বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ আট জনের বিরুদ্ধে করা নাইকো দুর্নীতি মামলার রায় আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ধার্য করেছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক রবিউল আলমের আদালত আসামিপক্ষের আত্মপক্ষ শুনানি, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের এ তারিখ ঠিক করেন।

বিস্তারিত আসছে...

 

ঢাকা/মামুন/ইভা

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর

এছাড়াও পড়ুন:

গভীর সমুদ্রে নেই রেডিও তরঙ্গ, ঝড়ের খবর জানতে পারেন না জেলেরা

উপকূল থেকে ২০ কিলোমিটার পেরোলেই গভীর সাগরে বাংলাদেশ বেতারের তরঙ্গ মিলছে না। উপকূল থেকে দুই-তিন ঘণ্টা গভীর সাগরের দিকে ট্রলার নিয়ে গেলে মুঠোফোন নেটওয়ার্কও অকার্যকর হয়ে যায়। তখন উপকূলের কয়েক হাজার মাছ ধরার ট্রলারের কয়েক লাখ জেলে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন মূল ভূখণ্ড থেকে। ফলে ঝড়-বৃষ্টি, নিম্নচাপের খবরও জানার সুযোগ পান না তাঁরা। এতে প্রতিবছরই সাগরে ঘটছে প্রাণহানি ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।

২০২৩ সালের মে মাসে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছিল অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। ৮ নম্বর সংকেত দেওয়া হলেও গভীর সাগরে থাকা ট্রলারের মাঝি-জেলেরা সেই বার্তা পাননি। সংকেতের কথা জানতে পারেন তীরে ফেরার পর।

বরগুনার পাথরঘাটার এফবি তরিকুল-৪ ট্রলারের মাঝি চান মিয়া সেদিনের ভয়াল স্মৃতি মনে করে এখনো শিউরে ওঠেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো হেই সময় গভীর সাগরে আলহাম। সেই খানে রেডিও ও ফোনের নেটওয়ার্ক পাওন যায় না। হেইতে মোরা আবহাওয়ার খবর জানতে পারি নায়। তয় সাগরের অবস্থা দেইখ্যা অনুমান হইছিল যে বড় কোনো বইন্যা আইতে লাগছে। মনডায় কামড় দেছে, সাগরের অবস্থাও তহন খুব খারাপ। মোরা জাল-কাছি সব ট্রলারে উডাইয়্যা কিনারে রওনা দিছি। কিন্তু এত্তো ঢেউ যে টলার সামনে আগায় না। খালি ঢেউয়ে বারি মারে, উল্টাইয়া হালাইতে চায়। খালি দোয়া ইউনুস পড়ি। হেইবার ক্যামনে যে বাইচ্চা কিনারে ফিরছি আল্লায়ই জানে। মরণের ঘরে গোনে ফিরছি কইতে পারেন!’

বড় ঝড় হলে তাহলে কীভাবে বোঝেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে চান মিয়া বলেন, ‘বোঝোনোর কোনো যন্তদ্র মোগো নাই। সাগরের পানি ও ঢেউয়ের রূপ ও বাতাসের অবস্থা দেইখ্যা অনুমান করতে অয়।’

ওই একই ঝড়ের সময় সাগরে ছিলেন এফবি আল্লাহর দান-২ ট্রলারের মাঝি কবির হোসেন। তিনি বলেন, গভীর সাগরে জেলেদের কাছে মূলত ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা পৌঁছায় না। পৌঁছালেও অনেক দেরি হয়। তখন জেলেদের কিছুই করার থাকে না। তবে ট্রলারের মাঝি ও জেলেরা সাগরের পানিতে হাত দিয়ে পানির তাপমাত্রা বেশি হলে অনুমান করে তীরে ফেরা শুরু করেন। তাঁর কথা, ‘ঝড়ের সময় যাদের ভাগ্য ভালোর অয়, হ্যারা সুন্দরবন এলাকায় আশ্রয় নিয়া জীবন বাঁচায়। যাগো কপাল মন্দ হ্যাগো জীবন পানিতেই শ্যাষ।’

প্রাণহানির খণ্ডচিত্র

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বরগুনার পাথরঘাটা এলাকায় গত ৩০ বছরে কমপক্ষে ১৮৮ জন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁদের স্মরণে পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদ চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে তাঁদের নামসহ একটি স্মৃতিফলক। পাথরঘাটা উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯১ জন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন ২০০৭ সালের সিডরে। এ ছাড়া ১৯৯৩ সালে পাঁচজন, ১৯৯৪ সালে দুজন, ২০০১ সালে পাঁচজন, ২০০৬ সালে ১৪ জন, ২০১৪ সালে সাতজন, ২০১৮ সালে ১৩ জন এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে ১৫ জন জেলে নিখোঁজ হন।

