জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানাল সরকার
Published: 12th, February 2025 GMT
গত জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগ যে দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়কে (ওএইচসিএইচআর) ধন্যবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে ও এইচসিএইচআর স্বাধীনভাবে এ তদন্ত করেছে। প্রতিবেদনে গত জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বারা সংগঠিত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উঠে এসেছে। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জড়িত ছিল বলে প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘তৎকালীন সরকার এবং তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগ, এর সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। যার মধ্যে রয়েছে কয়েকশ’ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে গুরুতরভাবে শারীরিক নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ, ব্যাপক হারে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক এবং নির্যাতনসহ অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন। ওএইচসিএইচআর যুক্তিসংগত কারণে বিশ্বাস করে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং নির্দেশনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা ঘটেছিল।’
প্রতিবেদনের আরেকটি অংশে বলা হয়েছে: ‘ওএইচসিএইচআরের অনুমান, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই মিলিটারি রাইফেল এবং প্রাণঘাতি মেটাল প্যালেটস লোড করা শটগানে নিহত হয়েছেন। এই ধরনের শটগান সাধারণত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে আজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ১১,৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে প্রায় ১২-১৩ শতাংশ শিশু বলে জানা গেছে। পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের টার্গেট করে হত্যা করেছে, ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করেছে, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিকভাবে আটক-নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন করেছে। বিশেষ করে, শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখ সারিতে থাকা নারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেছে। নারীরা যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ছিল লিঙ্গ-ভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা ও ধর্ষণের হুমকি।
কয়েকটি ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য এবং ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয়েছে যে, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি সম্প্রসারিত দল পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে বা ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। তারা বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে ব্যাপকভাবে বেআইনি সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক অভিযানে, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশের সহিংস প্রচেষ্টাকে সাহায্য করতে অভিযান শুরুর আগেই সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকরা পুলিশের সাথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল অথবা পুলিশ ফোর্সের পেছনে থেকে আক্রমণে অংশ নিয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও লোকজনকে থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিল, বিক্ষোভকারীদের আটক করেছিল এবং সংগঠিত ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ পুলিশ ওএইচসিএইচআর-কে পুলিশ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ৯৫ জন সদস্যের নাম এবং তাদের ভূমিকা কী ছিল তার বিস্তারিত সরবরাহ করেছে। পুলিশের মতে, এই ব্যক্তিরাই বিক্ষোভের সময় সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য নাগরিকদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। অস্ত্র সরবরাহ যাদের করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০ জন তৎকালীন সংসদ সদস্য, ১৪ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ১৬ জন যুবলীগ নেতা, ১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা এবং সাতজন পুলিশ সদস্য।
গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি ‘কোর কমিটি’র বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে দ্রুত প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন।
‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য থেকে আরও জানা যায় যে, এর পরদিন অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ দমনের জন্য বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে বলেছিলেন এবং বিশেষভাবে “বিক্ষোভের মূল হোতা”, “গন্ডগোল সৃষ্টিকারী”দের গ্রেপ্তার, হত্যা এবং হত্যার পর লাশ লুকিয়ে রাখার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন,’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে যেই অনুসন্ধানকারীরা কাজ করেছেন তাদেরকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। বর্তমান সরকার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এবং নিয়মিত আদালতে সে সময়কার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।’ তবে সরকারের এই প্রচেষ্টা বিভিন্ন মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগে বিদ্যমান কাঠামোগত ত্রুটির কারণে এই প্রচেষ্টার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলা পুলিশি অসদাচরণ, যেমন গণহারে মামলা দিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়ের, অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও স্বপদে বহাল থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার ক্রমাগত ভয় দেখানো, প্রমাণে কারসাজি সেইসঙ্গে আইসিটি এবং নিয়মিত আদালত সম্পর্কিত অন্যান্য যথাযথ প্রক্রিয়াগত জটিলতা।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সকলকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সকল ব্যক্তি এবং কোটি কোটি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে সকল মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার খাতে “কাঠামোগত ঘাটতি” তৈরি হয়েছে। আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই যেখানে সকল মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারে, এজন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত সকলকে আহ্বান জানাই, আপনারা ন্যায়বিচার, আইন এবং বাংলাদেশের জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখুন। যারা আইন ভঙ্গ করেছেন এবং মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেছেন তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসুন।
সূত্র: বাসস
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: তৎক ল ন স সরক র র ন সরক র ল গ সমর কর ছ ল হয় ছ ন ত হয় ছ র জন য আওয় ম সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
ঘরে ফিরে ঘরের তালাশ
ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ির বার-মহলে এসে দাঁড়ান রাব্বি সাহেব। চুন–সুরকির পলেস্তারা খসে পড়ে ইট বের হয়ে যাওয়া নয়-চালি ঘরটির দিকে তিনি দিশা ধরে খানিক তাকিয়ে থাকেন। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে তাঁর মুখের মাংসপেশি সামান্য কাঁপে। ধূসর দাড়ি–গোঁফে নাশতার ছিটেফোঁটা লেগে আছে। কাঁপুনি ব্যাপকভাবে বাড়তেই, তা থেকে ঝরে পড়ে একদানা চিনি-ছিটানো খই। ঘাসের গোড়ায় কিছু খুঁটতে থাকা একটি শালিক তা খুট করে তুলে নেয় মুখে।
কাঁপুনি একটু থামতেই তিনি চলে আসেন সিঁড়িতে। খুব সাবধানে এক পা দু–পা করে ঈষৎ লাফিয়ে উঠে পড়েন চতুর্থ ধাপে। ফুলের সুবাস পেতেই থমকে দাঁড়ান। সিঁড়িটির বাঁ পাশে তাঁর কিশোর বয়সের কামিনীগাছটি বয়োবৃদ্ধ হালতে এখনো পত্রপুষ্পে ছড়িয়ে আছে আগের মতো। পুরোনো দিনের চেনা কোনো স্বজনের সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো তাঁর ইচ্ছা হয় ভোরবিহানে শ্বেতশুভ্র পুষ্পের জাদু ছড়ানো তরুবরটিকে হাত বাড়িয়ে একটু স্পর্শ করার। কিন্তু সাহস পান না।
বিলাত থেকে সপ্তাহখানেক আগে স্বদেশে ফেরার ঠিক সাত মাস তেরো দিন আগে রাব্বি সাহেবের স্ট্রোক হয়, তবে সেরে ওঠেন, কিন্তু ডান পা, যা বছর চারেক আগে থেকেই কার অ্যাকসিডেন্টে বিক্ষত ছিল, তা স্ট্রোকের ধকলে পুরোপুরি অবশ হয়ে যায়। পায়ে হালফিল খানিকটা সংবিৎ ফিরে পেয়েছেন বটে কিন্তু সে থেকে শরীর-গতরের ডান দিকটাও বেজায় কমজোর হয়ে আছে। কামিনীর কুন্দকুসুম কিংবা পত্রালি স্পর্শ করতে গিয়ে তিনি ভারসাম্য হারানোর ঝুঁকি নিতে চান না। ক্রাচ ঠুকে ঠুকে আরও তিনটি ধাপ ভেঙে তিনি উঠে আসেন খোলামেলা বারান্দায়।
তখনই খেয়াল হয়, সিঁড়ির ডান দিকে তো একই ক্বদের আরেকটি কামিনীগাছ থাকার কথা। ঘাড় ফিরিয়ে, এক পা সামনে বেড়ে, রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকান। যমজ তরুবরের সহোদরাটি গায়েব হয়েছে পুরোপুরি। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মা ছাগল। তার বাঁট থেকে দুধ চুষছে তিনটি ছানা।
রেলিং ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান রাব্বি। সুরুজের তেজে চোখের সামনে ঝলমলিয়ে ওঠে কাঞ্চা সবুজে লেগে থাকা শিশিরবিন্দু। ভারি তাজ্জব হন! পারিবারিক বনেদি কেতার এ এজমালি বাংলাঘরটির সামনে ঠিক এই জায়গায়ই না ছিল একটি চৌখুপ্পি বাগিচা? কয়েকটি গোলাপ, গন্ধরাজ, করবী ও পাতাবাহারের ছাঁটা ঝোপগুলোর তো এখানে থাকার কথা!
