‘আমি অসুস্থ, রিমান্ডে দিয়েন না’, আদালতে ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদার
Published: 12th, February 2025 GMT
ব্যাংকমালিকদের সমিতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার আদালতের কাছে অনুরোধ করেছেন, তিনি অসুস্থ। তাঁকে যেন রিমান্ডে দেওয়া না হয়। তিনি গণভবনে বাধ্য হয়ে গিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
অবশ্য ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ অন্যরা জুলাই গণহত্যার ষড়যন্ত্রকারী।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় নজরুল ইসলাম মজুমদারকে আজ বুধবার সকালে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে নেওয়া হয়। সকাল পৌনে ১০টার দিকে আদালতে গিয়ে দেখা যায়, নজরুল ইসলাম মজুমদারের মুখে মাস্ক, মাথায় হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, পরনে পাঞ্জাবি। পায়ে কেডস (জুতা)।
হাজতখানা থেকে যখন নজরুল ইসলাম মজুমদারকে নিয়ে পুলিশ আদালতের সামনে আসে, তখন তাঁর ডান হাতে একটি ফাইল। ফাইলের ভেতর কিছু কাগজ।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের পেছনে ছিলেন সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার।
সময় তখন ১০টা। কাঠগড়ার এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। বিচারক এজলাসে আসেননি। এ পর্যায়ে নজরুল ইসলাম তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। বিচারক এজলাসে প্রবেশ করেন ১০টা ৫ মিনিটে। তখন বিচারকের পাশে দাঁড়ানো একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলতে থাকেন, ‘আসামি নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা রয়েছে।’
পুলিশের মুখ থেকে নিজের নাম শোনার পর নজরুল ইসলাম মজুমদার কাঠগড়ার উত্তর পাশে এগিয়ে যান। এ সময় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে রিমান্ডে নেওয়ার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে শুরু করেন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আপনার সামনে যে আসামি দাঁড়িয়ে, তিনি একজন ব্যবসায়ী। এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা যখন আন্দোলন করছিলেন, তখন নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ ব্যবসায়ীরা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। এই আসামি শেখ হাসিনাকে অভয় দিয়েছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার এই আন্দোলনকে দমাতে হবে। ব্যবসায়ীরা এ সরকারের সঙ্গে আছে।’
পিপি যখন কথা বলছিলেন, তখন নজরুল ইসলাম মজুমদার বারবার বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার ডান হাত উঁচু করে বিচারকের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘মাই লর্ড, আমি কি কিছু বলতে পারি?’
তখন বিচারক নজরুল ইসলাম মজুমদারকে বলেন, ‘আপনার আইনজীবী রয়েছে, যা বলার, তিনি আপনার পক্ষে বলবেন।’ বিচারকের এ কথা শোনার পর নজরুল ইসলাম মজুমদার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, ‘যখন কোনো আসামিকে আদালতে আনা হয়, তখন ওনারা বড় বড় বক্তৃতা করেন। বলতে শুরু করেন, তাঁরা কেউই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন না। বাস্তবতা হচ্ছে, নজরুল ইসলাম মজুমদার শেখ হাসিনার অন্যতম একজন সহযোগী। তিনি ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সহযোগী হয়ে অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। অনেক অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিদেশেও সম্পদ পাচার করেছেন তিনি।’
ওমর ফারুক ফারুকী আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, জুলাই-আগস্টে নির্বিচার ছাত্র–জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ অন্য যাঁরা শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যাঁরা শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, তাঁরা জুলাই–আগস্ট গণহত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। এ কথা বলে ছাড় পাওয়ার উপায় নেই যে আমরা তো হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলাম না। আমাদের আইনে সরাসরি যে ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করেন, তাঁর যে শাস্তি, একই শাস্তি যে বা যাঁরা এ হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।’
পিপি ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের সপক্ষে একের পর এক যুক্তি তুলে ধরার সময় নজরুল ইসলাম মজুমদার আবার হাত উঁচু করেন। বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘মাননীয় আদালত আমার কিছু কথা আছে।’
নজরুল ইসলাম মজুমদার আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার একটা অপারেশন হয়েছে। আমি এক মাস যাবৎ হাসপাতালে ছিলাম। আমাকে রিমান্ডে দিয়েন না। দয়া করে আমাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেবেন।’
নজরুল ইসলাম মজুমদার চিকিৎসা–সংক্রান্ত তাঁর কাগজপত্র আদালতকে দেখান। তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে নিয়ে পিপি সাহেব যেসব কথা বলেছেন, তার সব কটি সঠিক নয়। মাননীয় আদালত, আমার ভাই হীরু (সাইফুল ইসলাম হীরু) লাকসামের এমপি ছিলেন। তাঁকেও শেখ হাসিনার আমলে গুম করে হত্যা করা হয়েছে। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গণভবনে বাধ্য হয়ে ওই বক্তব্য দিয়েছিলাম।’
