আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থকদের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেড়ে রয়েছে যে শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনের মেয়াদকালে দেশের অর্থনীতি প্রশংসনীয় গতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু একজন নির্মোহ উন্নয়ন-গবেষক হিসেবে তাদের বলতে চাই, আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের খেসারত হলো ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভুয়া বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি বেলাগাম পুঁজি লুণ্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড সৃষ্টি।

শেখ হাসিনার সময়ে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছিল, সেটা ছিল ঋণ করে ঘি খাওয়ার ক্ল্যাসিক উদাহরণ, ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন।

হাসিনা তাঁর স্বৈরাচারী শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার ভয়াবহ কাহিনি তাঁর পতনের পর উদ্‌ঘাটিত হতে শুরু করেছে।

৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।

এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অঙ্কের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভঙ্করের ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা।

ফলে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রতিজন বাংলাদেশির মাথার ওপর এক লাখ টাকার বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে। কমপক্ষে আগামী এক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ডুবে থাকবে এই বিশাল অঙ্কের ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধের দায় মেটানোর কারণে।

হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যেজন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গত সাড়ে পনেরো বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মহোৎসব কাল।

হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে পনেরো বছর ধরে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যার সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এই পুঁজি লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা। যে দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়স্বজন জড়িত রয়েছে, যেগুলোর প্রকল্প ব্যয় ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। হাসিনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং অলিগার্ক ব্যবসায়ীরাই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের প্রায় সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চস্তরের নেতা-কর্মী এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও গত সাড়ে পনেরো বছরে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারে জড়িয়ে গিয়েছিল।

বিশেষত, অজস্র ঋণ করার কৌশল পুরো জাতিকে যে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সাগরে নিমজ্জিত করেছে, সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়েছে এ জন্য যে ওই ঋণের সিংহভাগই স্রেফ পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। হাসিনা আমলের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল পুঁজি পাচার।

বিদেশি একটি গবেষণা সংস্থা এই দাবির বিপরীতে বক্তব্য রেখেছে যে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মোট জিডিপি বর্তমানে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে অবস্থান করছে। নিক লিয়া নামের এক গবেষক দাবি করেছেন, বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে ১৭৯৪ ডলার।      

গত ২ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড.

ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন যে গত দশ বছরের প্রত্যেক বছর বিভিন্ন পন্থায় দেশ থেকে বিদেশে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্যপ্রযুক্তি খাত। শ্বেতপত্রে খাতওয়ারি লুণ্ঠনের তথ্য-উপাত্ত উদ্‌ঘাটন করে লুণ্ঠিত অর্থের প্রাক্কলন প্রকাশ করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে ২৮টি দুর্নীতির পদ্ধতির মাধ্যমে লুণ্ঠনপ্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণে নিয়ে আসা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

উপরন্তু সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামালের নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে ‘ডেটা ডক্টরিং’ এর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, একই সঙ্গে মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখানোর জন্য দেশের মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দেশের রপ্তানি আয়কে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারকে সব সময় কমিয়ে দেখানো হয়েছে।

দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যাকে কম দেখানো হয়েছে, যাতে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো যায়। দেশের জনগণের জন্মহার ও মৃত্যুহারকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো যায়। একই সঙ্গে দেশের ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেটকে’ কম দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল হচ্ছে প্রচার করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় আগের বছরে সাবেক সরকার যতখানি দেখিয়েছিল তার চাইতে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ১.৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে সাবেক সরকার দাবি করলেও তা প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি। দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার হার ১৮ শতাংশে নেমে গেছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই হার অনেক বেশি।

হাসিনা দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে রসাতলে নিয়ে গেছেন তাতে জনগণের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের বিপর্যয় যাতে নেমে না আসে তা নিশ্চিত করার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু যে ২৩৪ কোটি ডলার লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলা হচ্ছে, তার ক্ষুদ্রাংশও আর দেশে ফেরত আনা যাবে না। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে অনেকগুলো সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

আগামী দু–তিন মাসে হয়তো মূল্যস্ফীতিকেও সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাবে। কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বর্তমান অর্থবছরে ৪ শতাংশেও উন্নীত করা যাবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। পতনের আগে হাসিনার সরকার দাবি করে যাচ্ছিল যে বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ইতিমধ্যেই বিদেশি একটি গবেষণা সংস্থা এই দাবির বিপরীতে বক্তব্য রেখেছে যে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মোট জিডিপি বর্তমানে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে অবস্থান করছে। নিক লিয়া নামের এক গবেষক দাবি করেছেন, বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে ১৭৯৪ ডলার।      