ভাবেন, বারান্দায় বসবেন, কিন্তু যেখানে ইজিচেয়ার ও কাঠের পিঁড়িগুলো থাকার কথা, ঠিক ওই জায়গায় রাখা হয়েছে একটি ওয়াটার পাম্প। চারদিকে ছড়ানো–ছিটানো নিড়ানি, সারের বস্তা ও কীটনাশকের শিশি-বোতলসহ একটি জারিক্যান। রাব্বি ভাবেন, একটু নাহয় সিঁড়িতে বসবেন, কিন্তু নিচু হয়ে বসলে আবার যদি উঠে দাঁড়াতে মুশকিল হয়?
হঠাৎ তাজ্জব হওয়ার ঘোর তাঁর সহজে কাটে না! আবার তাকান, বাগিচার পরিসরজুড়ে সার-জলের স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়তে থাকা ধানের কচি চারাগুলোর দিকে। কয়েকটি রুপালি বিন্দুতে ঝলসে যায় শিশিরের বর্ণালি। অসামান্য এ দৃশ্যপটের দীপ্তিতেও সন্তুষ্ট হতে পারেন না রাব্বি।
মেহেদিগাছগুলোই–বা গেল কোথায়? বিয়েশাদি কিংবা শবে কদরের রাতে গ্রামের কিশোরীরা দল বেঁধে আসত না মেহেদিপাতা তুলতে? হঠাৎ মনে পড়ে যায় ইলেকশনের কথা। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের জামানায় চালু হয়েছিল, ইউনিয়নভিত্তিক বনিয়াদি গণতন্ত্র বলে একটি প্রথা। তিনি চেয়ারম্যান পদে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হয়েছিলেন, লাঙল মার্কা প্রতীকে বিপুল ভোটে জিতেও ছিলেন।
কত সালের কথা—১৯৬৬ না ৬৭? নির্বাচনের বছর তাঁর লাগানো ডালিয়াগুলো বেজায় দৃষ্টিনন্দন হয়েছিল পুষ্পের বর্ণাঢ্য আভায়। একসঙ্গে ফুটেছিল বত্রিশ কিংবা বিয়াল্লিশটি ডালিয়া। সে আমলে গেরামগঞ্জের বিয়েশাদিতে সেভেন-সিটার বলে একধরনের ভ্যানগাড়ি কিরায়া করার রেওয়াজ ছিল। বিবাহে আরেক ধরনের গাড়ি দামান্দ-কন্যা আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। গাড়িটির কী একটা ইংরেজি নামও ছিল...। ইয়েস, নামটা এবার পরিষ্কার মনে পড়ে—স্টাফকার।
না, এ আতরাফে তো বটে, মুহকমা শহরেও তাজা ফুলের কোনো দোকান ছিল না। তার বন্ধু সুজিত দেবনাথের বিয়েতে, এই বাগিচার ডালিয়া দিয়ে তিনি নিজ হাতে স্টাফকারটি সাজিয়ে দিয়েছিলেন। বাসর রচনার জন্যও চাপলিশে পাঠিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি গোলাপ, বকুল ও গন্ধরাজ।
বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসেন চোখে সুরমা টানা গোলটুপি মাথায় একজন মৌলভি গোছের তরুণ। তিনি কানে তুলা গুঁজতে গুঁজতে রাব্বি সাহেবকে তাজিমের সঙ্গে সালাম দেন। রাব্বি মিনমিনিয়ে আলেক উচ্চারণ করেন, কিন্তু গলায় চেককাটা গিলাফ পরা তরুণের সঙ্গে অধিক বাতচিতের আগ্রহ তাঁর হয় না। পরিসরে আতরের কড়া গন্ধ ছড়িয়ে তরুণটি চাপা স্বরে ‘আল্লাহু করিম’ বলতে বলতে নেমে যান সিঁড়ি ধরে।
