চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শত শত হত্যাকাণ্ড, মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর পেছনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ কীভাবে দায়ী ছিল, তার অসংখ্য তথ্যপ্রমাণ গত কয়েক মাসে দেশের গণমাধ্যম, সরকারের তদন্ত সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠনের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসছিল। এবার জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন সেই সত্যকেই নিরেট ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। কেননা, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) অনুসন্ধানী দল শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে।

বুধবার জেনেভা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। জাতিসংঘের দলটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আটটি বড় শহর, যেখানে বেশি মাত্রায় বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছিল, সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান চালায়। প্রতিবেদন তৈরির জন্য তারা অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁরা ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত, তঁাদের সাক্ষাৎকার নেয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের বিরোধিতার মুখেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল সাবেক সরকার। আর সে লক্ষ্য পূরণে বিক্ষোভ দমন করতে ‘পরিকল্পিত’ ও ‘সমন্বিত কৌশলের’ মাধ্যমে নৃশংসতা চালিয়েছিল। তাঁর এই অভিমত অত্যন্ত যৌক্তিক। কেননা, পরপর তিনটি জোরজবরদস্তির নির্বাচন করার পর নাগরিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমে এসেছিল।

জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দলের তথ্যমতে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের ১২-১৩ শতাংশ শিশু। তাঁদের বেশির ভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর মারণাস্ত্র ও শটগানের গুলিতে নিহত হয়েছেন। অনেককে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ‘টার্গেট কিলিং’ করা হয়েছে। হাজারো মানুষ গুরুতর ও চিরতরে আহত হয়েছেন। ১১ হাজার ৭০০-এর বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হন।

এসব পরিসংখ্যান শুধু অপরাধের ভয়াবহতা ও বিস্তৃতিকেই প্রকাশ করে না; অভ্যুত্থানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাপ্রবাহের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণকেও হাজির করে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন স্পষ্ট করে বলেছে, স্বৈরাচারী সরকার নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, দল ও সহযোগী সংগঠনকে যুক্ত করে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। আন্দোলনকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

আমরা মনে করি, জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পর জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত শত শত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাপ্রবাহের সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি নতুন মাত্রা পেল। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার যাঁরাই এসব গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের সবাইকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

ফলকার টুর্ক অপরাধীদের ফেরাতে ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের প্রয়োগ, আইসিসিতে অনুরোধ জানানোর কথা বলেছেন। আমরা আশা করি, শেখ হাসিনাসহ পলাতক অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকার এটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাবে।

জাতিসংঘ দলের প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণে জড়িত ব্যক্তিরা দায়মুক্তি ভোগ করছেন। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনার ক্ষেত্রেও পক্ষপাতহীন পদক্ষেপ নেবে।

জাতিসংঘ তাদের প্রতিবেদনে র‍্যাব ও এনটিএমসিকে বিলুপ্ত করা, অবাধ নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করাসহ ৫০টির মতো সুপারিশ দিয়েছে। আমরা আশা করি, এসব সুপারিশ সরকার গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেবে। সর্বোপরি, জুলাই-আগস্টের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণই বাংলাদেশকে বিগত স্বৈরশাসনের দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে পারে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র ত হয় ছ অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

ঘরোয়া রান্নার স্মৃতিময় বই ‘খাদ্যবিলাস’

নাম বললেই চেনা যাবে, আনোয়ারা তরফদার এমন কোনো বিখ্যাত রন্ধনশিল্পী নন। তাঁর রান্না একান্তই ঘরোয়া, তবে তাঁর সৃজনশীলতা ভিন্নতর। সেসব রান্নার রেসিপি নিয়েই প্রকাশিত তাঁর রান্নার বই ‘খাদ্যবিলাস’–এর মোড়ক উন্মোচন হলো আজ বুধবার সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে।

একসময়ের জনপ্রিয় সাময়িকী সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় প্রায় ৩০ বছর আগে আনোয়ারা তরফদারের রান্নার রেসিপিগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। পরে সেই লেখাগুলো নিয়ে বইও প্রকাশিত হয়। অনেক দিন থেকেই বইটি বাজারে ছিল না। আনোয়ারা তরফদারের মেয়ে কবি শামীম আজাদ বইটি নতুন করে সম্পাদনা ও পরিবর্ধন করেছেন। প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেন, ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত পরিবারের রান্নার বিলাস বাহুল্য ছিল না বটে, কিন্তু তার মধ্যেও বিশেষ বিশেষ দিনে প্রিয়জনদের সামনে ভালোমন্দ রান্না তুলে ধরতে চাইতেন সব গৃহিণী। সীমিত বাজেটে কীভাবে হৃদয়, বুদ্ধি, মমতা এবং ভালোবাসায় সাধারণ রান্নাকে অসাধারণ সুস্বাদু করে আপনজনের রসনা তৃপ্ত করা যায়, সে ব্যাপারটি আনোয়ারা তরফদারের ‘খাদ্যবিলাস’ বইটিতে রয়েছে।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘আমরা এখন বাণিজ্যের পৃথিবীতে বসবাস করছি। একটা সময় প্রকৃতি ও সভ্যতা জড়াজড়ি করে থাকত। এখন চলছে প্রকৃতি বিনাশী কর্মকাণ্ড। এই রান্নাগুলো কেবল খাদ্য প্রস্তুত করা নয়, এর সঙ্গে সেই সময়ের যৌথ জীবন, সংস্কৃতি, প্রকৃতি সংলগ্নতা আর মায়া–মমতার বিষয়ও মিলে মিশে আছে। এই রান্না একান্তই বাঙালির ঘরোয়া রান্না। ঘরে ঘরে বাঙালির রান্না যেন টিকে থাকে, সেই কামনা করি।’

অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহানের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন শাহীন আনাম, আফজাল হোসেন, আব্দুন নূর তুষার, আলপনা হাবিব ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মজুমদার বিপ্লব। মায়ের স্মৃতিচারণা করেন ছেলে ফজলে আকবর তফরদার ও বইটির সম্পাদক কবি শামীম আজাদ। ধন্যবাদ জানান নাতি লাবিব তালুকদার।

‘খাদ্যবিলাস’ বইটি নিয়ে আলোচকেরা বলেছেন, এই রান্নার মধ্যে জড়িয়ে আছে স্মৃতি। একটি সময়কে ধরে রাখা আছে। এগুলো আসলে মায়ের হাতের রান্না। আর মায়ের হাতের রান্না শুধু খাদ্য নয়, অমৃতের মতো।

আনোয়ারা তরফদারের জন্ম গত শতকের ত্রিশের দশকে বৃহত্তর সিলেটে। স্বামী ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। স্বামীর চাকরিসূত্রে অবিভক্ত ভারতের আসাম ও পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন। স্বামীর সীমিত আয়ে তিনি নিপুণভাবে সংসার পরিচালনা করেছেন। বাঙালির চিরায়ত রান্নায় তাঁর ছিল বিশেষ পারদর্শিতা। এ ছাড়া সূচিকর্ম, মৃৎপাত্রে অঙ্কনসহ বিভিন্ন কারুকর্মেও তাঁর বিশেষ সৃজনশীলতা ছিল। একটা সময় তিনি ঢাকায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেয়েদের পুঁতির গয়না তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