আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে। সেই ধারায় কয়েকটি বড় শক্তির বদলে আরও বেশ কিছু দেশ বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। একে বলা হচ্ছে ‘বহু মেরুকরণ’। এর অর্থ হচ্ছে, বিশ্ব এখন একক বা গুটিকয় পরাশক্তির নিয়ন্ত্রণে নেই; বরং অনেক দেশ মিলে বৈশ্বিক বিষয়ে প্রভাব ফেলছে। এই পরিবর্তনের উদ্বেগজনক দিক হলো বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং দেশগুলোর ভেতরেও বিভাজন বা মতপার্থক্য বাড়ছে। প্রতিটি দেশ ভবিষ্যতের বিশ্বব্যবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে। এটি পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধান কঠিন করে তুলছে।

আসলে বিশ্বরাজনীতিতে এখন দুটি শিবির স্পষ্টভাবে গড়ে উঠছে। একদিকে রয়েছে গণতান্ত্রিক দেশগুলো, অন্যদিকে স্বৈরশাসিত দেশগুলো। বিশেষ করে, মানবাধিকার, বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই বিভাজন আরও গভীর হচ্ছে।

বিশ্ব এখন বহু মেরুকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আর এর সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভাজনও গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। বিভিন্ন শক্তির মধ্যে বিভাজন কমিয়ে কীভাবে স্থিতিশীলতা আনা যায়—এই প্রশ্নের জবাবের ওপর ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ভর করছে

এ ছাড়া কিছু নতুন শক্তিশালী দেশও নিজেদের মতো করে অঞ্চলভিত্তিক প্রভাব বিস্তার করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া ইউরেশিয়ায় (ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগ অঞ্চল) নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মাধ্যমে পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। ফলে বিশ্বব্যবস্থার একক নিয়মকানুন ও সহযোগিতার কাঠামো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। তার পরিবর্তে একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছে।

শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতি নয়, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরেও বিভাজন বা বিভক্তি বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার ক্ষমতায় আসা বিভাজনমূলক রাজনীতির নতুন শক্তিকে প্রকাশ করছে। এটি ইউরোপসহ অন্য সেসব দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে আরও উজ্জীবিত করবে, যেখানে ‘আমরা বনাম ওরা’ মানসিকতা গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে। অনেকের ধারণা, উদারনৈতিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা শুধু নিজ দেশের অভিজাত শ্রেণিকেই নয়, বরং বিদেশের নতুন শক্তিগুলোকেও (বিশেষ করে চীনকে) অন্যায্য সুবিধা দিয়েছে। এতে পশ্চিমা দেশগুলোর দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা আরও বাড়ছে।

একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বিভাজন সরকারগুলোর কার্যক্ষমতা ব্যাহত করছে এবং তাদের নীতি গ্রহণের সুযোগ সীমিত করে ফেলছে। ফলে গণতান্ত্রিক নেতারা বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও বৈশ্বিক সহযোগিতা জোরদার করতে পারছেন না। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী জনতুষ্টিবাদী নেতাদের জন্য বিভক্ত আন্তর্জাতিক পরিবেশ তাঁদের ‘সবার বিরুদ্ধে সবাই’ ভাষ্যকে আরও জোরদার করছে। এটি তঁাদের পক্ষে যাচ্ছে। তাই তাঁরা দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য গঠনে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাড়তে থাকা রাজনৈতিক বিভাজনের এই প্রেক্ষাপটে অনেক দেশের (বিশেষ করে বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর) বহু মেরুর বিশ্বের প্রতি যে আশা ও প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ না–ও হতে পারে। যে বহু মেরুর বিশ্ব গড়ে উঠছে, তা যদি অভিন্ন নিয়ম ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া পরিচালিত হয়, তাহলে এটি দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত হয়ে উঠতে পারে।

শক্তিশালী দেশগুলোর পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং তুলনামূলক শান্তি ও স্থিতিশীলতার নতুন যুগ শুরু করার কথা ছিল। তার বদলে তারা বহু মেরুত্ব (মাল্টিপোলারিটি) বরং অস্থিতিশীলতা বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করছে। এটি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্যযুদ্ধ উসকে দিতে পারে, চলমান গৃহযুদ্ধগুলো দীর্ঘায়িত করতে পারে, এমনকি এটি বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধের বীজও বপন করতে পারে।

