বীমা শুধু নিজের নয়, পুরো পরিবারের জন্য সুরক্ষা
Published: 12th, February 2025 GMT
মেটলাইফ বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আলা আহমদ বীমা খাতে দেশে ও বিদেশে ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন। বাংলাদেশের বীমা খাতের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকির হোসেন
সমকাল : ২০২৫ সালে বীমা খাতের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
আলা আহমদ : বীমার প্রসার ও জনপ্রিয়তা একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। দেশের ২৫ শতাংশ তরুণ এবং মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী বীমা সুরক্ষার বাইরে রয়েছে এবং অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে জীবন বীমা, স্বাস্থ্য বীমা এবং পেনশন পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। ২০২৫ সালে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এসব সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে দেশের আরও মানুষ বীমাকে একটি প্রয়োজনীয় আর্থিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করবে; যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সমকাল : বীমার প্রতি মানুষের আগ্রহ কম কেন? এ অবস্থার উন্নতি কীভাবে সম্ভব?
আলা আহমদ: আমাদের এক গবেষণায় দেখা গেছে বীমার প্রতি মানুষের আগ্রহ কম থাকার প্রধান কারণ চারপাশের নেতিবাচক মন্তব্য। অনেকেই মনে করেন, বীমার টাকা শুধু মৃত্যুর পর পাওয়া যায় বা অনেকে বিশ্বাস করেন বীমার টাকা ঠিকমতো পাওয়া যায় না কিংবা বীমার দরকারই নেই। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, যারা এই নেতিবাচক ধারণা প্রচার করেন, অনেকেরই হয়তো ব্যক্তিগতভাবে বীমার সঙ্গে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
পরিস্থিতির উন্নতির জন্য তিনটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, বীমা সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, বীমা কর্মী বা এজেন্টদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বীমা দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে দ্রুততা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
সমকাল : বীমা দাবি পরিশোধে মেটলাইফের ট্র্যাক রেকর্ড কেমন?
আলা আহমদ : আমাদের বীমা দাবি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক, যেখানে গ্রাহক ঘরে বসেই দাবি করতে পারেন এবং তাঁর টাকা তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যায়। ২০২৪ সালে আমরা ২ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বীমা দাবি পরিশোধ করেছি। গত পাঁচ বছরে আমরা ১১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি বীমা দাবি পরিশোধ করেছি। এটি গ্রাহকদের মধ্যে বীমার প্রতি আস্থা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সমকাল : জীবন বীমা বেশি পরিচিত হলেও স্বাস্থ্য বীমার প্রয়োজন কতটুকু? বীমা করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় কোনটি?
আলা আহমদ : দেশের মানুষের গড় আয়ু যত বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই জীবনযাত্রার মান রক্ষা এবং সুস্থ থাকার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এ কারণেই স্বাস্থ্য বীমার গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রচলিত জীবন বীমায় বীমার টাকা নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বা গ্রাহকের মৃত্যুর পর পাওয়া গেলেও স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে হাসপাতালের খরচ, বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা, এমনকি পঙ্গুত্ব বা ডিজঅ্যাবিলিটির ক্ষেত্রেও আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নিজের ও পরিবারের জন্য যে কোনো সময় বীমা করতে পারেন। তবে অপেক্ষাকৃত ভালো সময় হলো তরুণ বয়সে বীমা করা। এ সময়ে একজন ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন ঝুঁকি কম থাকে। এতে বীমার প্রিমিয়াম কম হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়।
সমকাল : বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে বীমা কতটা উপযোগী?
আলা আহমদ : বীমা সম্পর্কে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এটিই একমাত্র বিনিয়োগ মাধ্যম, যেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত যে কোনো দুর্ঘটনার জন্য একটি সেফটি নেট তৈরি থাকে। একই সঙ্গে প্রদত্ত প্রিমিয়ামের ওপর প্রতিবছরই কর রেয়াত ও নির্দিষ্ট বিনিয়োগমূলক সুবিধা বা রিটার্ন পাওয়া যায়। সর্বোপরি বীমা শুধু নিজের নয়; বরং পুরো পরিবারের জন্য আর্থিক সুরক্ষা ও বিনিয়োগের সুবিধা নিয়ে আসে। এসব সুবিধা বিবেচনা করে আমরা চাই গ্রাহক তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী ঠিক করবেন কোথায় তিনি বিনিয়োগ করবেন। যেহেতু বীমা একটি ভিন্ন ধরনের আর্থিক পণ্য, এ জন্য বীমার রিটার্ন ব্যাংক বা শেয়ারবাজারের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না।
সমকাল : ২০২৪ সালে মেটলাইফের বাংলাদেশে ব্যবসা কেমন ছিল? ২০২৫ সালে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
আলা আহমদ : ২০২৪ সালকে আমরা ইয়ার অব রেজিলিয়েন্স বলব, যেখানে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো আমাদেরও বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকাসুরেন্সের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক অ্যাপ ‘ওয়ান বাই মেটলাইফ’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বীমা এজেন্টদের জন্য ‘মাইলাইফ’ নামে একটি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে গ্রাহকরা সহজেই তাদের এজেন্টের কাছ থেকে বীমা সম্পর্কে জানতে ও কিনতে পারছেন। ২০২৫ সালে আমাদের মূল লক্ষ্য বীমার সুরক্ষা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
সমকাল : নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর কাছ থেকে কোন ধরনের সংস্কার বা উদ্যোগ আশা করেন বীমার প্রসারের জন্য?
আলা আহমদ : জনগণের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে এনে বীমাকে একটি সম্ভাবনাময় ও শক্তিশালী খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা আন্তরিকভাবে কাজ করছে। দেশের সব নাগরিক এবং সম্পদকে বীমার আওতায় আনতে আইডিআরএর নেওয়া উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এসব উদ্যোগ ত্বরান্বিত করতে বীমা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা ও জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দিকনির্দেশনা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক দিক তুলে ধরে সচেতনতা তৈরি এবং যে জনগোষ্ঠী এখনও বীমার আওতায় আসেনি তাদের কীভাবে বীমা সুরক্ষা দেওয়া যায়, তা নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম দরকার।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ২০২৫ স ল র র জন য পর শ ধ আম দ র আর থ ক ব যবস সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও দুই ডিএমডিসহ চার কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক ছুটিতে
ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের অর্থ তছরুপ করার অভিযোগে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরমান আর চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) মোহাম্মদ নাদিমসহ চার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। অপর দুই কর্মকর্তা হলেন ব্যাংকটির ডিএমডি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া ও ট্রেজারি বিভাগের প্রধান মো. আব্দুল মবিন। আজ রোববার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে। সিদ্ধান্তটি আজ থেকেই কার্যকর করা হয়েছে।
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান খাজা শাহরিয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় উপস্থিত ছিলেন পরিচালক মো. শাহীন উল ইসলাম, মো. আব্দুল ওয়াদুদ, এম আবু ইউসুফ ও মোহাম্মদ আশরাফুল হাসান।
পর্ষদ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ব্যাংকটির এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের অর্থ তছরুপ করার ঘটনা ধরা পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জড়িত ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি আরও অধিকতর তদন্তের জন্য জড়িত কর্মকর্তাদের ছুটিতে পাঠানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী পর্ষদ সভায় এমডিসহ দুই ডিএমডি ও ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।
এ নিয়ে জানতে ব্যাংকটির এমডিসহ অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের ফোন করা হলেও তাঁরা কেউ সাড়া দেননি।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে ব্যাংক থেকে প্রণোদনা বোনাসের নামে অতিরিক্ত টাকা নেন এমডি ফরমান আর চৌধুরী ও ডিএমডি মোহাম্মদ নাদিম। এরপর তাঁরা দুজন মিলে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা অবশ্য ব্যাংককে ফেরত দেন।
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ব্যাংকটি বিতর্কিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলমের (এস আলম) নিয়ন্ত্রণে ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর তাঁদের ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ব্যাংকটিতে নিরীক্ষা শুরু হয়। এরই মধ্যে ব্যাংকটির শীর্ষ দুই কর্মকর্তা টাকা ফেরত দেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ব্যাংকটির নানা অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও এস আলমের ভাই আবদুস সামাদ লাবুর ব্যক্তিগত সচিব মোহাম্মদ পিয়ারুর হিসাবে দেড় কোটি টাকা পাওয়া গেছে। তাঁকে প্রতিবছর পদোন্নতি দেওয়ার পাশাপাশি এক বছরে ৯ বার বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁকে বরখাস্ত করেছে ব্যাংকটি।
এ ছাড়া ব্যাংকটির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের (সিএসআর) প্রায় ১০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবু। গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে এই অর্থ তুলে নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে, ব্যাংকটির গুলশান শাখায় আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের নামে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। ২০২৪ সালের ১৮ জানুয়ারি ১০ কোটি টাকা লেনদেন শেষে হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফাউন্ডেশনের নামে হিসাব খোলার ক্ষেত্রে পর্ষদের কোনো ধরনের কোনো অনুমতি ছিল না।
পরিদর্শনে এসেছে, এই হিসাবে ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৫ কোটি টাকা ও ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ৫ কোটি টাকা জমা করা হয়। এরপর ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবুর গাড়িচালক মো. রিপন ৩টি চেকের মাধ্যমে ২ কোটি টাকা তুলে দেন। ২৭ ডিসেম্বর এক কোটি টাকা উত্তোলন করেন আবদুস সামাদ লাবুর ব্যক্তিগত সচিব মোহাম্মদ পিয়ারু। ২ কোটি টাকা খাতুনগঞ্জ শাখার কর্মকর্তারা তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ লাবুর অফিসে গিয়ে দিয়ে আসেন। বাকি টাকা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে উত্তোলন করেন চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ও পিএস।
এ নিয়ে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান খাজা শাহরিয়ারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্যাংকটির পরিচালক এম আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়েছে। অধিকতর তদন্তের স্বার্থে এমডিসহ চার কর্মকর্তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।