ঋণগ্রস্ত হয়ে কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন, পাশে দাঁড়ালেন জেলা প্রশাসক
Published: 12th, February 2025 GMT
সন্তানদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাত কাজল দিঘী ইউনিয়নের নবীউল্লাহ-জাহানারা দম্পতি। দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকায় ঋণের টাকা পরিশোধে নিজেদের কিডনি বিক্রির পোস্টার দেয়ালে সাঁটান।
স্থানীয়রা সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে বিষয়টি নজরে আসে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক সাবেত আলীর। তিনি আশ্বাস দেন, অসহায় এই পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর। তারই ধারাবাহিকতায় নবীউল্লাহ-জাহানারা দম্পতিকে উপার্জনের জন্য একটি অটোরিকশা কিনে দিয়েছেন।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে নবীউল্লাহর হাতে অটোরিকশার চাবি তুলে দেন জেলা প্রশাসক সাবেত আলী। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল কাদের, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসেন ও কামাত কাজল দিঘী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফায়েল প্রধান উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, নবীউল্লাহ-জাহানারা দম্পতির দুই সন্তান। এর মধ্যে, মেয়ে নিতু থ্যালাসেমিয়া এবং ছেলে জিহাদ অ্যাজমায় আক্রান্ত। দুই ছেলে-মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন তারা। কিন্তু, কর্মহীন থাকায় ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলেন না। পরে নিজেদের কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। সেই মোতাবেক বিভিন্ন দেয়ালে কিডনি বিক্রির পোস্টার সাঁটান। স্থানীয়রা সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করলে বিষয়টি নজরে আসে জেলা প্রশাসকের।
এদিকে, অটোরিকশা পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন নবীউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘‘রিকশা চালিয়ে অন্তত দুবেলা খাবার জোগানো যাবে। জেলা প্রশাসকসহ যারা সহযোগিতা করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ।’’
কামাত কাজল দিঘী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল প্রধান বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন ছিলেন নবীউল্লাহ। তার ওপর সন্তানদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঋণের টাকা পরিশোধে কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন দিলে বিষয়টি নজরে আসে। তাকে জেলা প্রশাসক একটি অটোরিকশা কিনে দিয়েছেন। আশা করি, এটি তার পরিবারের উপকারে আসবে।’’
জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বলেন, ‘‘আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন জানতে পারি, এই অসহায় দম্পতি ঋণের টাকা পরিশোধে তাদের কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছেন; তখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে একটি নতুন অটোরিকশা কিনে দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাবেন, আর ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন।’’
ঢাকা/নাঈম/রাজীব
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
শখের ছাগলে স্বাবলম্বী মোকলেছার, কিনছেন গাভি ও জমি
ছোটবেলা থেকেই ছাগলের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা মোকলেছার রহমানের। সেই ভালোবাসা থেকেই শখ করে একটি ছাগল কিনে পালন শুরু করেন। একটি, দুটি করে এখন তাঁর খামারে ৫০টি ছাগল। শৈশবের শখ বর্তমানে পরিণত হয়েছে পেশায়। বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ছাগলের খামার। ছাগল বিক্রি করে তাঁর মাসে আয় হচ্ছে গড়ে ২৫ হাজার টাকা।
মোকলেছার রহমানের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের ডারারপাড় গ্রামে। কাঁচা–পাকা সড়ক ধরে মোকলেছারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তানের মতো ছাগল পরিচর্যায় ব্যস্ত তিনি। উঠানে কাঁঠালপাতা, খড় ও ভুসি খাওয়াচ্ছিলেন। এই প্রতিবেদককে দেখে উঠে এসে বসতে দিয়ে শোনান ছাগল পালনে সফলতার গল্প।