এ অবস্থায় বিশ্বের জন্য সবচেয়ে দরকার হলো রাজনীতিকে ‘পোলারাইজ’ (বিভক্ত) না করা। তবে এটি কীভাবে অর্জিত হবে বা কে এ প্রচেষ্টার জন্য প্রস্তুত হবে, তা স্পষ্ট নয়। কিছু লোক বিশ্বাস করেন, যদি বৈশ্বিক শাসনকাঠামো নতুন শক্তির কেন্দ্রগুলোকে গ্রহণ করে, তাহলেই বহু মেরুত্বজনিত বিভক্তিগুলো দূর করা সম্ভব হবে। বিশ্বের কিছু শক্তিশালী দেশ এমন একটি বড় ধরনের চুক্তি করতে আগ্রহী হয়নি, যা সবার জন্য উপকারী হবে। বরং তারা বিশ্বরাজনীতির বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে।

বিশ্ব এখন বহু মেরুকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আর এর সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভাজনও গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। বিভিন্ন শক্তির মধ্যে বিভাজন কমিয়ে কীভাবে স্থিতিশীলতা আনা যায়—এই প্রশ্নের জবাবের ওপর ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ভর করছে। এই পরিবর্তন অবশ্যই নিজ নিজ দেশের ভেতর থেকেই শুরু করতে হবে।

টোবিয়াস বুন্ডে বার্লিনের হার্টি স্কুলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার অধ্যাপক এবং

সোফি আইজেনট্রাউট মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের গবেষণা ও প্রকাশনার প্রধান

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য ব ভ জন র জন ত র করছ

এছাড়াও পড়ুন:

ঘরে ফিরে ঘরের তালাশ

ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ির বার-মহলে এসে দাঁড়ান রাব্বি সাহেব। চুন–সুরকির পলেস্তারা খসে পড়ে ইট বের হয়ে যাওয়া নয়-চালি ঘরটির দিকে তিনি দিশা ধরে খানিক তাকিয়ে থাকেন। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে তাঁর মুখের মাংসপেশি সামান্য কাঁপে। ধূসর দাড়ি–গোঁফে নাশতার ছিটেফোঁটা লেগে আছে। কাঁপুনি ব্যাপকভাবে বাড়তেই, তা থেকে ঝরে পড়ে একদানা চিনি-ছিটানো খই। ঘাসের গোড়ায় কিছু খুঁটতে থাকা একটি শালিক তা খুট করে তুলে নেয় মুখে।

কাঁপুনি একটু থামতেই তিনি চলে আসেন সিঁড়িতে। খুব সাবধানে এক পা দু–পা করে ঈষৎ লাফিয়ে উঠে পড়েন চতুর্থ ধাপে। ফুলের সুবাস পেতেই থমকে দাঁড়ান। সিঁড়িটির বাঁ পাশে তাঁর কিশোর বয়সের কামিনীগাছটি বয়োবৃদ্ধ হালতে এখনো পত্রপুষ্পে ছড়িয়ে আছে আগের মতো। পুরোনো দিনের চেনা কোনো স্বজনের সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো তাঁর ইচ্ছা হয় ভোরবিহানে শ্বেতশুভ্র পুষ্পের জাদু ছড়ানো তরুবরটিকে হাত বাড়িয়ে একটু স্পর্শ করার। কিন্তু সাহস পান না।

বিলাত থেকে সপ্তাহখানেক আগে স্বদেশে ফেরার ঠিক সাত মাস তেরো দিন আগে রাব্বি সাহেবের স্ট্রোক হয়, তবে সেরে ওঠেন, কিন্তু ডান পা, যা বছর চারেক আগে থেকেই কার অ্যাকসিডেন্টে বিক্ষত ছিল, তা স্ট্রোকের ধকলে পুরোপুরি অবশ হয়ে যায়। পায়ে হালফিল খানিকটা সংবিৎ ফিরে পেয়েছেন বটে কিন্তু সে থেকে শরীর-গতরের ডান দিকটাও বেজায় কমজোর হয়ে আছে। কামিনীর কুন্দকুসুম কিংবা পত্রালি স্পর্শ করতে গিয়ে তিনি ভারসাম্য হারানোর ঝুঁকি নিতে চান না। ক্রাচ ঠুকে ঠুকে আরও তিনটি ধাপ ভেঙে তিনি উঠে আসেন খোলামেলা বারান্দায়।