রাব্বি অবগত যে অন্য শরিকানদের ছেলেপিলে তথা তাঁর সম্পর্কে ভাতিজা কিংবা তাদের পুত্ররা, মাদ্রাসায় আলিয়া অবধি পড়া এই তরুণটিকে বাড়ি-সংলগ্ন মসজিদের ইমাম নিযুক্ত করেছেন। এ ছাড়া মক্তবের দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে বাংলাঘরের দক্ষিণ দিকের কামরায় ইনি বসবাসও করছেন।
রাব্বি বারান্দা ধরে কদম কয়েক সামনে বাড়েন। অতঃপর দক্ষিণের কামরাটির সামনে এসে দাঁড়ান। জানালা দিয়ে কামরার ভেতর দেখা যাচ্ছে পরিষ্কারভাবে। চুনকাম উঠে বিবর্ণ হওয়া দেয়ালে আসমা উল হুসনা বা আল্লাহ পাকের নিরানব্বইটি সিফতি নামের ক্যালিওগ্রাফ করা একটি পিকচার ফ্রেম ঝুলছে।
খুলনার মাস্টার সাহেবের কথা তাঁর স্মৃতিতে জোরেশোরে ফিরে আসে। মাস্টারের আসল নাম কী ছিল? রাজনৈতিক কারণে কবিরুল হক ছদ্মনামে এই কামরায় হুলিয়া এড়িয়ে বছর দুয়েক আত্মগোপন করেছিলেন। সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসাবে রাব্বি সাহেবের তখন এলাকায় বেশ খানিকটা প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল। স্থানীয় হাইস্কুলে কবিরুল হককে মাস্টারের চাকরি পাইয়ে দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
মাস্টার ইংরেজি ও ইতিহাস পড়াতেন। তাঁর আঁকাজোকার হাত ছিল দুর্দান্ত। দেশে তখনো চলছে আইয়ুব খানি মার্শাল ল’র জবর তমতমি। কমিউনিস্ট ভাবধারার বামপন্থী ক্যাডারদের অনেককেই হুলিয়া মাথায় নিয়ে চলে গেছেন পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে। কবিরুল মাস্টার ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি জলরঙের ডালিয়া ফোটা বাগিচার একটি দৃশ্যপট এঁকে দিয়ে সবাইকে চমৎকৃত করেছিলেন।
বৈঠকখানায় ঢুকে রাব্বি পেইন্টিংটি কোথায় তা নিয়ে একটু ভাবেন, চারদিকে খুঁটিয়ে তাকান। দেয়ালে যেখানে চিত্রটির ঝুলে থাকার কথা, ওখানে সস্তা একটি বিরাট আকারের সচিত্র পোস্টার সাঁটা। রাব্বি রংচঙে পোস্টারটির দিকে কিছুক্ষণ দিশা ধরে তাকান। ঢেউতোলা ছাদের দৃষ্টিনন্দন ইমারতটিকে শনাক্তও করতে পারেন, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারেন না, তাঁর পৈতৃক ভিটেবাড়ির দেয়ালে সিডনি শহরের অপেরা হাউসের ছবি টাঙানোর প্রাসঙ্গিকতা!