মোকলেছার রহমান জানান, দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। ছোট ভাই বাবু মিয়া লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করেন। বাবা রফিকুল ইসলামও তারাগঞ্জ ও/এ দাখিল মাদ্রাসায় চাকরি করেন। ২০০৬ সালে মোকলেছার দাখিল পাস করেন। ২০১৪ সালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের বড়ভিটা গ্রামের মোকছেদুল ইসলামের মেয়ে মোতাহারা আক্তারকে বিয়ে করেন। এরপর চাকরির পেছনে ছোটেন। চাকরি না পেয়ে হতাশ হন।
মোকলেছার জানান, হতাশার মধে৵ তাঁকে ভরসা এনে দেয় লেখাপড়ার সময়ে সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে কেনা শখের ব্ল্যাকবেঙ্গল জাতের ছাগল। ২০১৬ সালে স্ত্রী মোতাহারার পরামর্শে ছাগল পালন শুরু করেন। এক বছরে ছয়টি ছাগল ২৪টি বাচ্চা দেয়। ১২টি বিক্রি করে ৬০ টাকা আয় আসে। এই আয় মোকলেছারের চোখ খুলে দেয়। এরপর পুরোদমে ছাগল পালনে নেমে পড়েন। এখন তাঁর খামারে ৫০টি ছাগল। বর্গা দেওয়া আছে আরও ২০টি ছাগল। ছাগল পালনের টাকায় গাভি ও জমি কিনেছেন। তাঁকে দেখে গ্রামের অনেকে এখন ছাগল পালন করে বাড়তি আয় করছেন। মোকলেছারের স্বপ্ন—গ্রামের প্রতিটি উঠানে ছাগল পালন করা হবে। সচ্ছলতার হাসি থাকবে প্রতে৵ক মানুষের মুখে।
মোলেছার জানান, দেশি জাতের ছাগল বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। একটি ছাগল সর্বোচ্চ চারটি বাচ্চা দেয়। ছয় মাস বয়সী একটি ছাগল বিক্রি হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকায়। একটি ছাগল ছয় মাসে খড়, কাঁচা ঘাস ও ভুসি খায় দুই হাজার টাকার।
মোকলেছার রহমান বলেন, ‘বাবা-ভাই দুজন চাকরি করেন। আমিও দাখিল পাসের পর চাকরির জন্য এদিক–সেদিক হন্যে হয়ে ঘুরেছি; কিন্তু চাকরি হয়নি। শখের বসে কেনা ছাগল দিয়ে খামার গড়ার পরিকল্পনা করি। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমার খামারে ৫০টি ছাগল। বর্গা দিয়েছি আরও ২০টি। ছাগল পালন করে মাসে ২৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। চাষাবাদ আর ছাগল পালনের টাকায় সুখে সংসার চলছে। আমার ইচ্ছা ২০০ ছাগলের একটি খামার করার।’
মোকলেছার রহমানের দেখে ওই গ্রামের সাদেক হোসেন ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন। সাদেক বলেন, ‘মোকলেছারের পরামর্শে তাঁর খামার থেকে ছাগল কিনে খামার করেছি। আমার খামারে এখন ২০টি ছাগল আছে। ছাগল পালনে মনে প্রশান্তি আসে। খরচ অনেক কম। ছাগল বিক্রি করে মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।’
শুধু সাদেকই নন; গ্রামের সাইফুল ইসলাম, এনামুল হক, আশরাফুল ইসলাম ছাগলের খামার করে বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন। ছাগল বিক্রির টাকায় কেউ গাভি, আবার কেউ জমি কিনেছেন। ওই গ্রামের গৃহবধূ ময়না খাতুনের ভিটামাটি ছাড়া কিছু ছিল না। এখন টিনের বাড়ি, ৭ শতাংশ নিজের জমি আছে। গাছগাছালিতে ঘেরা বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালন করে মাসে ছয় হাজার টাকা আয় করছেন। ময়না খাতুন বলেন, ‘ভাই মোর স্বামী কিষান খাটে। রান্না, ঘর গোছানোর কাম করি মুই অলস বসি আছনু। মোকলেছার ভাই মোক একটা ছাগল বর্গা দিছে। এ্যালা মোর ৫টা ছাগল। ছাগল পালনের টাকায় সংসার ভালোয় চলোছে।’
অভাবের কারণে সোমেদার ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকত। গালমন্দ ছিল নিত্যদিনের বিষয়; কিন্তু এসব থেকে মুক্তি দিয়েছে ছাগল পালন। সোমেদা বলেন, ‘অল্প জায়গায়, অল্প টাকায় ছাগল পালন করা যায়। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তিন বছর আগে মোকলেছারের কাছে ছাগল কিনে তাঁর পরামর্শে ছাগল পালন শুরু করছি। বিক্রি বাদ দিয়ে এখন তাঁর ছয়টি ছাগল আছে।’
সয়ার ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আল ইবাদত হোসেন পাইলট জানান, মোকলেছার শিক্ষিত বেকার যুবকদের মডেল। তাঁর পথ অনুসরণ করে অনেকেই ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কে এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, মোকলেছার রহমান একজন আদর্শ খামারি। তিনি শুধু নিজেই নন, এলাকার অন্তত ১০টি পরিবারকে নিজের ছাগল বর্গা দিয়ে ছাগল পালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর দেখানো পথে এলাকার অনেকেই হাঁটছেন। তাঁর কর্মকাণ্ড অনুকরণীয়। প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে তাঁকে সব সময় সহযোগিতা করা হচ্ছে।