আয়কর ও ভ্যাট আদায়ের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার
Published: 13th, February 2025 GMT
রাজস্ব আয় বাড়াতে আগামীতে আয়কর ও ভ্যাটের ওপর জোর দেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। এ জন্য আয়কর এবং ভ্যাট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন করা হবে বলে অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাজার উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক হ্রাস পাবে। ফলে, আয়কর এবং ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে আয়কর এবং ভ্যাট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন জরুরি। একইসঙ্গে দেশব্যাপী আয়কর অফিস স্থাপন করা সম্ভব হলে তৃণমূল পর্যায় থেকেও আয়কর আহরণ সম্ভব হবে।
এতে বলা হয়েছে, কর-ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কর আদায় থেকে করনীতি সম্পূর্ণ পৃথক করতে হবে, যার প্রাথমিক কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে জড়িত সবার দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ জোরদার করা হবে। একই সঙ্গে করজাল সম্প্রসারণ এবং কর প্রতিপালন বৃদ্ধিও জরুরি।
আয়কর বাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিবেদনে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কর-বান্ধব পরিবেশ ও নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য আয়কর বিভাগের পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আয়কর আইন, ২০২৩ এর প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
কর ব্যয় (কর ছাড়) হ্রাস করার লক্ষ্যে ছয়টি কর অব্যহতির এস.
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ই-রিটার্ন সিস্টেমকে অধিকতর করদাতাবান্ধব করার ই-রিটার্ন কল সিস্টেম চালু করা হয়েছে। রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও করবান্ধব সেবার প্রসারে আয়কর বিভাগের সম্প্রসারণ করে ১০টি কর অঞ্চল, ৩টি বিশেষ ইউনিট কার্যক্রম শুরু করেছে।
ভ্যাট আদায় বাড়ানোর পদক্ষেপের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভ্যাট আদায় বৃদ্ধিতে ‘কর অব্যহতি’ যৌক্তিককরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ভ্যাট সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান পদ্ধতি সহজীকরণ মাঠ পর্যায়ে দিকনির্দেশনা ও ব্যাখ্যাপত্র জারি করা হয়েছে এবং ভ্যাট আইন ও বিধি সংস্কারের কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল আশিভাগ থেকে শতভাগে উন্নীতরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ভ্যাট আদায় বাড়ানোর জন্য তালিকাভূক্ত সীমা (৫০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকায়) ও নিবন্ধনসীমা (৩ কোটি থেকে ৫০ লাখ টাকায়) হ্রাস করা হয়েছে। আমদানি পর্যায়ে ও সরবরাহ পর্যায়ে কতিপয় সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্য ও ভ্যাট আরোপযোগ্য সেবার ওপর সম্পূরক শুল্কহার বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সিগারেট এর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য পুনঃনির্ধারণ ও সম্পূরক শুল্কহার বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা/হাসনাত/টিপু
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পদক ষ প পর য য় র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের সঙ্গে ডাকাতেরও ভয়
দেশে প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন। এই বনের গহিনে মৌচাকে মধু জমায় মৌমাছি। আর সেই চাক খুঁজে বের করে মধু সংগ্রহ করেন একদল মানুষ। তাঁদের বলা হয় মৌয়াল। মধু আহরণের মৌসুম এলেই দল বেঁধে সুন্দরবনে ছুটে যান তাঁরা।
