১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণে ডুবিয়ে হাসিনা যেভাবে উন্নয়নের গল্প বানাতেন
Published: 13th, February 2025 GMT
আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থকদের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেড়ে রয়েছে যে শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনের মেয়াদকালে দেশের অর্থনীতি প্রশংসনীয় গতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু একজন নির্মোহ উন্নয়ন-গবেষক হিসেবে তাদের বলতে চাই, আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের খেসারত হলো ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভুয়া বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি বেলাগাম পুঁজি লুণ্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড সৃষ্টি।
শেখ হাসিনার সময়ে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছিল, সেটা ছিল ঋণ করে ঘি খাওয়ার ক্ল্যাসিক উদাহরণ, ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন।
হাসিনা তাঁর স্বৈরাচারী শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার ভয়াবহ কাহিনি তাঁর পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে।
৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।
এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অঙ্কের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভঙ্করের ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা।
ফলে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রতিজন বাংলাদেশির মাথার ওপর এক লাখ টাকার বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে। কমপক্ষে আগামী এক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ডুবে থাকবে এই বিশাল অঙ্কের ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধের দায় মেটানোর কারণে।
হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যেজন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গত সাড়ে পনেরো বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মহোৎসব কাল।
হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে পনেরো বছর ধরে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যার সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এই পুঁজি লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা। যে দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়স্বজন জড়িত রয়েছে, যেগুলোর প্রকল্প ব্যয় ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। হাসিনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং অলিগার্ক ব্যবসায়ীরাই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের প্রায় সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চস্তরের নেতা-কর্মী এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও গত সাড়ে পনেরো বছরে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারে জড়িয়ে গিয়েছিল।
বিশেষত, অজস্র ঋণ করার কৌশল পুরো জাতিকে যে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সাগরে নিমজ্জিত করেছে, সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়েছে এ জন্য যে ওই ঋণের সিংহভাগই স্রেফ পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। হাসিনা আমলের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল পুঁজি পাচার।
বিদেশি একটি গবেষণা সংস্থা এই দাবির বিপরীতে বক্তব্য রেখেছে যে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মোট জিডিপি বর্তমানে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে অবস্থান করছে। নিক লিয়া নামের এক গবেষক দাবি করেছেন, বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে ১৭৯৪ ডলার।গত ২ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড.
সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্যপ্রযুক্তি খাত। শ্বেতপত্রে খাতওয়ারি লুণ্ঠনের তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটন করে লুণ্ঠিত অর্থের প্রাক্কলন প্রকাশ করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে ২৮টি দুর্নীতির পদ্ধতির মাধ্যমে লুণ্ঠনপ্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণে নিয়ে আসা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
উপরন্তু সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামালের নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে ‘ডেটা ডক্টরিং’ এর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, একই সঙ্গে মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখানোর জন্য দেশের মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দেশের রপ্তানি আয়কে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারকে সব সময় কমিয়ে দেখানো হয়েছে।
দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যাকে কম দেখানো হয়েছে, যাতে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো যায়। দেশের জনগণের জন্মহার ও মৃত্যুহারকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো যায়। একই সঙ্গে দেশের ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেটকে’ কম দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল হচ্ছে প্রচার করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় আগের বছরে সাবেক সরকার যতখানি দেখিয়েছিল তার চাইতে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ১.৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে সাবেক সরকার দাবি করলেও তা প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি। দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার হার ১৮ শতাংশে নেমে গেছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই হার অনেক বেশি।
হাসিনা দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে রসাতলে নিয়ে গেছেন তাতে জনগণের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের বিপর্যয় যাতে নেমে না আসে তা নিশ্চিত করার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু যে ২৩৪ কোটি ডলার লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলা হচ্ছে, তার ক্ষুদ্রাংশও আর দেশে ফেরত আনা যাবে না। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে অনেকগুলো সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
আগামী দু–তিন মাসে হয়তো মূল্যস্ফীতিকেও সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাবে। কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বর্তমান অর্থবছরে ৪ শতাংশেও উন্নীত করা যাবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। পতনের আগে হাসিনার সরকার দাবি করে যাচ্ছিল যে বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ইতিমধ্যেই বিদেশি একটি গবেষণা সংস্থা এই দাবির বিপরীতে বক্তব্য রেখেছে যে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মোট জিডিপি বর্তমানে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে অবস্থান করছে। নিক লিয়া নামের এক গবেষক দাবি করেছেন, বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে ১৭৯৪ ডলার।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ শ র জনগণ প চ র হয় সরক র র জনস খ য ক ব যবস প রকল প জনগণ র ত হয় ছ ১৮ ল খ
এছাড়াও পড়ুন:
সুনামগঞ্জে বিএনপির সমাবেশে আরিফুল হক চৌধুরী: নির্বাচন যথাশীঘ্রই দিতে হবে
বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সুনামগঞ্জে অনুষ্ঠিত সমাবেশে দলের নেতারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয় বুধবার বেলা ১১টায় শহরের পুরাতন বাসস্টেশনে।
সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগ) মিফতাহ সিদ্দিকী, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জেলা বিএনপির স্বাক্ষরকারী সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল হকসহ আরও অনেকে।
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে। এবং যতটুকু প্রয়োজন সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে, যাতে জনগণ তাদের শক্তি পুনরায় পেতে পারে।
সকালে সমাবেশের জন্য শহর ও শহরতলি থেকে মিছিল করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুরাতন বাসস্টেশনে এসে জমায়েত হন। সমাবেশটি মূল সড়কে অনুষ্ঠিত হওয়ায় কিছুটা শৃঙ্খলা কম থাকলেও, সমাবেশের শেষ সময় পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য শুনতে থাকেন।
বক্তব্যে দ্রুত নির্বাচনের দাবি উঠলেই, সমাবেশে উপস্থিত জনতা ও বিএনপি নেতা-কর্মীরা সজীবভাবে প্রতিধ্বনি করেন। সমাবেশে যোহরের নামাজের সময় হওয়ার কারণে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং মঞ্চে থাকা অনেক স্থানীয় নেতাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
আরিফুল হক চৌধুরী সমাবেশে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, দলে কোনো ধরনের দুষ্কৃতিকারি যেনো ঢুকতে না পারে। বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করার মতো কোনো কাজ করবেন না। যারা আওয়ামী দুঃশাসনে যুক্ত ছিলো, তাদের কোনোভাবেই দলে আনা যাবে না।
তিনি জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা এবং ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করাসহ নানা জনদাবিতে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের নেতা তারেক রহমান ক্ষমতায় আসলে সুনামগঞ্জের সকল সেক্টরে উন্নয়ন হবে। তিনি সুনামগঞ্জবাসীর আন্দোলনের প্রতি মুগ্ধতার কথা জানান, যা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে।