সিএমপির সাবেক কমিশনারসহ গ্রেপ্তার ৩ পুলিশ কর্মকর্তা
Published: 12th, February 2025 GMT
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তার তিন পুলিশ কর্মকর্তা হলেন– সিএমপির সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, সারদা পুলিশ একাডেমির এসপি তানভীর সালেহীন ইমন এবং ডিএমপির বাড্ডা জোনের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার রাজন কুমার সাহা।
সিএমপির সাবেক কমিশনার সাইফুলকে মঙ্গলবার রাতে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল সকালে সিএমপির একটি দল তাঁকে চট্টগ্রাম নিয়ে যায়। ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া নিহতের মামলায় সাইফুল ইসলামের রিমান্ড নামঞ্জুর করেছেন আদালত। তাঁকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো.
মঙ্গলবার রাতে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি থেকে এসপি তানভীর সালেহীন ইমনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার একটি দল। রামপুরায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে বাড্ডা জোনের তৎকালীন সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ‘পরবর্তী আইনি কার্যক্রমের জন্য শিগগির তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হবে।’ তবে কোথা থেকে এবং কখন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মফিজুল হক ভূঁইয়া বলেন, সিএমপির সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন আদালত।
এদিকে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) সারোয়ার জাহান বলেন, মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে ডিবির টিম এসে এসপি তানভীরকে নিয়ে গেছে। কী অভিযোগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা ডিবি বলতে পারবে।
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা করে আরও ৫৯১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া অন্যান্য মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় ধরা হয়েছে ১০৯৫ জনকে। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময়ে একটি বিদেশি পিস্তল, পুলিশের লুট হওয়া চায়না রাইফেল একটি, এলজি দুটি, ওয়ান শুটারগান চারটি ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
গাজীপুরে আরও ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম চৌধুরী ইউনুসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি উপজেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি। নোয়াখালীতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাসহ ১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত সুবর্ণচরের শীর্ষ সন্ত্রাসী বনদস্যু আবুল কালাম ওরফে সফি বাতাইন্না।
মঙ্গলবার রাতে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মাসুদ রানা সবুজকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ফরিদপুরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আরও সাতজন গ্রেপ্তার হয়েছে। এ ছাড়া মঙ্গলবার রাতে ফরিদপুর শহরের লক্ষ্মীপুর চুনাঘাটা এলাকা থেকে মেহেদী হাসান দিদার নামে এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগ কর্মী সন্দেহে আটক ব্যক্তিকে ছিনিয়ে নিতে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় বিজয় বাড়ৈ নামে এক ইউপি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সদর উপজেলায় এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নাটোরের গুরুদাসপুরে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী। সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রাব্বানী রনিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এক আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছে। মানিকগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নেত্রকোনার পূর্বধলায় গ্রেপ্তার হয়েছে এক আওয়ামী লীগ নেতা। বরগুনার বেতাগীতে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কুমিল্লায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাতক্ষীরায় হত্যা মামলায় আজমল উদ্দীন নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে বুধবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যুরো, অফিস ও প্রতিনিধি)
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স এমপ গ র প ত র কর ছ গ র প ত র হয় ছ উপজ ল আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
জাতিসংঘ প্রতিবেদন আমলে লউন
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমাইতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেইভাবে সরাসরি বল প্রয়োগের নির্দেশ দিয়াছিলেন, উহা ছিল নজিরবিহীন। তাঁহার ক্ষমতা টিকাইবার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই নির্দেশ প্রতিপালনের পরিণতিতেই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনা ঘটে; যেইগুলি ইতোমধ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশিত।
মঙ্গলবার প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও উহার স্বীকৃতি মিলিবার বিষয়টি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া আমরা মনে করি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে স্পষ্ট– বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে মারণাস্ত্র দিয়া গুলি চালানো, গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন, চিকিৎসাপ্রাপ্তির অধিকার কাড়িয়া লইবার ন্যায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করিয়াছে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জাতিসংঘ সংগত কারণেই ইহাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলিয়াছে।
বস্তুত গত বৎসরের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার শুরু হইতেই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অনুসন্ধানের দাবি উঠিয়াছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল আসিয়া তদনুযায়ী অনুসন্ধান করে এবং ছয় মাস পর হইলেও সংস্থাটি যেই প্রতিবেদন প্রকাশ করিয়াছে, উহাকে আমরা স্বাগত জানাই।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা, তৎসহিত তাঁহার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে আসাদুজ্জামান খান কামালকেও দায়ী করা হইয়াছে। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী লইয়া জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্মরণে রহিয়াছে, আওয়ামী লীগের সময়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিল যুক্তরাষ্ট্র। এতদ্ব্যতীত পুলিশ যেইভাবে বিগত সরকারের ‘দলীয়’ বাহিনীর ন্যায় বিরোধীদের দমন এবং জুলাই-আগস্টে যেইরূপে বল প্রয়োগ করিয়াছিল, তাহার পরিণতিতেই সংস্থাটির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেককে গা-ঢাকা দিতে হইয়াছে। র্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর আচরণের কতটা পরিবর্তন হইয়াছে, উহাও প্রশ্নসাপেক্ষ। যদিও সরকার তাহাদের সংস্কারে কমিশন গঠন করিয়াছে এবং ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও প্রকাশ পাইয়াছে। কিন্তু জাতিসংঘ ইহাও উল্লেখ করিয়াছে, পুলিশসহ অন্যান্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হইলেও কেবল পুলিশের ব্যাপারেই অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা লইয়াছে।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জাতিসংঘের প্রতিবেদনেই চৌদ্দশত মানুষ নিহত হইবার বিষয়টি আসিয়াছে; যথায় তাহারা উল্লেখ করিয়াছে, অধিকাংশই বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাইয়াছে। এমনকি শিশুরাও তাহাদের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পায় নাই; আন্দোলনের প্রারম্ভে নারীরা আক্রান্ত হইবার বিষয়েও জাতিসংঘের প্রতিবেদন তাৎপর্যপূর্ণ। জাতিসংঘ ও বিশ্বের অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ আমলে লইয়া মানবতাবিরোধী এই সকল অপরাধের বিচার জরুরি হইলেও সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নহে বলিয়াই প্রতীয়মান। বিশেষত তাহাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর যেইভাবে গড়পড়তা মামলা হইয়াছিল, উহাতে যদ্রূপ নিরপরাধ মানুষের হয়রানির উপলক্ষ রহিয়াছে, তদ্রূপ অপরাধীর পার পাইবার শঙ্কাও তৈয়ার হইয়াছে। বিশেষ করিয়া জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যাহারা শহীদ এবং আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন, তাহাদের ন্যায়বিচারের স্বার্থেই অপরাধীদের বিচার করিতে হইবে।
অধিকতর উদ্বেগের বিষয়, জাতিসংঘ প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, সরকারের পরিবর্তন হইলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তৎসহিত নিয়মিত আদালতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহিত জড়িত বিগত সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করিবার উদ্যোগ প্রশংসনীয় হইলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগের বিদ্যমান কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকারের এই সকল প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হইবার যেই আশঙ্কা জাতিসংঘ করিয়াছে, উহা অমূলক নহে।
আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি যদ্রূপ বিচারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য পথপ্রদর্শক হইবে, তদ্রূপ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও শিক্ষা গ্রহণ করিবে।