দেয়ালঘেঁষা বইয়ের আলমারি তিনটি এখনো আগের জায়গায়ই আছে। তবে কোনো কোনোটির ভাঙা কাচ সরিয়ে পাল্লায় গঁদ দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পলিথিনের স্বচ্ছ আবরণ। রাব্বি ভুরু কুঁচকে ভেতরের থরে-বিথরে সাজানো বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনেকগুলো বইয়ের রচয়িতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী।
এক জামানায় তাঁর সংগৃহীত বইপত্র দিয়ে এ আলমারি তিনটিতে রাব্বি চেনা বন্ধুবান্ধবের জন্য চালু করেছিলেন একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। লেনদেনের সুবিধার জন্য নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন বইগুলোর ক্যাটালগও। দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে তিনি সংগৃহীত পুস্তকগুলোর নাম মনে করার চেষ্টা করেন। যোগাযোগ, চক্রবাক, পদাতিক, সুকান্ত সমগ্র, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা...। না, সিস্টেমেটিক্যালি সব কটির নাম মাথায় আসছে না।
একসময় সমরেশ বসুর উপন্যাসগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। ’৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ওপার বাংলা থেকে বইপত্রের আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন বন্ধু সুজিত দেবনাথ হয়ে ওঠে পশ্চিম বাংলা থেকে বইপত্র আনানোর কান্ডারি। সে মাঝেমধ্যে ওপারে তার আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বেড়াতে যেত। ফিরে আসত কাঁড়ি কাঁড়ি বইপত্তর নিয়ে...।
সুজিতের সক্রিয় উৎসাহে এ বৈঠকখানায় তিনি চালু করেছিলেন স্টাডি সার্কেল। তত দিনে সে বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একটি ফ্যাকশনের পুরোদস্তুর ক্যাডার বনে গেছে। এলাকার প্রগতিমনা ছেলেরা ছিল স্টাডি সার্কেলের সদস্য। একটি সিলেবাসও তৈরি করা হয়েছিল। ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি বই দুটি দিয়ে পাঠচক্রে অধ্যয়নের শুরুয়াত হতো। সিলেবাসে তৃতীয় বইটি ছিল যে গল্পের শেষ নেই।
পাঠ করার পর কমরেড সুজিতের তত্ত্বাবধানে তা নিয়ে আলোচনাও হতো। যারা মাস ছায়েক পাঠচক্রের চর্চায় যুক্ত থাকত, তাদের হাতে অবশেষে ধরিয়ে দেওয়া হতো সাম্যবাদের হাতেখড়ি ও ভলগা থেকে গঙ্গা প্রভৃতি পুস্তক।
স্মৃতির কিসতি চড়ে রাব্বি যেন চলে গিয়েছিলেন পুরোনো দিনের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি যুগে। হঠাৎ মুখের মাংসপেশিতে কম্পনের তোড় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে তিনি চকিতে ফিরে আসেন বর্তমান মুহূর্তে। ভাবেন, একটু বসে জিরিয়ে নেবেন, কিন্তু বেতের সোফাগুলোর যে হালত, যেভাবে কুশন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে তুলা, বসার আগ্রহ তাঁর মিইয়ে আসে। আবার একটু ঝুঁকে পড়ে রাব্বি তাকান, আলমারির নিচের দিকের একটি তাকে।
ওখানে মসলা-মাসায়েলের কয়েকটি পুস্তকের শিরোনামগুলো পড়েন। এগুলোর পাশে রাখা কুয়াশা সিরিজের গোয়েন্দা গল্পের বইগুলো। ঠিক বুঝতে পারেন না, তাঁর সংগ্রহকে গায়েব করে দিয়ে এ বইগুলো জোগাড়ে তরুণ ইমামের কোনো ভূমিকা আছে কি না? না, আপাতদৃষ্টে পরহেজগার মানুষটিকে দোষারোপ করতে মন থেকে তিনি সায় পান না।