তখনই খেয়াল হয়, সিঁড়ির ডান দিকে তো একই ক্বদের আরেকটি কামিনীগাছ থাকার কথা। ঘাড় ফিরিয়ে, এক পা সামনে বেড়ে, রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকান। যমজ তরুবরের সহোদরাটি গায়েব হয়েছে পুরোপুরি। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মা ছাগল। তার বাঁট থেকে দুধ চুষছে তিনটি ছানা।

রেলিং ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান রাব্বি। সুরুজের তেজে চোখের সামনে ঝলমলিয়ে ওঠে কাঞ্চা সবুজে লেগে থাকা শিশিরবিন্দু। ভারি তাজ্জব হন! পারিবারিক বনেদি কেতার এ এজমালি বাংলাঘরটির সামনে ঠিক এই জায়গায়ই না ছিল একটি চৌখুপ্পি বাগিচা? কয়েকটি গোলাপ, গন্ধরাজ, করবী ও পাতাবাহারের ছাঁটা ঝোপগুলোর তো এখানে থাকার কথা!

ভাবেন, বারান্দায় বসবেন, কিন্তু যেখানে ইজিচেয়ার ও কাঠের পিঁড়িগুলো থাকার কথা, ঠিক ওই জায়গায় রাখা হয়েছে একটি ওয়াটার পাম্প। চারদিকে ছড়ানো–ছিটানো নিড়ানি, সারের বস্তা ও কীটনাশকের শিশি-বোতলসহ একটি জারিক্যান। রাব্বি ভাবেন, একটু নাহয় সিঁড়িতে বসবেন, কিন্তু নিচু হয়ে বসলে আবার যদি উঠে দাঁড়াতে মুশকিল হয়?

হঠাৎ তাজ্জব হওয়ার ঘোর তাঁর সহজে কাটে না! আবার তাকান, বাগিচার পরিসরজুড়ে সার-জলের স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়তে থাকা ধানের কচি চারাগুলোর দিকে। কয়েকটি রুপালি বিন্দুতে ঝলসে যায় শিশিরের বর্ণালি। অসামান্য এ দৃশ্যপটের দীপ্তিতেও সন্তুষ্ট হতে পারেন না রাব্বি।

মেহেদিগাছগুলোই–বা গেল কোথায়? বিয়েশাদি কিংবা শবে কদরের রাতে গ্রামের কিশোরীরা দল বেঁধে আসত না মেহেদিপাতা তুলতে? হঠাৎ মনে পড়ে যায় ইলেকশনের কথা। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের জামানায় চালু হয়েছিল, ইউনিয়নভিত্তিক বনিয়াদি গণতন্ত্র বলে একটি প্রথা। তিনি চেয়ারম্যান পদে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হয়েছিলেন, লাঙল মার্কা প্রতীকে বিপুল ভোটে জিতেও ছিলেন।

কত সালের কথা—১৯৬৬ না ৬৭? নির্বাচনের বছর তাঁর লাগানো ডালিয়াগুলো বেজায় দৃষ্টিনন্দন হয়েছিল পুষ্পের বর্ণাঢ্য আভায়। একসঙ্গে ফুটেছিল বত্রিশ কিংবা বিয়াল্লিশটি ডালিয়া। সে আমলে গেরামগঞ্জের বিয়েশাদিতে সেভেন-সিটার বলে একধরনের ভ্যানগাড়ি কিরায়া করার রেওয়াজ ছিল। বিবাহে আরেক ধরনের গাড়ি দামান্দ-কন্যা আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। গাড়িটির কী একটা ইংরেজি নামও ছিল...। ইয়েস, নামটা এবার পরিষ্কার মনে পড়ে—স্টাফকার।

