পলক জেলে, তবে থেমে নেই সেই চক্রের দুর্নীতি
Published: 13th, February 2025 GMT
হাসিনা সরকারের আমলে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ঘনিষ্ঠ আমলাদের নেতৃত্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল দুর্নীতির জাল। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে আইসিটি বিভাগ থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এই চক্রের বিরুদ্ধে। এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তারা একই কায়দায় লুটপাটের ছক কষছে। আইসিটি বিভাগ, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং তদন্তকারী সূত্রগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, আমলাদের কেউ কেউ আগে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কেউ কমিশন, নিয়োগ বাণিজ্য দেখভাল করতেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও চক্রের সদস্যরা আছেন বহাল তবিয়তে। ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পদোন্নতি ও বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল প্রতারণায় পুরোনো সিন্ডিকেট
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প ও দপ্তরের কার্যক্রম থেকে গত ১০ বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে তথাকথিত পলক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। পুলিশ রিমান্ডে পলক তাঁর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট সদস্যদের নাম প্রকাশ করেন। তারা হাই-টেক পার্কের দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন।
সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে পলক জানিয়েছেন, হাই-টেক পার্কের দুর্নীতিতে তাঁর সঙ্গে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সাবেক এমডি বিকর্ণ কুমার ঘোষ, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সাবেক পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) তবিবুর রহমান, হাই-টেক পার্কের ১২ আইটি প্রকল্পের পরিচালক এ কে এ এম ফজলুল হক।
এই সিন্ডিকেটে সহযোগিতাকারী হিসেবে পলকের স্কুলবন্ধু ও তাঁর সাবেক পিএস আবদুল বারি, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, চট্টগ্রাম) নরোত্তম পাল, জনসংযোগ কর্মকর্তা (হাই-টেক পার্ক, কালিয়াকৈর, গাজীপুর) গোলাম কিবরিয়া, উপপরিচালক (পরিকল্পনা) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পিএসের দায়িত্ব পালনকারী শফিক উদ্দিন ভূঁইয়া এবং হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট নুরুল ইসলামের নামও এসেছে।
জানা গেছে, পলকের অর্থের মূল জোগানদাতা নুরুল ইসলাম রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও সক্রিয়। কারওয়ান বাজারে ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক-২ (স্মার্ট টাওয়ার) নির্মাণে ঠিকাদার স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সকে কাজ দিতে পলকের নির্দেশে তাদের সুবিধামতো শর্তাবলি ও স্পেসিফিকেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
হাই-টেক পার্ক ঘিরে দুর্নীতি
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য মিলেছে। তদন্ত কমিটি বিভিন্ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত অপচয়, অসংগতি, দুর্বলতা, আর্থিক ক্ষতি, অসম চুক্তি, সুবিধাভোগী নির্বাচনে অসচ্ছলতা, জনবল নিয়োগে অনিয়ম, অনৈতিকতা, একই কাজ বারবার করার মতো বিভিন্ন বিষয় চিহ্নিত করেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন এবং অন্যান্য নির্মাণ প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করায় অর্থের অপচয়, অধিক ভূমি উন্নয়ন ব্যয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করে মোটা অঙ্কের টাকা অপচয় করা হয়েছে।
জেলা পর্যায়ে আইটি বা হাই-টেক পার্ক স্থাপন প্রকল্পে (১২ জেলায়) দরপত্রের একমাত্র বিডার থাকার পরও কার্যাদেশ দিতে ছয় মাস দেরি করা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের শুরুতেই পরিচালক ফজলুল হক পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাতে শুরু করেন, যাদের দক্ষতা নিয়ে পরবর্তী সময়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার কেরানীগঞ্জের নলেজ পার্ক নির্মাণকাজে নিম্নমানের বালুর ব্যবহার, নির্মাণকাজের শাটারিংয়ের ক্ষেত্রে স্টিল ব্যবহার, বিলবোর্ড বা ব্যানার খাতে নানা অনিয়ম দেখা গেছে।
প্রকল্পটিতে ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে পরিচালক এ কে এ এম ফজলুল হক জানিয়েছেন, বাড়তি বাজেটের মধ্যে ১ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা ভ্যাটের জন্য। আগে প্রকল্পে ভ্যাটের টাকা ধরা ছিল না। শর্ত অনুযায়ী, ৬৫ শতাংশই ভারত থেকে আমদানি করতে হচ্ছে, তাই ভ্যাট দিতে হচ্ছে।
কারও কথা কর্ণপাত করতেন না বিকর্ণ