নজরুল ইসলাম মজুমদারের রিমান্ডের বিরোধিতা করে এরপর আদালতে বক্তব্য দেন তাঁর আইনজীবীরা। আইনজীবী মাহবুব ইসলাম মজুমদার আদালতকে বলেন, নজরুল ইসলাম মজুমদারের মক্কেলের হার্টে রিং (স্টেন্ট) পরানো। কারাগারে থাকা অবস্থায় রিং পরানো হয়েছে। এর আগেও তাঁকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড কিংবা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।
নজরুল ইসলাম মজুমদারের আইনজীবী মাহবুব ইসলাম মজুমদার আদালতকে আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার মক্কেল একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তাঁর গড়ে তোলা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নাসা গ্রুপে ৫০ হাজারের অধিক লোক চাকরি করেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাঁচ লাখ লোক নাসা গ্রুপের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক মাসের ৭ তারিখে বেতন দিতে হয়। ওনার শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে কোনোভাবে তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ নেই।’
উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত নজরুল ইসলাম মজুমদারকে পৃথক দুটি হত্যা মামলায় ৫ দিন করে মোট ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন। এ সময় নজরুল ইসলাম মজুমদারকে বিমর্ষ দেখা যায়।
চুপচাপ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলেসাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান জ্যোতি আজ চুপচাপ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এদিন ধানমন্ডি থানার একটি চাঁদাবাজির মামলায় তাঁকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে পুলিশ।
মোদাচ্ছের খানের রিমান্ডের সপক্ষে আদালতে যুক্তি তুলে ধরেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পিপি ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ছিলেন শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী। তিনি যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর ছেলে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড জড়িত ছিলেন।
অবশ্য মোদাচ্ছের খানের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত নন।
উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত মোদাচ্ছের খানকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন।
আদালতের আদেশের পর বেলা ১১টার দিকে নজরুল ইসলাম মজুমদার, কামাল আহমেদ মজুমদার, শাফি মোদাচ্ছের খানদের আবার মাথায় হেলমেট পরিয়ে কাঠগড়া থেকে বের করে আদালতের বারান্দায় আনা হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ জ ঞ স ব দ কর র ওমর ফ র ক ফ র ক ছ ত র জনত ষড়যন ত র র আইনজ ব ব যবস য় ক ঠগড়
এছাড়াও পড়ুন:
বিচারক এজলাসে ওঠেননি, সাইবার ট্রাইব্যুনালে কোনো মামলার শুনানি হয়নি
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে আজ রোববার মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। এজলাসে ওঠেননি সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নূরে আলম। আইনজীবী সমিতি বলছে, সংক্ষুব্ধ আইনজীবীরা ওই আদালতে শুনানি করতে যাননি।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের দুই কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলার এক আসামির জামিন আবেদন নাকচ করেন আদালত। জামিন আবেদন নাকচ হওয়ার পর আইনজীবীরা সংক্ষুব্ধ হন। আজ সকাল ১০টার দিকে ঢাকা আইনজীবী সমিতির কয়েকজন সদস্য আদালতের কর্মচারীদের জানিয়ে দেন, বিচারক যদি এজলাসে ওঠেন, যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়, তার দায় আইনজীবীরা নেবেন না।
এ বিষয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) মিরাজ উদ্দিন সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জামিন আবেদন নাকচ হওয়ার পর আইনজীবীর সঙ্গে বিচারকের বাতচিৎ হয়। আজ সকালে ঢাকা বারের বেশ কয়েকজন আইনজীবী আদালতে এসে কর্মচারীদের বলে যান, বিচারক যেন এজলাসে না ওঠেন। আইনজীবীদের ওই কথা বিচারককে জানানো হয়। ফলে মামলার কোনো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।’
অবশ্য আইনজীবী শামসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জামিন আবেদন নাকচ করার বিষয় নিয়ে আদালতের সঙ্গে তাঁর কোনো বাতচিৎ হয়নি। জামিন দেওয়া না–দেওয়া আদালতের এখতিয়ার। জামিনের বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটেনি; বরং অনেক আইনজীবীর অভিযোগ, তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারকসুলভ আচরণ করেননি। সাধারণ আইনজীবীরা ওনার আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি খোরশেদ আলম মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, আগে থেকে সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারকের ব্যবহারে অনেক সাধারণ আইনজীবী অসন্তুষ্ট। বৃহস্পতিবার জামিন আবেদন নাকচের পর সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সঙ্গে বিচারকসুলভ আচরণ করেননি বলেও আইনজীবীরা সমিতির কাছে অভিযোগ করেছেন। এ জন্য সাধারণ আইনজীবীরা ওই আদালতে আজ শুনানি করতে যাননি।