না, এ আতরাফে তো বটে, মুহকমা শহরেও তাজা ফুলের কোনো দোকান ছিল না। তার বন্ধু সুজিত দেবনাথের বিয়েতে, এই বাগিচার ডালিয়া দিয়ে তিনি নিজ হাতে স্টাফকারটি সাজিয়ে দিয়েছিলেন। বাসর রচনার জন্যও চাপলিশে পাঠিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি গোলাপ, বকুল ও গন্ধরাজ।

বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসেন চোখে সুরমা টানা গোলটুপি মাথায় একজন মৌলভি গোছের তরুণ। তিনি কানে তুলা গুঁজতে গুঁজতে রাব্বি সাহেবকে তাজিমের সঙ্গে সালাম দেন। রাব্বি মিনমিনিয়ে আলেক উচ্চারণ করেন, কিন্তু গলায় চেককাটা গিলাফ পরা তরুণের সঙ্গে অধিক বাতচিতের আগ্রহ তাঁর হয় না। পরিসরে আতরের কড়া গন্ধ ছড়িয়ে তরুণটি চাপা স্বরে ‘আল্লাহু করিম’ বলতে বলতে নেমে যান সিঁড়ি ধরে।

রাব্বি অবগত যে অন্য শরিকানদের ছেলেপিলে তথা তাঁর সম্পর্কে ভাতিজা কিংবা তাদের পুত্ররা, মাদ্রাসায় আলিয়া অবধি পড়া এই তরুণটিকে বাড়ি-সংলগ্ন মসজিদের ইমাম নিযুক্ত করেছেন। এ ছাড়া মক্তবের দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে বাংলাঘরের দক্ষিণ দিকের কামরায় ইনি বসবাসও করছেন।

রাব্বি বারান্দা ধরে কদম কয়েক সামনে বাড়েন। অতঃপর দক্ষিণের কামরাটির সামনে এসে দাঁড়ান। জানালা দিয়ে কামরার ভেতর দেখা যাচ্ছে পরিষ্কারভাবে। চুনকাম উঠে বিবর্ণ হওয়া দেয়ালে আসমা উল হুসনা বা আল্লাহ পাকের নিরানব্বইটি সিফতি নামের ক্যালিওগ্রাফ করা একটি পিকচার ফ্রেম ঝুলছে।

খুলনার মাস্টার সাহেবের কথা তাঁর স্মৃতিতে জোরেশোরে ফিরে আসে। মাস্টারের আসল নাম কী ছিল? রাজনৈতিক কারণে কবিরুল হক ছদ্মনামে এই কামরায় হুলিয়া এড়িয়ে বছর দুয়েক আত্মগোপন করেছিলেন। সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসাবে রাব্বি সাহেবের তখন এলাকায় বেশ খানিকটা প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল। স্থানীয় হাইস্কুলে কবিরুল হককে মাস্টারের চাকরি পাইয়ে দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

মাস্টার ইংরেজি ও ইতিহাস পড়াতেন। তাঁর আঁকাজোকার হাত ছিল দুর্দান্ত। দেশে তখনো চলছে আইয়ুব খানি মার্শাল ল’র জবর তমতমি। কমিউনিস্ট ভাবধারার বামপন্থী ক্যাডারদের অনেককেই হুলিয়া মাথায় নিয়ে চলে গেছেন পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে। কবিরুল মাস্টার ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি জলরঙের ডালিয়া ফোটা বাগিচার একটি দৃশ্যপট এঁকে দিয়ে সবাইকে চমৎকৃত করেছিলেন।

বৈঠকখানায় ঢুকে রাব্বি পেইন্টিংটি কোথায় তা নিয়ে একটু ভাবেন, চারদিকে খুঁটিয়ে তাকান। দেয়ালে যেখানে চিত্রটির ঝুলে থাকার কথা, ওখানে সস্তা একটি বিরাট আকারের সচিত্র পোস্টার সাঁটা। রাব্বি রংচঙে পোস্টারটির দিকে কিছুক্ষণ দিশা ধরে তাকান। ঢেউতোলা ছাদের দৃষ্টিনন্দন ইমারতটিকে শনাক্তও করতে পারেন, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারেন না, তাঁর পৈতৃক ভিটেবাড়ির দেয়ালে সিডনি শহরের অপেরা হাউসের ছবি টাঙানোর প্রাসঙ্গিকতা!