বিকর্ণ কুমার ঘোষ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উচ্চ বাজেটের প্রকল্প হাই-টেক পার্কের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি পলকের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত। ইনফো-সরকার প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সামিট গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিয়ে কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর প্রকল্পের বিষয়ে সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাগাভাগির ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযোগ রয়েছে, নিউইয়র্কে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কনসার্ট ও রোড শো আয়োজনের ক্ষেত্রে শর্ত লঙ্ঘন করে চুক্তির পুরো টাকা ঠিকাদারকে আগেই দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর হাত ছিল। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের আয়োজনে পরিচালিত এই শোতে শতকোটি টাকার চাঁদাবাজি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন সময় পলকের অর্থ পাচারের সঙ্গে বিকর্ণের আরও দুই সহকারীর নাম উঠে আসে। তারা হলেন গোলাম কিবরিয়া ও নরোত্তম পাল। তবে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে কোনো বক্তব্য দেননি বিকর্ণ কুমার ঘোষ।
দুর্নীতির বরপুত্র তবিবুর
পলকের দুর্নীতির প্রধান হোতা তবিবুর রহমান। দীর্ঘকাল আইসিটি বিভাগের উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা এই কর্মকর্তা পলকের আজ্ঞাবহ হয়ে হাই-টেক পার্কের পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) হিসেবে ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর যোগ দেন। জয়-পলকের সহযোগী হিসেবে এনআইডির তথ্য পাচারের ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি হলেও এখনও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সমকাল।
অন্ধকার জগতের সঙ্গী গোলাম কিবরিয়া
হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের জনসংযোগ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। পলকের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এই কর্মকর্তা নানা অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কনসার্টের নামে হাই-টেক পার্কের প্লট নেওয়া কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া হাই-টেক পার্ক ও অন্যান্য প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য, হাই-টেক পার্কের সব প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ও প্রকাশনার কমিশন বাণিজ্য, গাড়িচালকের সঙ্গে যোগসাজশে তেলের হিসাব নয়ছয় এবং প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ গোলাম কিবরিয়াকে সিলেট হাই-টেক পার্কে বদলি করা হয়। তবে প্রভাব খাটিয়ে কিবরিয়া ছয় মাস পরই ২৯ সেপ্টেম্বর বদলির আদেশ পরিবর্তন করে গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কে চলে আসেন। সেখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও তিনি নিয়মিত অফিস না করে খাতায় সই করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া প্রভাব খাটিয়ে কিবরিয়া সরকারি জিও নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘গোল্ডেন জুবিলী বাংলাদেশ কনসার্টে’ গিয়ে ডিড প্রকল্প থেকে ১৪ দিনের জন্য ৩ হাজার ৩৪৯ ডলার বা ৪ লাখ ৮ হাজার ৬৩৯ টাকা তুলে নেন।
নরোত্তম পালের কমিশন নিয়ন্ত্রণ
হাই-টেক পার্কের দুর্নীতির আরেক কারিগর নরোত্তম পাল স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মাশরুর আলম মিলনের সহযোগী ছিলেন। রাজশাহী কলেজে পলকের শিক্ষক নৃপেন্দ্র নাথ পালের ছেলে হওয়ায় নরোত্তম ২০১৪ সালে হাই-টেক পার্কে সহকারী প্রকৌশলী (ই/এম) পদে নিয়োগ পান। সেই সময় এমডি হোসনে আরাকে চাপ দিয়ে নরোত্তম পালকে নিয়োগ দিতে বাধ্য করেন পলক।
জানা যায়, হাই-টেক পার্কের শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন প্রকল্পের (১১ আইটি) প্রায় ৮০০ কোটি টাকার কাজ ডিপিএম দরপত্র পদ্ধতির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রহমান ট্রেডার্স লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরাও সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে কাজ করছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন পলক। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নরোত্তম পাল সমকালের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।
গবেষণা না করেও কর্মকর্তা
ছাত্রলীগ কর্মী শফিক উদ্দিন ভূঁইয়া। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর হাই-টেক পার্কের গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। লিখিত পরীক্ষায় নবম হলেও ছাত্রলীগের পরিচয়ে কিশোরগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য ডা.