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ শ র জনগণ প চ র হয় সরক র র জনস খ য ক ব যবস প রকল প জনগণ র ত হয় ছ ১৮ ল খ

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনীতিটাই যেন করে জাতীয় নাগরিক পার্টি

নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য: দল–মতনির্বিশেষে মানুষ রাজনীতির মাঠে সাফল্যের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন তাঁকে। আমরা বেশ আগে থেকেই জানতাম এবং দেখলাম, তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ‘ছাত্রদের দল’ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। তাঁর সঙ্গে নেতৃত্বের পর্যায়ে যুক্ত হয়েছেন আরও অনেক তরুণ, যাঁরা আমাদের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে ছিলেন সামনের সারিতে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগীরা ছাড়া আর সব রাজনৈতিক দল শুভকামনা জানাতে গিয়েছিল তাদের। বলা বাহুল্য, রাজনীতির মাঠে সাফল্য পাওয়ার জন্য শুভকামনাই যথেষ্ট নয়। তাঁরা নেমেছেন এক কঠোর লড়াইয়ে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউ নিজস্ব স্বার্থের অঙ্কের বাইরে তাঁদের ছাড় দেবেন না বিন্দুমাত্রও।

বেশ কঠিন একটা পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া দলটি কতটা সফল হতে পারবে? নবগঠিত দলটির নেতা-কর্মীদের মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে সফল হওয়ার জন্য রাজনীতিই করতে হবে তাঁদের। কেন ‘রাজনীতিই’ করার কথা বলছি, সেই প্রসঙ্গে আসব কলামের শেষ অংশে।

আরও পড়ুনসেকেন্ড রিপাবলিক, একটা বাক্যবিলাস ছাড়া আর কিছু নয়১০ মার্চ ২০২৫

যে সময়টায় ভারতে আম আদমি পার্টির মতো একটা দল তৈরি হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে দিল্লির মতো জায়গায় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়েছিল, সেই সময়ে বাংলাদেশেও এই আলাপ কেউ কেউ তোলার চেষ্টা করেছেন, এই ধাঁচের জনকল্যাণমুখী একটা দল কেন বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না।

আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাকালীন আসলে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। একটা রাষ্ট্রে যখন রাজনীতিই থাকে না, যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে ভয়ংকরতম বল প্রয়োগ করে একটা মাফিয়া রেজিম ক্ষমতা দখল করে রাখে, তখন রাজনৈতিক দল তৈরি হওয়া এবং সেটার বেড়ে ওঠার কোনো কারণ নেই। সেই প্রেক্ষাপটে অসাধারণ সব মানুষ একত্র হয়ে দুর্দান্ত সব কর্মসূচি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হলেও জনগণ তাঁদের আস্থায় রাখতে পারতেন না।

কারণ, ভোটের মধ্য দিয়ে কোনো দলকে নির্বাচিত করার ক্ষমতাই ছিল না তাদের হাতে। সেই প্রেক্ষাপটে এমন একটি দলের প্রয়োজন ছিল, যেটি বিরাট জনশক্তির জোরে তীব্র গণ-আন্দোলন তৈরি করার মাধ্যমে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারবে। সেই পরিস্থিতির অবসান হলো এবং প্রায় দুই দশক পর গণতান্ত্রিকভাবে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি হওয়া এবং তার বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ এখন বিরাজ করছে বাংলাদেশে।

রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির সাফল্যের আলোচনায় অনেকেই সামনে আনছেন এই দলের নেতৃত্বকে, যাঁরা শেখ হাসিনার মতো এক ভয়ংকর স্বৈরশাসকের পতন ঘটানো গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে ছিলেন। দেওয়া হচ্ছে এই যুক্তি, যেহেতু এত
বড় একটি কাজ তাঁরা করতে পেরেছেন, একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করে সাফল্য পাওয়া তাঁদের কাছে তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ কাজ।

একটা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটানোর দক্ষতা আর একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের তৃণমূল পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়ার দক্ষতা ভিন্ন। প্রথম দক্ষতাটি কারও থাকলে তাদের দ্বিতীয় দক্ষতা থাকতে পারবে না, এমনটা নয়। কিন্তু প্রথম দক্ষতাটি কোনোভাবেই দ্বিতীয় দক্ষতাটি থাকার নিশ্চয়তা দেয় না।