দেয়ালঘেঁষা বইয়ের আলমারি তিনটি এখনো আগের জায়গায়ই আছে। তবে কোনো কোনোটির ভাঙা কাচ সরিয়ে পাল্লায় গঁদ দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পলিথিনের স্বচ্ছ আবরণ। রাব্বি ভুরু কুঁচকে ভেতরের থরে-বিথরে সাজানো বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনেকগুলো বইয়ের রচয়িতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী।

এক জামানায় তাঁর সংগৃহীত বইপত্র দিয়ে এ আলমারি তিনটিতে রাব্বি চেনা বন্ধুবান্ধবের জন্য চালু করেছিলেন একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। লেনদেনের সুবিধার জন্য নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন বইগুলোর ক্যাটালগও। দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে তিনি সংগৃহীত পুস্তকগুলোর নাম মনে করার চেষ্টা করেন। যোগাযোগ, চক্রবাক, পদাতিক, সুকান্ত সমগ্র, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা...। না, সিস্টেমেটিক্যালি সব কটির নাম মাথায় আসছে না।

একসময় সমরেশ বসুর উপন্যাসগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। ’৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ওপার বাংলা থেকে বইপত্রের আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন বন্ধু সুজিত দেবনাথ হয়ে ওঠে পশ্চিম বাংলা থেকে বইপত্র আনানোর কান্ডারি। সে মাঝেমধ্যে ওপারে তার আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বেড়াতে যেত। ফিরে আসত কাঁড়ি কাঁড়ি বইপত্তর নিয়ে...।

সুজিতের সক্রিয় উৎসাহে এ বৈঠকখানায় তিনি চালু করেছিলেন স্টাডি সার্কেল। তত দিনে সে বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একটি ফ্যাকশনের পুরোদস্তুর ক্যাডার বনে গেছে। এলাকার প্রগতিমনা ছেলেরা ছিল স্টাডি সার্কেলের সদস্য। একটি সিলেবাসও তৈরি করা হয়েছিল। ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি বই দুটি দিয়ে পাঠচক্রে অধ্যয়নের শুরুয়াত হতো। সিলেবাসে তৃতীয় বইটি ছিল যে গল্পের শেষ নেই।

পাঠ করার পর কমরেড সুজিতের তত্ত্বাবধানে তা নিয়ে আলোচনাও হতো। যারা মাস ছায়েক পাঠচক্রের চর্চায় যুক্ত থাকত, তাদের হাতে অবশেষে ধরিয়ে দেওয়া হতো সাম্যবাদের হাতেখড়ি ও ভলগা থেকে গঙ্গা প্রভৃতি পুস্তক।

স্মৃতির কিসতি চড়ে রাব্বি যেন চলে গিয়েছিলেন পুরোনো দিনের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি যুগে। হঠাৎ মুখের মাংসপেশিতে কম্পনের তোড় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে তিনি চকিতে ফিরে আসেন বর্তমান মুহূর্তে। ভাবেন, একটু বসে জিরিয়ে নেবেন, কিন্তু বেতের সোফাগুলোর যে হালত, যেভাবে কুশন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে তুলা, বসার আগ্রহ তাঁর মিইয়ে আসে। আবার একটু ঝুঁকে পড়ে রাব্বি তাকান, আলমারির নিচের দিকের একটি তাকে।

ওখানে মসলা-মাসায়েলের কয়েকটি পুস্তকের শিরোনামগুলো পড়েন। এগুলোর পাশে রাখা কুয়াশা সিরিজের গোয়েন্দা গল্পের বইগুলো। ঠিক বুঝতে পারেন না, তাঁর সংগ্রহকে গায়েব করে দিয়ে এ বইগুলো জোগাড়ে তরুণ ইমামের কোনো ভূমিকা আছে কি না? না, আপাতদৃষ্টে পরহেজগার মানুষটিকে দোষারোপ করতে মন থেকে তিনি সায় পান না।

