১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এর আগে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে এবং এর পূর্ণাঙ্গ বিবরণও অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।
এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছেন, যাতে এর নেতি ও ইতি উভয়ই উঠে এসেছে। সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও অনানুষ্ঠানিক মতামত জানিয়েছে। ১৫ তারিখের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোকেও ডাকা হবে। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কারের পদক্ষেপগুলো ব্যাখ্যা করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের মূল চেতনাই ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোও মনে করে রাষ্ট্রকাঠামোকে গণতান্ত্রিক রূপ দিতে যেসব বাধা আছে, সেগুলোও দূর করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা বলা যায়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠার পেছনেও ছিল জনগণের ভোটাধিকার হরণ। পরপর তিনটি নির্বাচন তারা করেছিল জবরদস্তিভাবে।
এ ছাড়া আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর যেসব মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যক্তির একচ্ছত্র ক্ষমতাচর্চা, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের একাকার হয়ে যাওয়া, বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ। কেবল বিগত সরকার নয়, স্বাধীনতার পর থেকে এই একচ্ছত্র ক্ষমতাচর্চা চলে আসছিল।
এই প্রেক্ষাপটে সরকারের সংস্কার প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক দলই সমর্থন জানিয়েছে। আবার বিএনপিসহ বেশ কিছু দল বলছে, সংস্কার প্রস্তাব তারা অনেক আগেই দিয়ে রেখেছে, যার সঙ্গে সরকার গঠিত কমিশনের প্রস্তাবের মৌলিক পার্থক্য নেই। একই সঙ্গে তারা এই যুক্তিও দিচ্ছে যে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংস্কার করেই নির্বাচন দেওয়া উচিত।
সবাইকে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। আর জনগণের রায় নেওয়ার একমাত্র উপায় নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের বিষয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রূপরেখা তৈরি করা। নির্বাচন প্রশ্নে সরকার নিরপেক্ষ থাকবে, সেটাই রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের প্রত্যাশা। সে ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে অর্থবহ সংলাপের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা।
সরকারের পক্ষ থেকে যে আভাস–ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার প্রস্তুতি তাদের আছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোকেই মোটাদাগে কতগুলো বিষয়ে একমত হতে হবে। কোনো দলের এমন অবস্থান নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে পুরো উদ্যোগই ভেস্তে যায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে একটি অভিযোগ আছে, অতীতের আলোচনাগুলো এত সংক্ষিপ্ত ছিল যে তারা তাদের মতামত ঠিকভাবে জানাতে পারেনি। আমরা আশা করব, সরকার তাদের সংলাপ উদ্যোগকে এমনভাবে সাজাবে, যাতে সব দল খোলাখুলি তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতা হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যেসব অস্থিরতা আছে, সেগুলোও ধীরে ধীরে কেটে যাবে আশা করা যায়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র মত মত ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি কারা, তাদের জন্ম কীভাবে?
পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তানে এক ভয়াবহ নাটকীয় ঘটনায় ১১ মার্চ সশস্ত্র বিদ্রোহীরা একটি যাত্রীবাহী ট্রেন দখল করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত অভিযান চালিয়ে শত শত জিম্মিকে মুক্ত করেছে। ট্রেনটি বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে উত্তরের পেশোয়ারে যাচ্ছিল, আর তাতে ছিলেন বেশ কিছু সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্য।
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) কোনো বিলম্ব না করেই হামলার দায় স্বীকার করে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান-এ পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা জানায়, এটি পাকিস্তানের ‘দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক দখলদারত্ব এবং বেলুচ জনগণের বিরুদ্ধে চালানো যুদ্ধাপরাধের’ প্রতিশোধ।
১৯৪৮ সালে ভারত বিভক্তির কয়েক মাস পর বেলুচিস্তান পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলে তখন থেকেই অঞ্চলটি পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অবহেলার শিকার। দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারকে একের পর এক বিদ্রোহ দমন করতে হয়েছে।
সাম্প্রতিক এই ট্রেন অপহরণের ঘটনায় বিএলএ দাবি করে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে বেলুচ রাজনৈতিক কর্মী, নিখোঁজ ব্যক্তি ও বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে, নইলে তারা জিম্মিদের হত্যা করবে। এরপর সেনাবাহিনী দুই দিন ধরে কঠোর অভিযান চালায়। অভিযানে ৩৩ জন বিদ্রোহী, ২১ যাত্রী ও ৪ সেনাসদস্য নিহত হন।
এই নজিরবিহীন হামলা আবারও পাকিস্তান সরকারকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে—বেলুচিস্তানের বাড়তে থাকা অসন্তোষ ও সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনে তাদের কৌশল আসলে কতটা কার্যকর?
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) একটি স্বাধীনতাকামী সংগঠন। ২০০০-এর দশকের শুরুতে তারা আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান সরকার ও বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ একে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আরও পড়ুনবেলুচিস্তান কেন স্বাধীন হতে চায়১৪ মার্চ ২০২৫অন্যান্য তুলনামূলক নরমপন্থী বেলুচ জাতীয়তাবাদী দলের মতো বিএলএ পাকিস্তানের অংশ হিসেবে টিকে থাকতে চায় না। তারা চায় সম্পূর্ণ স্বাধীন বেলুচিস্তান।
বেলুচ জনগণের অসন্তোষের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনীতে পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব না থাকা। জাতীয়তাবাদীরা অভিযোগ করে, পাকিস্তান সরকার বেলুচিস্তানের কয়লা, সোনা, তামা ও গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করছে। অথচ স্থানীয় বেলুচ জনগণ তাতে কোনো সুবিধা পাচ্ছে না।
উদাহরণস্বরূপ, সোনা ও তামার খনির রাজস্বের বেশির ভাগ অংশই যায় এটি পরিচালনাকারী চীনা কোম্পানি ও পাকিস্তান সরকারের পকেটে। বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক সরকার পায় মাত্র ৫ শতাংশ।
চাঘাই পাকিস্তানের সবচেয়ে খনিজসমৃদ্ধ জেলা। অথচ এ জেলা পাকিস্তানের সবচেয়ে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর একটি। স্থানীয় শ্রমিকেরা অভিযোগ করেন, খনিতে তাঁদের শুধু নিম্ন মানের কাজ দেওয়া হয়। তাঁরা ভয়াবহ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হন।
দীর্ঘদিনের অবহেলার কারণে বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ প্রদেশ হিসেবে রয়ে গেছে। মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) ২০১৭ সালে এটি ০.৪২১ স্কোর করে, যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। তুলনায় সবচেয়ে উন্নত প্রদেশ পাঞ্জাবের এইচডিআই ০.৭৩২।
২০০৬ সালে বিশিষ্ট বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর বুগতি সেনা অভিযানে নিহত হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এরপর পাকিস্তান সরকার বিএলএকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং প্রদেশটিতে সামরিক অভিযান আরও তীব্র হয়।
বেলুচিস্তানের বোলান জেলায় লিবারেশন আর্মির পুড়িয়ে দেওয়া ট্রাক