তাঁর পৈতৃক বসতবাড়িটি আদিতে ছিল চার শরিকে বিভক্ত। গত চল্লিশ বছরে তাঁর বাবাসহ তিন চাচা পরলোকে গেছেন, মোট সাতজন ভাতিজি বিবাহিত হয়ে স্বামীদের ঘরসংসার করছে। বাদবাকি এগারোজন ভাতিজারও নিজস্ব পরিবার হয়েছে। এদের সন্তানাদি বেশুমার। অনেকগুলোরই নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই, ধানি জমির আয় সম্বল করে এরা গল্পগুজব করে, বিবিসি শোনে, মসজিদে চিল্লা দিয়ে, হরেক কিসিমের পত্রিকা পড়ে দিনাতিপাত করে। এদের কেউ কেউ প্রচণ্ড রকমের ধর্মপ্রবণ, কথাবার্তায় পৃথিবীজুড়ে পূর্বপুরুষদের পবিত্র ধর্মের রাজনৈতিক বিজয়ের প্রত্যাশা রাখে। এদের পুত্রসন্তানেরা প্যান্টের পায়া গুটিয়ে ঘন্টার ওপর তুলে হাঁটাচলা করে। কন্যারা প্রায় সবাই হেজাবে মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত রাখতে পছন্দ করে।
যাদের শরীরে প্রবাহিত শোণিতের সঙ্গে তাঁর জৈবিক যোগসূত্র বংশপরম্পরার, সেই পরবর্তী প্রজন্মের কুটুমখেশের দিনযাপনের বিষয়–আশয় তাঁকে উদ্বিগ্ন করে। হালফিল তাদের বিবর্তিত সংস্কৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাব্বির মাথা ঘুরন্টি দিয়ে ওঠে। কোনো ক্রমে একটি সোফার কিনার ধরে, নিজেকে সামলে বসে পড়েন। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে তিনি যেন চলে যান ভিন্ন এক শতাব্দীর শেষ দিককার অন্য এক দশকে। মনশ্চক্ষে পরিষ্কার দেখতে পান, তামাম পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে চলছে নির্বাচনের তুলতবিল। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে নেমেছেন, সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ। পত্রপত্রিকা তাঁকে অভিহিত করছে ‘মাদারে মিল্লাত’ বিশেষণে।
এই কামরার আসবাব সরিয়ে, মেঝেতে উবু হয়ে বসে মাস্টার সাহেব পোস্টারে বড় করে আঁকছেন বিরোধীদলীয় নির্বাচনী প্রতীক লন্ঠনের ছবি। এরপর ভিন্ন পোস্টারে লিখছেন, ‘বিরোধী দলের প্রার্থীকে আপনার মূল্যবান ভোট দিয়া আইয়ুবশাহিকে গদিছাড়া করুন।’ আবার অন্য পোস্টারে লিখছেন, ‘কৃষকনেতা হাতেম আলী বন্দী কেন? রাজবন্দীদের মুক্তি চাই ।’
কামরার এক কোণে, ডিবানের ওপর বসে, হারমোনিয়ামের রিড টিপে টিপে সুজিত চাপা সুরে গাইছে। কৈশোরে রবীন্দ্রসংগীতের রেওয়াজ করা সুজিতের কণ্ঠস্বরে মূর্ত হয়ে উঠছে শ্রী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসংগীত, ‘কাস্তেটারে দিও শাণ/ কিষান ভাই রে...।’
রাব্বি স্মৃতিচারণাকে একটি দৃশ্যপটে ফোকাস রাখতে পারেন না। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো তা দুলতে দুলতে দূরে দূরে থেকে বহুদূরে সরে গিয়ে ফিরে এসে তৈরি করে খণ্ডবিখণ্ড দৃশ্যপট ও বিগত জনাকয়েক স্বজনের স্মৃতিবিধুর মুখের সমাহারে বিচিত্র একটি কোলাজ। তাঁর বাঁ হাত থেকে খট করে রংচটা মোজাইকের মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে হাইপাওয়ারের চশমাটি। চশমা থেকে ছিটকে খুলে পড়া লেন্স থেকে বিচ্ছুরিত আলোর রেখার দিকে রাব্বি সাহেব তাকিয়ে থাকেন চুপচাপ।