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারে তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন এবং সরকারের বাইরে থাকা সমন্বয়কদেরও সরকারের ওপরে প্রভাব খাটানোর আলোচনা আছে, তাই জাতীয় নাগরিক পার্টির সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তারা যে সরকারের সমর্থনে তৈরি হওয়া কোনো দল (প্রচলিত ভাষায় ‘কিংস পার্টি’) নয়, সেটা প্রমাণ করতে পারা।

জাতীয় নাগরিক পার্টি নিশ্চয়ই জানে, রাজনীতিতে বাস্তবতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পারসেপশন। দলে যোগ দেওয়ার জন্য পদত্যাগ করার আগপর্যন্ত যত দিন নাহিদ ইসলাম সরকারের অংশ ছিলেন, তত দিন তাঁর মনে গঠিত হতে যাওয়া দলটি ছিল না, সেটা হতে পারে না। একই কথা প্রযোজ্য বাকি দুই ছাত্র উপদেষ্টার ক্ষেত্রে, যাঁদের ভবিষ্যতে কখনো পদত্যাগ করে জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।

এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে গিয়ে সরকার থেকে পদত্যাগ করার যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সেটা যথেষ্ট নয়। ধরে নেওয়া যাক, সরকারের তিনজন উপদেষ্টা ঘোষণা করলেন, তাঁরা বিএনপিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন; কিন্তু সরকারে থেকে তাঁরা সেখানে যাবেন না। বিএনপিতে যোগ দেওয়ার আগে অবশ্যই তাঁরা সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন। এমন একটা পরিস্থিতি কি গ্রহণযোগ্য হবে?

শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর গণতান্ত্রিক উত্তরণের একটি পথরেখা মোটামুটি দৃশ্যমান। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ধরনের পথরেখা বারবার দেওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলছে। নানা চটকদার আলাপের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা আছে একটি প্রভাবশালী পক্ষের দিক থেকে। তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে এনসিপির বক্তব্যের অনেক ক্ষেত্রে মিলকে নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার বলে অনেকেই মনে করেন না।

আমাদের দেশে ‘কিংস পার্টি’ গঠন করার সাম্প্রতিক উদাহরণটি এক–এগারোর সময়কার। ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি) সে সময়কার বেসামরিক মুখোশপরা সেনাশাসকদের তত্ত্বাবধানে তৈরি হওয়া দল ছিল। কোরেশীর বেশ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার থাকলেও সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন জনপরিসরে প্রায় অপরিচিত। তাঁর দলটি ব্যর্থ হয়েছিল।

সেই তুলনায় এনসিপি দলটি যাঁদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে, কিছুদিন আগেই জনগণ দেখেছিল তাঁরা জীবন বাজি রেখে শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাঁদের প্রতি জনগণের যে আবেগ, তাঁরা সেটা সাংগঠনিক শক্তি এবং ভোটের অঙ্কে রূপান্তরিত করতে পারবেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।

এনসিপির সবচেয়ে বড় সংকট হবে সম্ভবত নিজেদের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ। শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেহেতু ডানপন্থী থেকে শুরু করে বামপন্থী পর্যন্ত সব ধরনের মানুষ অংশ নিয়েছে, দলটি চেয়েছে তাদের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে। এর জন্য একটা কার্যকর রাজনৈতিক পথ তাঁরা বেছে নিয়েছেন—মধ্যপন্থা।

আদর্শগত অবস্থানকে এড়িয়ে জনকল্যাণকে প্রধান করে তোলার মধ্য দিয়ে রাজনীতি তাদের এই বিরোধকে এড়াতে সাহায্য করার কথা। কিন্তু আমরা দলটি গঠন হওয়ার প্রাক্কালেই দেখেছি, আদর্শগত বিরোধ মাথা চাড়া দিয়েছে। নিজেদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রকাশ্য হয়েছে। দলটিতে ‘এক্স-শিবির’ কোন ধরনের পদে থাকবেন, সেটা নিয়ে তীব্র টানাপোড়েনের মধ্যেই দুজন আলোচিত সাবেক শিবির নেতা (আলী আহসান জুনায়েদ ও রাফে সালমান রিফাত), যাঁরা উভয়েই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির সভাপতি, দলেই আর যোগ দেননি।

বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে যেভাবে আদর্শগত বিরোধ নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই পরিকল্পিতভাবে উসকে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে দলটি এই লড়াই থেকে কতটা দূরে থাকতে পারবে, সেটা খুব বড় একটা প্রশ্ন।

আরও পড়ুননতুন দলের সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে যে প্রশ্ন০৫ মার্চ ২০২৫

এনসিপি আক্ষরিক অর্থেই তরুণদের দল। দেশে গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছেন বিদেশে থাকা অনেক তরুণ, যাঁরা খুবই চমৎকার সব পেশা ছেড়ে দেশে চলে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন অনাবাসী অনেক বাংলাদেশি, যাঁরা বিদেশে থেকেই অ্যাকটিভিজম করছেন, তহবিল সংগ্রহ  করছেন। তরুণদের প্রাণশক্তি দলটির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে এই দলকে খুব ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

কিন্তু ওদিকে আবার ‘ছাত্রদের দল’ ট্যাগটি এই দলের একটা দুর্বলতা হিসেবেও হাজির হতে পারে। অনভিজ্ঞ, অপরিণত মানুষদের দল এটি—এমন ধারণা এই দলের প্রতি নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের মতো অতি জটিল রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটের একটা দেশে শুধু জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধাই যথেষ্ট নয়, দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও রাজনীতির ক্ষেত্রে সফল হওয়ার একটি বড় পূর্বশর্ত। 

তীব্র গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পতন এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপি এখন এমন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মাঠে আছে, যাকে ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ করার মতো কার্যত কেউ নেই। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে এটা মোটামুটি নিশ্চিত—বিএনপিই ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাচ্ছে। রাজনীতিতে শূন্যস্থান থাকে না। রাজনীতির মাঠে বিএনপির প্রায় একচ্ছত্র অবস্থা থাকবে না, তাকে ভোটের রাজনীতিতেই চ্যালেঞ্জ করতে পারবে, এমন একটি দল আসবেই। এই মুহূর্তের সাংগঠনিক শক্তির বিচারে বিকল্প হিসেবে সামনে থাকছে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামপন্থী পরিচয়বাদী রাজনীতি। আমি বিশ্বাস করি, এর কোনোটিই এই রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য জুতসই হবে না। জনগণের জন্য চমৎকার বিষয় হবে, একটি মধ্যপন্থী দলের শক্তিশালী হয়ে ওঠা, যেটি সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ মনোযোগসহ সব জনগণের কল্যাণ নিশ্চিতে কাজ করবে। এই ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পার্টিকেও তার লক্ষ্য, আদর্শ ও কর্মসূচি জনগণের সামনে সহজবোধ্য ভাষায় দ্রুতই হাজির করতে হবে।

শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর গণতান্ত্রিক উত্তরণের একটি পথরেখা মোটামুটি দৃশ্যমান। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ধরনের পথরেখা বারবার দেওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলছে। নানা চটকদার আলাপের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা আছে একটি প্রভাবশালী পক্ষের দিক থেকে। তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে এনসিপির বক্তব্যের অনেক ক্ষেত্রে মিলকে নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার বলে অনেকেই মনে করেন না।

রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রের অংশ হওয়ার আকসার উদাহরণ থাকা এই দেশে আশা করি এনসিপি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হবে না। দলটি যেন রাজনীতিই করে। এটাই দীর্ঘ মেয়াদে দলটির নিজের এবং রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর।

জাহেদ উর রহমান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশকে করিডোর দিতে জাতিসংঘের আহ্বান
  • ঈদের আগেই প্রস্তুত হচ্ছে মিরপুরের ৬০ ফিট রাস্তা: ডিএনসিসি প্রশাসক
  • ধর্ষণের বিচার, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ, মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে কাফনমিছিল
  • অব্যাহত ধর্ষণ, খুন, নৈরাজ্য প্রমাণ করে দেশ চালাতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার: সিপিবি
  • ইফতারের রাজনৈতিক অর্থনীতি
  • কোনো স্বৈরশাসকই জনগণের কণ্ঠ রোধ করে জনরোষ থেকে রক্ষা পায়নি
  • বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে গাম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ
  • দাবি আদায়ের নামে কেউ রাস্তা অবরোধ করলে কঠোর ব্যবস্থা: আইজিপি
  • বন্ধু দেশ গাম্বিয়ার কাছে আরো বিনিয়োগ চান বাণিজ্য উপদেষ্টা
  • রাজনীতিটাই যেন করে জাতীয় নাগরিক পার্টি