আসালাঙ্কার সেঞ্চুরির পর তিকশানার ঘূর্ণি, অস্ট্রেলিয়াকে চমকে দিল শ্রীলঙ্কা
Published: 12th, February 2025 GMT
রিভিউ নিয়ে সফল শ্রীলঙ্কা। সিদ্ধান্ত বদলে অস্ট্রেলিয়ার শেষ ব্যাটসম্যান স্পেন্সার জনসনকে আম্পায়ার ক্রিস গ্যাফানি এলবিডব্লিউ দিতেই লঙ্কানদের আনন্দ দেখে কে! ধারাভাষ্যকার রাসেল আরনল্ড বলতে লাগলেন, ‘শ্রীলঙ্কার জন্য এটা স্মরণীয় এক জয় এবং এটা অবশ্যই তারা দীর্ঘ সময় ধরে মনে রাখবে।’
এখনকার দিনে টি-টোয়েন্টিতেই হরহামেশা ২০০-এর বেশি রান ওঠে। শ্রীলঙ্কা সেখানে ৫০ ওভারের ওয়ানডে ম্যাচে করতে পারল ২১৪ রান। এত অল্প সংগ্রহ নিয়েও অস্ট্রেলিয়াকে তারা গুটিয়ে দিল ১৬৫ রানে। কলম্বোয় দুই ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটিতে স্বাগতিকেরা জিতল ৪৯ রানে।
প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের শুকনো-মন্থর পিচে আগে ব্যাটিংয়ে নামা শ্রীলঙ্কা ৫৫ রানে হরিয়ে ফেলেছিল ৫ উইকেটে। অষ্টম উইকেটের পতন হয় ১৩৫ রানে। স্বাগতিকেরা ১৫০ করতে পারবে কি না এ নিয়েই সংশয় ছিল।
কিন্তু চারিত আসালাঙ্কার অধিনায়কোচিত সেঞ্চুরিতে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ২০০-এর গণ্ডি পেরিয়ে যায়। এরপরও লক্ষ্যটা অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের জন্য খুব বড় হওয়ার কথা নয়। তবে মহীশ তিকশানার ‘বিষ মাখানো’ স্পিন তা হতে দেয়নি।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রস্তুতি হিসেবে আয়োজিত এই সিরিজে অস্ট্রেলিয়াই এখন পিছিয়ে। সেটাও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, যারা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি!
ব্যাট হাতে আসালাঙ্কার একার লড়াই কতটা দৃষ্টিনন্দন ছিল, তা বোঝার জন্য লঙ্কানদের ইনিংসে শীর্ষ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের ব্যবধান দেখলেই চলবে। ১৪ চার ও ৫ ছক্কায় আসালাঙ্কা উপহার দিয়েছেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা ১২৭ রানের ইনিংস, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০ রান এসেছে দুনিত ভেল্লালাগের ব্যাট থেকে। মানে, আসালাঙ্কার চেয়ে ৯৭ রান কম!
ষষ্ঠ উইকেটে আসালাঙ্কা-ভেল্লালাগের ৬৭ রানের জুটিতেই দলীয় শতরান পেরোয় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু নবম উইকেটে ঈশান মালিঙ্গার সঙ্গে ৭৯ রানের জুটিকে ‘আসালাঙ্কা স্পেশাল’ বললেও প্রশংসা কম হয়ে যায়। এই জুটির ৭৯ রানের মধ্যে ৭৭-ই যে লঙ্কান অধিনায়কের একার! ঈশানের অবদান ২৬ বলে ১।
রান তাড়া করতে নেমে শ্রীলঙ্কার মতোই শুরুতে বিপর্যয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। সফরকারীরা প্রথম পাওয়ার প্লেতেই হারায় ৪ উইকেট। এর মধ্যে আছেন স্টিভেন স্মিথও, প্যাট কামিন্সের অনুপস্থিতিতে যিনি আজ সকালেই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির অধিনায়ক ঘোষিত হয়েছেন।
পঞ্চম উইকেট জুটিতে ৫২ রান যোগ করে অস্ট্রেলিয়াকে আশা দেখাচ্ছিলেন মারনাস লাবুশেন ও অ্যালেক্স ক্যারি। কিন্তু ১৮তম ওভারে তিকশানা লাবুশেনকে এলবিডব্লিউ করে এই জুটি ভাঙার পরপরই সফরকারীদের জয়ের আশা ফিকে হয়ে যায়। এরপর ক্যারিও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। বল হাতে তুলে নিয়ে ক্যারিকে পাতুম নিশাঙ্কার ক্যাচ বানিয়েছেন আসালাঙ্কা।
লোয়ার মিডল ও লোয়ার অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান অ্যারন হার্ডি, শন অ্যাবট ও অ্যাডাম জাম্পা যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও শুধু হারের ব্যবধানই কমাতে পেরেছেন। ৪০ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা বোলার লঙ্কান স্পিনার থিকশানা। আসিতা ফার্নান্ডো ও ভেল্লালাগে নিয়েছেন দুটি করে উইকেট।
ব্যাট হাতে ১২৭ রান, ‘গোল্ডেন আর্ম’ হয়ে ক্যারির উইকেট, সঙ্গে দক্ষ নেতৃত্ব—অবশ্যম্ভাবীভাবে ম্যাচসেরার পুরস্কারটা চারিত আসালাঙ্কার হাতেই উঠেছে। অস্ট্রেলিয়া দুঃখ করতে পারে এটা ভেবে যে, তাদের কেউই আজ আসালাঙ্কা হয়ে উঠতে পারেননি।
কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামেই সিরিজের শেষ ম্যাচ আগামী শুক্রবার।
সংক্ষিপ্ত স্কোরশ্রীলঙ্কা: ৪৬ ওভারে ২১৪ অলআউট
(আসালঙ্কা ১২৭, ভেল্লালাগে ৩০, কুশল মেন্ডিস ১৯; অ্যাবট ৩/৬১, হার্ডি ২/১৩, এলিস ২/২৩, জনসন ২/৪৪)।
অস্ট্রেলিয়া: ৩৩.
(ক্যারি ৪১, হার্ডি ৩২, জাম্পা ২০*, অ্যাবট ২০; তিকশানা ৪/৪০, আসিতা ২/২৩, ভেল্লালাগে ২/৩৩)।
ফল: শ্রীলঙ্কা ৪৯ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: চারিত আসালাঙ্কা।
সিরিজ: ২ ম্যাচের সিরিজে শ্রীলঙ্কা ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উইক ট
এছাড়াও পড়ুন:
সবাই ভয়ে পালিয়েছে, ভারতের নন্দনগরে এক মুসলিম পরিবারের টিকে থাকার লড়াই
নন্দাকিনী নদীর তীরে রোজ সকাল আটটায় নিজের ড্রাই ক্লিনিংয়ের দোকানের বাদামি শাটার খুলে কাজ শুরু করেন আহমেদ হাসান। উত্তর ভারতের হিমালয় অঞ্চলের উত্তরাখন্ড রাজ্যের নন্দনগরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন তিনি।
সকালে দোকান খুলে নিত্যদিনের কাজ শুরু করেন হাসান। শুকনো পদ্ধতিতে পরিষ্কার (ড্রাই ক্লিনড) করা কাপড় নিজের দোকানের গোলাপি দেয়ালের প্লাস্টিক কভারে সুচারুভাবে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি গ্রাহকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক হাসানের কাছে আসতেন। শেরওয়ানি, স্যুট, কোট, প্যান্ট এবং শীতকালীন পোশাক তাঁর কাছে পরিষ্কার করতে দিতেন। কোনো কোনো গ্রাহক তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। চা খেতে খেতে রাজনীতি নিয়ে আলাপ ও মজা করতেন, হাসি–আনন্দ ও সুখ-দুঃখ বিনিময় করতেন। গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু, অল্প কিছু ছিলেন মুসলিম।
কিন্তু ১২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত পাঁচজনেরও কম হিন্দু গ্রাহক হাসানের দোকানে এসেছেন। তিনি জানান, কোনো মুসলিম গ্রাহকের আশায় থাকা বৃথা। এ সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।
নন্দনগরে এখন হাসানই একমাত্র মুসলিম পুরুষ। অথচ এই শহরে কয়েক মাস আগেও ১৫টি মুসলিম পরিবার ছিল, যারা বংশপরম্পরায় এখানে বসবাস করে আসছিল। হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। পূজা-পার্বণে হিন্দুরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করতেন। আর ঈদের সময় হিন্দু প্রতিবেশীদের তাঁরা দাওয়াত দিতেন। প্রতিবেশী হিন্দু মারা গেলে শবদাহের জন্য তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন, হিন্দু বন্ধুদের মরদেহ কাঁধে বহন করে শ্মশানে নিয়ে গেছেন।
কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে এই এলাকায় মুসলিমবিরোধী সহিংসতা শুরুর পর এ সবকিছু রাতারাতি বদলে গেছে। এক হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এ সহিংসতা শুরু হয়েছিল। তবে নন্দনগরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে মন–মানসিকতায় আরও আগে থেকেই বড় পরিবর্তন সূচনা হয়েছিল, যা করোনাকাল থেকে খেয়াল করে আসছিলেন হাসান।
গত সেপ্টেম্বরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে শারীরিক হামলার আগে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ঘৃণামূলক স্লোগান দেওয়া হতো। মুসলিমবিরোধী কিছু বিক্ষোভও হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাণভয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা রাতের আঁধারে নন্দনগর ছেড়ে পালিয়ে যান।
হাসানও পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ছোট্ট শহর আবার মুসলিমদের বসবাসের উপযোগী করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, এটাই তাঁদের জন্মভূমি। কিন্তু হাসানের পরিবারকে সেখানে এখনো ভয়ে ভয়েই থাকতে হচ্ছে।
হিন্দু প্রতিবেশীরা এখন হাসানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন না। আগে তিনি সন্ধ্যায় নিয়মিত নন্দাকিনী নদীর তীরে হাঁটতে গেলেও এখন যান না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেন না। তাঁর আশঙ্কা, আবারও সহিংসতা দেখা দিতে পারে।
হাসান বলেন, ‘আমি সোজা দোকানে যাই, দোকান থেকে বাসায় আসি। সারাটি জীবন এই শহরে কাটালেও নিজেকে আমার এখন ভূত বলে মনে হয়। আমি যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এমনকি কেউ আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছেন না।’
‘মুসলিমদের জুতা দিয়ে পেটাও’
রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে গাড়িতে করে নন্দনগর যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। ভারত-চীন সীমান্তের কাছাকাছি স্থানের এই শহরটি নন্দাকিনীর কয়েকটি উপনদীর সংগমস্থলে অবস্থিত। গঙ্গার ছয়টি উপনদীর একটি হলো নন্দাকিনী, যাকে হিন্দুরা পবিত্র বলে বিশ্বাস করেন। শহরটি জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
হাসানের দাদা পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিজনৌর জেলার নাজিবাবাদ শহর থেকে ১৯৭৫ সালে নন্দনগরে এসেছিলেন। তাঁদের পরিবার সেখানেই বসতি গড়ে। পরের বছর হাসানের জন্ম হয়।
এক মুসলমান নরসুন্দরের যৌন হয়রানির অভিযোগের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ মিছিলে হাসান ও নন্দনগরের অন্য মুসলমানরাও অংশ নিয়েছিলেন