাজার মন্দা।

গোলাপ বাগানে এক নারী শ্রমিক কাজ করছেন। সম্প্রতি চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়নে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইউক্রেন একসময় রাশিয়ার হয়ে যেতে পারে: ট্রাম্প
  • শত বাগানে ১৩ লাখ গোলাপ, অপেক্ষা ভালোবাসা দিবসের