রেডিও ঘিরে একটা জীবন পার করে দিচ্ছেন রংপুরের ‘মোচারু’
Published: 13th, February 2025 GMT
রংপুরের গঙ্গাচড়ার মোহাম্মদ সরকারের বয়স তখন ১৫ কি ১৬ বছর। দশম শ্রেণিতে পড়তেন। একদিন এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়েছিলেন রেডিওতে গান শুনতে। তখন ওই বাড়ির গৃহকত্রী তাঁকে কটু কথা বলেছিলেন। রেডিও তাঁকে শুনতেই হবে—এমন জেদ নিয়ে তিনি চলে যান বগুড়ার আদমদীঘিতে মামার কাছে।
মামার কাছে থাকার সময় বগুড়ার সান্তাহারে খোঁজ পান রেডিও মেকার রশিদ মাস্টারের। তিনি তাঁর কাছে রেডিও সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখতে শুরু করেন। অনেক রেডিও আসে। গান আর খবর শোনা হয়, কাজটাও শেখা হয়। এভাবে ছয় মাস কাজ শিখে বাড়িতে ফিরে আসেন মোহাম্মদ সরকার।
আশির দশকে মোহাম্মদ সরকার গঙ্গাচড়া বাজারে রেডিও মেরামতের দোকান দেন। দোকানের নাম রাখেন, ‘মোচারু বেতার’। এমন নামের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুবক বয়সে তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল। বড় গোঁফ রেখেছিলেন। তখন থেকে সবাই তাঁকে ‘মোচারু’ নামে ডাকতেন। সেটাই এখন স্থায়ী হয়ে গেছে। মোচারু সরকার নামেই সবার কাছে এখন পরিচিত তিনি।
৬ ফেব্রুয়ারি গঙ্গাচড়ায় কথা হয় মোহাম্মদ সরকারের সঙ্গে। অতীতের স্মৃতিচারণা করে ষাটোর্ধ্ব এই রেডিওপ্রেমী বলেন, তখন তাঁর দোকানে প্রতি সন্ধ্যা ও রাতে রেডিওতে বিবিসি বাংলা, রেডিও চায়না, রেডিও জাপান, রেডিও তেহরান ও আকাশবাণী কলকাতার খবর শোনা হতো। একসময় বিশ্বসংবাদ শোনা তাঁরা নেশা হয়ে যায়। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক তিনটি প্রজাতন্ত্র রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের দৈনন্দিন বিশ্বসংবাদ তাঁর মধ্যে আগ্রহ তৈরি করেছিল। বিশ্বরাজনীতির উল্লেখযোগ্য ঘটনা এখনো তাঁর স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে।
কালে কালে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রেডিওর সেই রমরমা আর নেই। মোহাম্মদ সরকারের দোকানও গঙ্গাচড়া বাজার থেকে গঙ্গাচড়া মহিলা কলেজ মোড়ে চলে এসেছে। রেডিও মেরামতের পাশাপাশি একসময় মাইক ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। তখন দোকানের নাম খানিকটা বদলে রাখেন ‘মোচারু রেডিও ও মাইক সার্ভিস’।
গঙ্গাচড়া বাজারের ব্যবসায়ী গোলাম ফারুক বলেন, একসময় রেডিওতে সংবাদ শোনা অনেকের অভ্যাস ছিল। মোচারুও (মোহাম্মদ সরকার) এমন একজন। তিনি এই বাজারের প্রথম রেডিও ও মাইক সার্ভিসের ব্যবসায়ী। কিন্তু রেডিওর শ্রোতা কমে যাওয়ায় তাঁর পেশা সংকটে পড়েছে। এ ছাড়া মাইক ও সাউন্ডবক্সের ব্যবসায় এখন লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ দরকার। এত টাকা তাঁর নেই। ফলে তাঁর মতো লোকজন আর এই পেশায় থাকতে পারছেন না।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে রেডিও মেরামতের কাজ করলেও মোহাম্মদ সরকারের নিজের কোনো রেডিও নেই। লোকের মেরামত করতে দেওয়া রেডিওতেই খবর শুনতেন। এখন আর কেউ রেডিও সার্ভিসিং করতে আসেন না। গত বছরে তাঁর মামা আবদুল মালেক একটি রেডিও মেরামত করতে দিয়েছিলেন, সেটা আর নেননি। সেই রেডিওতেই তিনি এখন খবর শোনেন।
একসময় আয়রোজগার থাকলেও মোহাম্মদ সরকারের রেডিও ও মাইক সার্ভিসের দোকান এখন চলে না। পুঁজির সংকটে মাইক ও সাউন্ডবক্স নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বললেন, দিনে এক শ টাকাও আয় হয় না।
গঙ্গাচড়া বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বললেন, দোকান থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার ধারে টিনের চালায় পরিবার নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ সরকার। স্ত্রী, চার মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছেলে মাকে নিয়ে বদরগঞ্জে চলে গেলে তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেন।
ঘরে অভাব থাকলেও ‘মোচারু’ কারও কাছে সহযোগিতা চাওয়ার লোক নন উল্লেখ করে গঙ্গাচড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রাজু আহমেদ বলেন, সরকার পরিবারটিকে খাসজমি বন্দোবস্ত দিলে থাকার ব্যবস্থা হতো।