ঘ্রাণ ও স্বাদ ‘অতুলনীয়’ সুন্দরবনের এই মধু সংগ্রহ করতে ‘জীবনবাজি’ রাখতে হয় মৌয়ালদের। এত দিন শুধু নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয় ছিল। কিন্তু এবার যুক্ত হয়েছে বনদস্যুদের ভয়। মৌয়ালরা বলছেন, কয়েকটি দস্যু দল মৌয়ালদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে।
সুন্দরবনে এখন চলছে মধু সংগ্রহের মৌসুম। গতকাল বুধবার খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় মৌয়াল আকতার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাপ-দাদার পেশা হিসেবে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করে আসতিছি। প্রতিটি বছর মধু কাটার মৌসুমের অপেক্ষায় থাকি। বনের সাপ, কুমির ও বাঘের ভয়ে কখনো পিছুপা হইনি। তবে এবার ডাকাতির ভয়ে জঙ্গলের বেশি ভেতরের দিকে যাইনি। তাই মধু একটু কম পাইছি। মঙ্গলবার এলাকায় ফিরে ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিছি।’
১ এপ্রিল শুরু হয়েছে সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম। আগামী ৩১ মে পর্যন্ত টানা দুই মাস বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে চলবে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ।
গতকাল সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামের মৌয়াল আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টানা ১৪ দিন সুন্দরবনে অবস্থান করে ১৭ মণ মধু নিয়ে আজ লোকালয়ে ফিরে এসেছি। আমরা এক নৌকায় ৭ জন ছিলাম। আগে বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। এবার সবার মধ্যে ডাকাত দলের ভয়। মন খুলে জঙ্গলে চলা যায় না।’
আগে বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। এবার সবার মধ্যে ডাকাত দলের ভয়। মন খুলে জঙ্গলে চলা যায় না।আবুল কালাম, মৌয়ালপ্রতিবছর সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যান কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার বনজীবী মনিরুল ইসলাম। গতকাল সকালে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয়ের সঙ্গে এবার ডাকাতেরও ভয়। তবে জীবন বাজি রেখে ৮ জনের মৌয়াল দলের সঙ্গে একটি নৌকায় আমিও সুন্দরবনে এসেছি। ভয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি বনে থাকায় মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি। তবে বনের মধ্যে এবার চাকের পরিমাণ বেশি মনে হচ্ছে। মধুও ভালোই পাচ্ছি।’
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, গত বছর মধু আহরণ থেকে ৫০ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এবার পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে ৪ হাজার ৪৬০ জন মৌয়াল ৬৭৫টি নৌকা নিয়ে মধু আহরণে সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি নিয়েছেন। সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে মধু আহরণের জন্য বন বিভাগের টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টালে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। এ বছর সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কুইন্টাল।
দস্যু বাহিনীর সদস্যদের ধরতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৯ এপ্রিল সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর হাতে জিম্মি ৬ নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।দস্যুদলের উৎপাত
কয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকা থেকে মধু কাটতে যাওয়া কয়েকজন মৌয়াল বলেন, সুন্দরবনে ঢুকতেই তাঁদের দস্যুদল ‘দয়াল বাহিনীকে’ জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া ‘দুলাভাই বাহিনী’ নামের আরেক দস্যুদলকে দিতে হয়েছে জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা। এভাবে কয়েকটি দস্যুদল বনজীবীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করছে।