১৯৯৩ সালে নিখোঁজ হওয়া পাথরঘাটার কালমেঘা গ্রামের জেলে হারুন সরদারের মা জবেদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়া আর ফেরে নাই। বাঁচলো, না মরলো, তা-ও জানি না।’

২০১৪ সালে স্বামী-সন্তান হারানো চরদুয়ানি গ্রামের রানী বেগম বলেন, ‘স্বামী আর দুই পোলা—তিনজনই সাগরে গেল, কেউ আর ফিরল না।’

রেডিওর সংকেত কাজ করে না

বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে সোয়া লাখের বেশি জেলে সাগরে যান। জেলেদের সংগঠনগুলো বলছে, বরিশাল বেতারের তরঙ্গ দুর্বল হওয়ায় তাঁরা সংকেত পান না। বরিশাল বেতার কেন্দ্রের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানো এবং কুয়াকাটায় রিলে স্টেশন চালুর দাবি তুলেছেন তাঁরা।

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা অঞ্চলের জেলে সিদ্দিক মাঝি বলেন, ‘৩০ বছর ধইর্যা সাগরে যাই, কোনোদিন বাংলাদেশ বেতার বরিশালের খবর পাই নাই। ঢাকা-চট্টগ্রাম বেতার কিছু কিছু সোময় আসে আবার চইল্লা যায়।’

ভোলার জেলে হাসান মাঝি বলেন, ‘সাগরে আমরা মোবাইলেই রেডিও শুনি, কিন্তু পাঁচ-ছয় ঘণ্টা চালাইলেই নেটওয়ার্ক নাই হইয়্যা যায়। তারপর কিনারে কী চলে আমরা কিছুই জানি না।’

বাংলাদেশ বেতার বরিশাল কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তাদের এফএম ট্রান্সমিটার ১৮ কিলোওয়াট, যা ৮০-১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কার্যকর। এফএম ট্রান্সমিটার মাত্র ২ কিলোওয়াট, যা পৌঁছায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ফলে কুয়াকাটা বা গভীর সমুদ্রে এটি কাজ করে না। তবে বরগুনা, পটুয়াখালী পাথরঘাটার জেলেরা বলছেন, তাঁরা সাগর তো দূরে থাক, কিনারে বসেও বরিশাল বেতার শুনতে পান না।

বরিশাল আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্রের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কুয়াকাটা থেকেই বরিশাল কেন্দ্রের তরঙ্গ মিলছে না। জেলেদের জরুরি বার্তা পৌঁছাতে রিলে স্টেশন বা শক্তিশালী ফ্রিকোয়েন্সি দরকার।’

সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালে বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলায় ৬ হাজার নৌযানে জিএসএম প্রযুক্তি বসানো হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ নৌযানে এটি অকেজো। ফলে জেলেরা সুরক্ষিত নন।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনার উপকূলীয় ১৪ জেলায় প্রায় ২৯ হাজার ৬৭১টি সমুদ্রগামী নৌযান আছে। প্রতিটি নৌযানে গড়ে ১০ জন করে জেলে থাকলে বছরে প্রায় ৩ লাখ জেলে সমুদ্রে যান। শুধু বরিশাল বিভাগেই ১২ হাজার ২৫৯টি সমুদ্রগামী ট্রলার আছে, যেখানে সোয়া লাখের বেশি জেলে মাছ ধরতে যান গভীর সাগরে। তবে এই সংখ্যা বেসরকারি হিসাবে আরও বেশি। কিন্তু সঠিক সময়ে সংকেত না পাওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে।

কুয়াকাটার জেলে নুরু মাঝি বলেন, ‘আগে সাগরের ৫০-৬০ কিলোমিটারের মধ্যে মাছ পাইতাম, এহন ১০০-১৫০ কিলোমিটার গভীরে যাওন লাগে। আমরাও বুঝি সাগরের যত গভীরে যাই তত আমাগো ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু উপায় কী, প্যাটের খিদা তো আর মরণের চিন্তা মানে না।’

বরিশাল বেতার কেন্দ্রের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানো বা কুয়াকাটায় রিলে স্টেশন বসানো ছাড়া সমুদ্রগামী জেলেদের জন্য বিকল্প কিছু নেই বলে মনে করেন উপকূলের ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি ইসরাইল পণ্ডিত। তিনি বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে উপকূলের লাখো জেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে যান। কিন্তু তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি যুগ যুগ ধরে উপেক্ষিত। এমনকি প্রতিবছর অসংখ্য জেলে সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে মারা যাওয়া ও নিখোঁজ হওয়া জেলেদের পরিবার সরকারি তেমন কোনো সাহায্য–সহযোগিতা পান না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