তাঁর পৈতৃক বসতবাড়িটি আদিতে ছিল চার শরিকে বিভক্ত। গত চল্লিশ বছরে তাঁর বাবাসহ তিন চাচা পরলোকে গেছেন, মোট সাতজন ভাতিজি বিবাহিত হয়ে স্বামীদের ঘরসংসার করছে। বাদবাকি এগারোজন ভাতিজারও নিজস্ব পরিবার হয়েছে। এদের সন্তানাদি বেশুমার। অনেকগুলোরই নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই, ধানি জমির আয় সম্বল করে এরা গল্পগুজব করে, বিবিসি শোনে, মসজিদে চিল্লা দিয়ে, হরেক কিসিমের পত্রিকা পড়ে দিনাতিপাত করে। এদের কেউ কেউ প্রচণ্ড রকমের ধর্মপ্রবণ, কথাবার্তায় পৃথিবীজুড়ে পূর্বপুরুষদের পবিত্র ধর্মের রাজনৈতিক বিজয়ের প্রত্যাশা রাখে। এদের পুত্রসন্তানেরা প্যান্টের পায়া গুটিয়ে ঘন্টার ওপর তুলে হাঁটাচলা করে। কন্যারা প্রায় সবাই হেজাবে মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত রাখতে পছন্দ করে।

যাদের শরীরে প্রবাহিত শোণিতের সঙ্গে তাঁর জৈবিক যোগসূত্র বংশপরম্পরার, সেই পরবর্তী প্রজন্মের কুটুমখেশের দিনযাপনের বিষয়–আশয় তাঁকে উদ্বিগ্ন করে। হালফিল তাদের বিবর্তিত সংস্কৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাব্বির মাথা ঘুরন্টি দিয়ে ওঠে। কোনো ক্রমে একটি সোফার কিনার ধরে, নিজেকে সামলে বসে পড়েন। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে তিনি যেন চলে যান ভিন্ন এক শতাব্দীর শেষ দিককার অন্য এক দশকে। মনশ্চক্ষে পরিষ্কার দেখতে পান, তামাম পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে চলছে নির্বাচনের তুলতবিল। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে নেমেছেন, সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ। পত্রপত্রিকা তাঁকে অভিহিত করছে ‘মাদারে মিল্লাত’ বিশেষণে।

এই কামরার আসবাব সরিয়ে, মেঝেতে উবু হয়ে বসে মাস্টার সাহেব পোস্টারে বড় করে আঁকছেন বিরোধীদলীয় নির্বাচনী প্রতীক লন্ঠনের ছবি। এরপর ভিন্ন পোস্টারে লিখছেন, ‘বিরোধী দলের প্রার্থীকে আপনার মূল্যবান ভোট দিয়া আইয়ুবশাহিকে গদিছাড়া করুন।’ আবার অন্য পোস্টারে লিখছেন, ‘কৃষকনেতা হাতেম আলী বন্দী কেন? রাজবন্দীদের মুক্তি চাই ।’

কামরার এক কোণে, ডিবানের ওপর বসে, হারমোনিয়ামের রিড টিপে টিপে সুজিত চাপা সুরে গাইছে। কৈশোরে রবীন্দ্রসংগীতের রেওয়াজ করা সুজিতের কণ্ঠস্বরে মূর্ত হয়ে উঠছে শ্রী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসংগীত, ‘কাস্তেটারে দিও শাণ/ কিষান ভাই রে...।’

রাব্বি স্মৃতিচারণাকে একটি দৃশ্যপটে ফোকাস রাখতে পারেন না। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো তা দুলতে দুলতে দূরে দূরে থেকে বহুদূরে সরে গিয়ে ফিরে এসে তৈরি করে খণ্ডবিখণ্ড দৃশ্যপট ও বিগত জনাকয়েক স্বজনের স্মৃতিবিধুর মুখের সমাহারে বিচিত্র একটি কোলাজ। তাঁর বাঁ হাত থেকে খট করে রংচটা মোজাইকের মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে হাইপাওয়ারের চশমাটি। চশমা থেকে ছিটকে খুলে পড়া লেন্স থেকে বিচ্ছুরিত আলোর রেখার দিকে রাব্বি সাহেব তাকিয়ে থাকেন চুপচাপ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