হিসাব অফিস সূত্রে জানা যায়, তিনি গত অর্থবছর আপ্যায়নের নামে ৩৮ লাখ টাকার বিল তুলেছেন, যা হিসাব শাখার নথিপত্র পর্যালোচনায় ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এ ছাড়া বর্তমানে এমডি আমিরুল ইসলাম একজন অতিরিক্ত সচিব। আইন অনুযায়ী তাঁর পিএস পাওয়ার কথা নয়। তবু তিনি হাই-টেক পার্কের রিসার্চ অফিসার শফিক উদ্দিন ভূঁইয়াকে পিএস হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। প্রকৌশলী না হয়েও সম্প্রতি আমিরুল ইসলাম তাঁকে প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালকের (পরিকল্পনা) দায়িত্বও দিয়েছেন, যা নিয়মের বড় ধরনের ব্যত্যয়।
সম্প্রতি মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পার্ক কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না করে অতিরিক্ত অনুদান নেওয়ার ফলে বড় অনিয়ম ঘটেছে।
এ বিষয়ে জানতে এ কে এম আমিরুল ইসলামকে বারবার ফোন করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, হাই-টেক পার্কের কিছু প্রকিউরমেন্টে মনোপলির অভিযোগ রয়েছে। ইনফো-সরকারের তিনটি ফেজে অনিয়ম হয়েছে বলে তথ্য আছে। ইনফো-সরকার প্রকল্পে বিটিসিএল ছাড়াও ফাইবার অ্যাট হোম ও সামিট কমিউনিকেশন্স কাজ করেছে। আমরা রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদ রক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে দিচ্ছি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ভ ন ন প রকল প গ ল ম ক বর য় র ল ইসল ম র প রকল প প রকল প র ব যবস থ মন ত র ব কর ণ পর চ ল র পর চ ক জ কর আইস ট সরক র তদন ত সহয গ রহম ন পলক র
এছাড়াও পড়ুন:
নতুন চেতনায় বর্ষবরণের আয়োজন
‘তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥ ... এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ কালের গর্ভে হারাল পুরোনো বছরের সব পঙ্কিলতা, সব পাপ-তাপ ধুয়ে-মুছে নতুন দিনের উজ্জ্বল আভায় হাসবে স্বদেশভূমি, বর্ণিল সুখচ্ছটায় ভাসবে মানবজীবন– এই প্রত্যাশা নিয়েই শুরু বঙ্গাব্দ ১৪৩২। স্বাগত বাংলা নববর্ষ।
আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাণবন্ত, হৃদয়ছোঁয়া ও সর্বজনীন উৎসব। বছরের প্রথম সূর্যের আলোয় বাঙালির হৃদয়ে জেগে ওঠে আশার গান। এই দিনে পুরোনো গ্লানি ঝেড়ে শুরু হয় নতুন পথচলা। বাংলা নববর্ষ শুধু একটি দিন নয়; এটি বাঙালির জীবনে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ঐক্য ও প্রাণের মিলনমেলা।
এবারের পহেলা বৈশাখের আবহ অন্যবারের চেয়ে একটু আলাদা। গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পালাবদলের পর এটাই প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন। নতুন চেতনায় বর্ষবরণ আয়োজনের প্রচেষ্টা চলছে দেশজুড়ে। বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি বদলে নতুন নাম হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। তিনি দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি দেশ ও বিশ্বের সব মানুষের উত্তরোত্তর সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এদিকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম বদলের বিষয়টি নিয়ে এখনও বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতির সনদে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা অন পহেলা বৈশাখ’ নামেই বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনটিকে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন নাম বদলের ফলে জাতিসংঘের সংস্থার স্বীকৃতিতে প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৬ সালে বাংলা বছরকে বরণ করে নেওয়ার এই উৎসবটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। এ ছাড়া আনন্দ শোভাযাত্রায় প্রদর্শনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নির্মীয়মাণ ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ দুটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়ও বিতর্ক চলছে।