তবে এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই মোহাম্মদ সরকার ওরফে মোচারু সরকারের। অভাবের কথা খুব একটা বলতেও চান না। তাঁর যত আগ্রহ বিশ্বসংবাদ ঘিরেই। চলমান ফিলিস্তিন–ইসরায়েল ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আদ্যোপান্ত নিয়ে তিনি এখনো মশগুল। বিশ্বরাজনীতিতে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব। এর কারণ হিসেবে বললেন, ফুমিও কিশিদা যুদ্ধ চান না, শান্তি চান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ড ও ম র মত র ব যবস ব যবস য় খবর শ ন
এছাড়াও পড়ুন:
সুরক্ষায় প্রশাসনিকভাবে উদ্যোগ নিন
নদ–নদী, খাল–বিল, হাওর–বাঁওড় মিলে বাংলাদেশ। তবে নদ–নদী–খালের বিপন্ন পরিস্থিতির কথা যেভাবে আলোচনায় উঠে আসে, অন্য জলাশয়গুলো নিয়ে আমরা সেই অর্থে মনোযোগী নই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশাল বিলগুলো খাদ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। ধানসহ অন্যান্য ফসল ও মাছের স্বর্গ বলা যায় এসব বিলকে। এমন একটি বিল হচ্ছে দিনাজপুরের কড়াই বিল। এ বিল দিন দিন শ্রী হারাচ্ছে। বিলের পাড়ের সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মানুষও আগের মতো ঘুরতে আসে না। সব মিলিয়ে বিষয়টি হতাশাজনক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দিনাজপুর শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বিরল উপজেলার কড়াই বিলের অবস্থান। ধান ও মাছ চাষ ছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত বিলটি। একসময় অতিথি পাখিদের কলকালিতে মুখর থাকত ৫৬ একর আয়তনের বিল এলাকা। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে বিলের মাঝবরাবর প্রায় ২৮ একর (পাড়সহ) আয়তনের পুকুর খনন করা হয়। পাড়ে লাগানো হয় কয়েক হাজার ফলদ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের গাছ। বিল ও পুকুরের সৌন্দর্য উপভোগ এবং অতিথি পাখিদের দেখতে ভিড় করতেন দর্শনার্থীরা। এখন বিলে পানি নেই, কাটা হয়েছে পাড়ের গাছগুলো। দর্শনার্থীরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
গত সোমবার পুকুরপাড়ের ছয় শতাধিক ফলদ ও বনজ গাছ কাটা পড়েছে। বিরল থানা মুক্তিযোদ্ধা হাঁস-মুরগি ও পশু পালন খামার সমবায় সমিতির নেতারা নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব গাছ কেটেছেন বল অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে কেটে ফেলা গাছগুলো জব্দ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে সমিতির নেতাদের দাবি, সবার সিদ্ধান্ত নিয়ে গাছগুলো কাটা হয়েছে, এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, গাছ কাটতে হলে বন বিভাগকে অবহিত করার বিধি আছে। কিন্তু কড়াইবিলের গাছগুলো কাটার বিষয়ে আমাদের জানানো হয়নি।
পুকুরটির দেখভালের সমিতির অধীনেই। একসময় সমিতিটির নিয়ন্ত্রণে ছিল আগের ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তিরা। এখন সেখানে প্রভাব বিস্তার করছেন অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীরা। তঁাদের মাধ্যমেই এতগুলো গাছ কাটা পড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। কেটে ফেলা গাছগুলোর মধ্যে শতাধিক ছিল আমগাছ। গাছগুলোতে মুকুলও এসেছে। গরমকালে গাছগুলোর ছায়ার নিচে বসে প্রশান্ত হতেন স্থানীয় লোকজন। এখন প্রায় গাছশূন্য হওয়ায় পুকুরটি ঘিরে প্রশান্তিময় পরিবেশ নষ্ট হলো। অসংখ্য পাখির আবাসও ধ্বংস হলো।
বিরল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, এই গাছগুলো খাস খতিয়ানের জমিতে। ভূমিসংক্রান্ত একটি মামলা চলমান আছে। গাছ কাটার ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে কোনো আবেদন করা হয়নি। বিধিবহির্ভূতভাবে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার কারণে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আমরা আশা করব, প্রশাসন কড়াইবিলকে ঘিরে সমিতির কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করবে। বিলটির সুরক্ষায় প্রশাসনকে মনোযোগী হবে। আগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করবে।