জেলে-বাওয়ালিরা বলছেন, এখন সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, মামা-ভাগনে বাহিনীসহ কয়েকটি বনদস্যু দল। এসব বাহিনীর হাতে অনেক জেলে ও মৌয়াল মাছ, মধু ও টাকা খোয়াচ্ছে।
এসব দস্যু বাহিনীর সদস্যদের ধরতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৯ এপ্রিল সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর হাতে জিম্মি ৬ নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।
এর আগে ৭ এপ্রিল সুন্দরবনের পুরোনো ঝাপসি ফরেস্ট অফিসসংলগ্ন এলাকায় কোস্টগার্ড সদস্যরা অভিযানে গেলে তাঁদের দেখে ২টি একনলা বন্দুক, ১১টি ফাঁকা কার্তুজ ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম ফেলে পালিয়ে যায় ডাকাত করিম শরীফের বাহিনী।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ইশমাম হাসান ফাহিম বলেন, ‘বনদস্যুদের দমনে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এর আগে সুন্দরবন থেকে বন্দুক, গুলিসহ ডাকাত সর্দার আসাবুরকে তাঁর সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। করিম শরীফ বাহিনীকেও স্থির হতে দিচ্ছি না। একের পর এক অভিযান চলছে। জননিরাপত্তায় কোস্টগার্ডের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
যেভাবে মধু সংগ্রহ
বনের ভেতর অসংখ্য শ্বাসমূল ও বিভিন্ন গাছের কাঁটা থাকে। এসব যেন পায়ে না ফুটে যায়, তাই বনে পা ফেলার আগে বিশেষ প্লাস্টিকের জুতা পরে নেন মৌয়ালরা। নিজেরা প্রস্তুত হওয়ার পাশাপাশি মৌমাছির চাক কেটে মধু সংগ্রহের জন্য নিতে হয় দা, বড় ড্রাম, বড় পাত্র ও মৌমাছির কামড় থেকে বাঁচার জন্য মুখে দেওয়ার নেট জাল ও গামছা।
নৌকা থেকে বনে নেমেই মৌয়ালরা ভাগ হয়ে ২০-২৫ হাত দূরত্ব রেখে মৌচাক খুঁজতে বনে হাঁটতে শুরু করেন। ঘন জঙ্গলে কেউ যাতে দলছুট না হয়ে পড়েন, সে জন্য একটু পরপর শব্দ করা হয়। সেই শব্দ শুনে পাল্টা শব্দের মাধ্যমে বাকিরা তাঁদের অবস্থান জানান দেন। এভাবে চাক খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত বনের ভেতর হাঁটতে থাকেন তাঁরা। মৌচাক খুঁজে পেলেই সবাই একত্র হয়ে শুরু হয় চাক কাটার প্রস্তুতি। চাক কাটার জন্য একজন নির্দিষ্ট গাছি থাকেন, যিনি গাছে উঠে চাক কাটেন।
বনদস্যুদের দমনে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এর আগে সুন্দরবন থেকে বন্দুক, গুলিসহ ডাকাত সর্দার আসাবুরকে তাঁর সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। করিম শরীফ বাহিনীকেও স্থির হতে দিচ্ছি না। একের পর এক অভিযান চলছে।লেফটেন্যান্ট ইশমাম হাসান ফাহিম, কোস্টগার্ডের কর্মকর্তাচাক কাটার প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল একটি বিষয়। প্রথমে ধোঁয়া তৈরির জন্য শুকনা পাতা জোগাড় করে মৌয়ালদের দক্ষ হাতে শুরু হয় ‘কাড়ু’ তৈরির কাজ। হুদো নামের একধরনের লম্বাটে শুকনা গাছ আর তার চারপাশে কাঁচা গোলপাতা দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয় কাড়ু। মূলত এই কাঁচা ডালপালা দিতে হয় ধোঁয়া তৈরির জন্য।
মুখে গামছা বা নেট জাল বেঁধে হাতে দা ও কাড়ু নিয়ে মধু সংরক্ষণের জন্য ড্রামসহ গাছের ওপর উঠতে হয়। তারপর মৌমাছি তাড়ানোর জন্য কাড়ুটা মৌচাকের কাছাকাছি ডালের সঙ্গে বেঁধে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়ানো হয়। আস্তে আস্তে মৌমাছি চলে গেলে মধুর চাক দৃশ্যমান হয়। পুরো চাকের তিন ভাগের মাত্র এক ভাগে থাকে মধু। মধু রাখার ড্রামটি মৌচাকের নিচে ধরে দা দিয়ে মধুর অংশটা কাটতেই মধুসমেত চাকটি পড়ে ড্রামের মধ্যে।
এরপর কাড়ু আর মধুর পাতিল নিয়ে গাছি বাকি সদস্যদের কাছে চলে আসে। বাকিদের মধ্যে একজনের দায়িত্ব থাকে মোমসহ চাক চেপে মধু ও মোম আলাদা করা। মধু পাত্রে রাখা হয়। এরপর আবার শুরু হয় নতুন চাক খোঁজা। এভাবেই সারা দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন মৌয়ালরা।