এমন আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্কের মধ্যেই গোটা জাতি আজ প্রাণের উচ্ছ্বাসে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে মাতবে। বর্ণিল আয়োজনে নতুন বছর উদযাপনের অনুষ্ঠানমালা থাকবে দেশজুড়ে। ঢাকায় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ছাড়াও সারাদেশে থাকবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন। গ্রাম-শহরে বৈশাখী মেলা, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা ছাড়াও থাকবে ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তা-ইলিশ। সেই সঙ্গে থাকবে হালখাতার ঐতিহ্য। ব্যবসায়ীরা লাল খাতা ও নতুন ক্যালেন্ডার বিতরণ করবেন, সঙ্গে থাকবে মিষ্টান্ন বিতরণ।
মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে তাঁর শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলা সাল প্রবর্তন করেন। সেই সময় রাজস্ব আদায় হতো হিজরি চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী, যা ছিল পুরোপুরি চন্দ্রনির্ভর। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এটি ছিল অনুপযোগী। কারণ, কৃষির মৌসুম অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ইত্যাদি কৃষি মৌসুম ও আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মিশ্র সৌর ও চন্দ্র পদ্ধতির ভিত্তিতে তৈরি হয় ‘তারিখ-ই-ইলাহি’, যা-ই পরে পরিচিতি পায় বাংলা সাল নামে। এই পঞ্জিকা প্রস্তুত করেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী।
যদিও শুরুতে নববর্ষ ছিল প্রশাসনিক কর আদায়ের দিন, ধীরে ধীরে এটি রূপ নেয় একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে। গ্রামবাংলার মানুষ একে একত্রে পালন করতে শুরু করে। রাজস্ব পরিশোধের পর আয়োজিত হতো ‘হালখাতা’, যেখানে ব্যবসায়ীরা পুরোনো হিসাব শেষ করে মিষ্টিমুখ করতেন নতুন খাতা খুলে।
আদিবাসীরা নববর্ষ ঘিরে নিজেদের মতো করে স্বাজাত্যবোধ বজায় রেখে উৎসবের রং ছড়ান। পাবর্ত্য তিন জেলায় আদিবাসীরা উদযাপন করে ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবি। এর নামকরণ হয়েছে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু এই শব্দগুলোর আদ্যক্ষর থেকে। এ উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক বলে অভিহিত করেন।
দিনভর নানা আয়োজন
উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাজধানীতে আজকের দিনের মূল আকর্ষণ থাকবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এই শোভাযাত্রা আজ সোমবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বের হবে। পরে এটি শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে ফের চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হবে।
রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে সকাল সোয়া ৬টা থেকে সোয়া ৮টা পর্যন্ত থাকবে বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন। সকাল থেকে ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে থাকবে সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানমালা। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিকেল ৩টায় কনসার্ট এবং সন্ধ্যা ৭টায় চীনা দূতাবাসের সহযোগিতায় ড্রোন শো অনুষ্ঠিত হবে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রাজধানীর তোপখানা রোডের সত্যেন সেন চত্বরে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দিনভর লোকসংস্কৃতি উৎসব ও বৈশাখী আড্ডার আয়োজন করেছে। সেখানে থাকবে চারুকারুপণ্যসহ বৈশাখী মেলার আয়োজন। নবপ্রাণ আন্দোলনের আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী ‘বৈশাখী উদযাপন আয়োজন’ থাকবে।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে আজ ও আগামীকাল দু’দিনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান-পূজা-পার্বণ, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রথম দিনে আজ সোমবার সকাল ৮টায় সংগীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
এ ছাড়া বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ (ডিআরইউ) বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বর্ণিল আয়োজনে বাংলা নববর্ষকে বরণ করবে।