যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুল ইসলামকে দায়িত্ব পালন করতে না দিতে কার্যালয়ে তালা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। চেয়ারম্যানের পক্ষের লোকজন এই তালা ভাঙতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন।

আজ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনকে কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, আজ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আকরাম হোসেনের নেতৃত্বে ইউপি কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাঁরা বলেন, স্বৈরাচার ফ্যাসিস্টের সহযোগী মোস্তাফিজুল ইসলামকে কোনোভাবেই চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁরা মেনে নেবেন না। তাঁরা কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে এই চেয়ারে বসতে দেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দেন।

এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুল ইসলাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন জায়গায় ফোন করেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে চেয়ারম্যানের পক্ষের লোকজন তালা খুলে দেওয়ার দাবি জানান। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তালা খুলে না দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এ সময় চেয়ারম্যানের পক্ষের লোকজন তালা ভেঙে ফেলেন। অন্য পক্ষের লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে বাধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে দুই পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন।

আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুল ইসলামের পক্ষের মুজাহিদুল ইসলাম (৪৪), মাজাহারুল ইসলাম (৪২) ও গোলাম মোস্তফাকে (৪৫) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের কারও মাথা ফেটে গেছে, কারও হাত–পা ভেঙে গেছে।

এ বিষয়ে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আকরাম হোসেন বলেন, চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুল ইসলাম ৫ আগস্টের পরে ওই চেয়ারে বসে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য অপতৎপরতায় লিপ্ত আছেন। বিভিন্ন সময় তিনি বিএনপিসহ এই সরকারের নামে বিভিন্ন কথাবার্তা বলেন। এ নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভ ছিল। সে কারণেই তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে না দিতে এলাকার মানুষজন ইউনিয়ন পরিষদে তালা ঝুলিয়ে দেন। তিনি দাবি করেন, ওই তালা চেয়ারম্যান পক্ষের লোকজন ভেঙে ফেলতে গেলে তাঁদের কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়।

মোস্তাফিজুল ইসলাম বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের কেশবপুর উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। তারপরও দলীয় মনোনয়নে তিনি নির্বাচিত হননি। তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সরকার পরিবর্তনের পরে বিএনপির লোকজন তাঁকে কোনোভাবেই চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিতে চান না। এ নিয়েই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তিনি অভিযোগ করেন, আজকের মারামারিতে তাঁর বাবাকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চিংড়া বাজারে অবস্থিত। এই সংঘর্ষের সময় বাজারে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তখন মানুষ ভয়ে দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। এখন এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে যশোরের সহকারী পুলিশ সুপার এমদাদুল হক বলেন, তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কেশবপুরের ইউএনও জাকির হোসেন বলেন, সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। একটি  গন্ডগোলও হয়েছিল। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত।

এর আগে গত সপ্তাহে কেশবপুরের বিদ্যানন্দকাটি ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগসমর্থিত চেয়ারম্যান হওয়ায় সেখানেও বিএনপির কর্মীরা তালা ঝুলিয়ে দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র ক শবপ র স ঘর ষ স গরদ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

গ্লোবাল সাউথকে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের খেসারত দিতে হবে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে হঠাৎ করে ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপ করেছেন, তাতে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। শেয়ার ও বন্ড বাজারে ধস নেমেছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। বিশেষ করে যেসব দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর ফলে এমন একটি বৈশ্বিক মন্দা শুরু হতে পারে, যা পুরোপুরি মানবসৃষ্ট এবং যার সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে।

বেশির ভাগ ‘পারস্পরিক’ শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করার ট্রাম্পের ঘোষণায় বাজার কিছুটা শান্ত হয়েছিল। কিছু শুল্ক স্থগিত রাখলেও যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ সাধারণ শুল্ক এখনো বলবৎ আছে। ট্রাম্প আরও নতুন শুল্ক দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। 

সব মিলিয়ে এসব পদক্ষেপ আমদানি করা পণ্যের সরবরাহ কমাবে, যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের জন্য দাম বাড়াবে এবং যেসব দেশ পণ্য রপ্তানি করে, তাদের ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে। ভবিষ্যতের আলোচনাতেও খুব আশার কিছু নেই। ট্রাম্প আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি বিদেশি নেতাদের সম্মান দেখান না। 

চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্ক বৃদ্ধি চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এই শুল্ক ১৪৫ শতাংশে তোলা মূলত প্রতীকী। এটি চীন যেভাবে নিজের শুল্ক বাড়িয়েছে, তার পালটা পদক্ষেপ। কারণ, আগের ১০৪ শতাংশ শুল্কেই চীনা পণ্যের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক হয়ে পড়েছিল। 

মূলত ট্রাম্প প্রশাসন এই পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করার সংকেত দিচ্ছে। এর ফলে চীনা কাঁচামালের ওপর নির্ভর যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা ও দেশীয় উৎপাদনকারীরা গভীরভাবে প্রভাবিত হবে। সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থায় ইতিমধ্যে বড় ব্যাঘাত ঘটেছে।

বাড়তে থাকা অনিশ্চয়তা অবধারিতভাবে বিনিয়োগ কমিয়ে দেবে। ব্যবসাগুলো নতুন প্রকল্প স্থগিত রাখবে, পরিকল্পিত সম্প্রসারণ পিছিয়ে দেবে, ভবিষ্যতের পরিস্থিতি বোঝার অপেক্ষায় থাকবে। এর ফলে মন্দা দেখা দেবে আর তা যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র এই বাণিজ্যযুদ্ধে চীনকে হারাতে পারবে না। চীনা সরকার ধৈর্যের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিচ্ছে। যেকোনো সময় এই দুই পরাশক্তির মধ্যে চলমান অর্থনৈতিক লড়াই বড় ধরনের আর্থিক সংকটে বা এমনকি সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে।

ইতিমধ্যেই বিপদের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। বহুদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নেতৃত্বের ওপর বিশ্বব্যাপী আস্থা কমছে। 

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার, বন্ড এবং ডলারের দরপতন দেখা যাচ্ছে। মার্কিন ট্রেজারি বন্ড আর আগের মতো বিশ্বের সম্পদের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না।

আগের অনেক আত্মঘাতী অর্থনৈতিক সংকটের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সবচেয়ে বেশি ভুগবে উন্নয়নশীল বিশ্ব। রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়া বা বিলম্বিত হওয়ার কারণে অনেক দেশের উৎপাদন কমে গেছে এবং বেকারত্ব বেড়েছে। এর পাশাপাশি আর্থিক অস্থিরতা এমন এক সময়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

এই পরিস্থিতির প্রভাব ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকারি ঋণের ওপর পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে যেসব দেশ দরিদ্র বা মাঝারি আয়ের, তাদের অবস্থা আরও খারাপ। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত আগের এক মাসে এসব দেশের মার্কিন ডলারে নেওয়া ঋণের মূল্য গড়ে ২ দশমিক ৯ শতাংশ কমে গেছে, আর সেই ঋণের ওপর সুদের হার (ফলন) বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। 

মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, গ্যাবনের মতো আগেই ঋণের চাপে থাকা দেশগুলোতে সরকারি ঋণের দাম ১০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। অর্থাৎ এসব দেশের জন্য বিদেশ থেকে টাকা ধার নেওয়া এখন আরও কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এ রকম দেশগুলো বহু দশক ধরে অনেক দেশ মুদ্রার মান কমে যাওয়া, ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়া, বাজেট–ঘাটতি, বাধ্যতামূলক ব্যয়ছাঁটাই এবং দেশীয় বাজারে অস্থিরতার কঠিন চক্রে আটকে আছে। এর ফলে বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে।

এই অভিজ্ঞতা থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শিক্ষাটা খুব পরিষ্কার। এখন শুধু বিশ্বায়িত বাণিজ্যই ধ্বংসের পথে নয়, বরং যারা দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল অর্থায়নের সন্ধানে আছে, তাদের জন্য আর্থিক বিশ্বায়নও দিন দিন আরও অনাকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

ট্রাম্প বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে চান। কারণ তাঁর মতে, এ ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছে। এ অবস্থায় অনেক উন্নয়নশীল দেশ হয়তো নতুন করে ভাবতে শুরু করবে, যে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা তাদের স্বার্থ রক্ষা করে না, তেমন ব্যবস্থায় তারা থাকবে কি না। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত একটি বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে না ওঠে, ততক্ষণ এই যাত্রাপথ খুব সহজ হবে না।

জ্যোতি ঘোষ ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক


স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