সুদহারের সিদ্ধান্ত ঠিক আছে, বিনিময় ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন
Published: 12th, February 2025 GMT
মুদ্রানীতিতে মোটা দাগে সুদহার ও মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, তা রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় সুদহার অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। কেননা, সুদহার কমলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টি বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। ডলারের দর ১২২ টাকা রাখার যে সিদ্ধান্ত, তা সঠিক নয়। ডলারের জোগান কমলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। আরেকটি বিষয়, আইএমএফ কর্মসূচি থেকে সরে গেলে সবার কাছে নেতিবাচক বার্তায় খরচ বাড়বে ব্যবসায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত রেখেছে। নীতি সুদহার পরিবর্তন করা হয় মূলত মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতিতে একটি মিশ্র চিত্র দেখা যাচ্ছে, যেখানে নীতি সুদহার পরিবর্তনের মতো কোনো সংকেত নেই। নীতি সুদহার কমালে অবশ্য ব্যবসায়ীরা খুশি হতেন। তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতো। আবার সুদহার কমলেই বিনিয়োগ বাড়বে, এটি এরই মধ্যে ভুল প্রমাণিত। দীর্ঘদিন ৯ শতাংশে আটকে রেখেও বিনিয়োগ বাড়েনি। এটা ঠিক, সুদহার কমলে ব্যবসায়ীদের ঋণের খরচ কমবে। তাতে তাদের মুনাফা বাড়বে। সাধারণ মানুষ কোনো সুফল পাবে না। কারণ, ব্যবসায়ীরা বেশি দামেই পণ্য বিক্রি করবেন। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনও কমেনি। এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার মূলে মৌসুম। ফলে এখনই সুদহার কমানোর সময় আসেনি। সুদহারের কারণে বিনিয়োগ বেড়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয় বর্তমান অবস্থার সঙ্গে মেলে না।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর মাধ্যমে। বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সেটি কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে ঋণের জোগান না বাড়িয়েও বেসরকারি খাতের জন্য একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো, সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার কমেছে। আবার স্বল্পমেয়াদি বন্ডের সুদহার দীর্ঘমেয়াদির তুলনায় বেশি। এ থেকে বার্তা পাওয়া যায়, মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা কমেছে। ব্যাংকাররা এতদিন মনে করছিলেন, সরকারি খাতে বেশি সুদ পেলে বেসরকারি খাতে কেন ঋণ দেবেন? এখন সেই ধারণায় পরিবর্তন আসবে, সামগ্রিকভাবে যা ইতিবাচক।
অন্যদিকে, মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে যে অবস্থান, তা ঘোষিত নীতির সঙ্গে একেবারে অসংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক টেলিফোনে কিংবা অন্য উপায়ে ১২২ টাকার ওপরে ডলার না কেনার অদৃশ্য করিডোর দিয়েছে। ডলারের দর বাড়লে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির যে যুক্তি, তা আগের সুরের পুনরাবৃত্তি। মনে রাখতে হবে, ডলারের জোগান কমে গেলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়বে। আমদানি ব্যাহত হলে প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়বে। গ্রীষ্মকাল আসছে, বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়বে। তেল-গ্যাসের আমদানি বাড়বে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলে লোডশেডিংয়ে মানুষ ক্ষেপে যাবে।
২০২২ সালে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর কম রাখা হয়েছিল। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি হুহু করে তখন বেড়েছিল। তাছাড়া বড় বড় এক্সচেঞ্জ হাউস ডলারের দর নির্ধারণে কারসাজির যে কথা বলা হচ্ছে, তা ঘটলে আন্তর্জাতিক রেগুলেটরের কাছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরা শুধু বাংলাদেশে ব্যবসা করে না। তারা কারসাজির ক্ষেত্রে কেবল বাংলাদেশকে কেন বেছে নেবে? দ্বিতীয়ত, ডলারের দর নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে কোনো কারণে আইএমএফের কর্মসূচি আটকে গেলে, বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু অর্থ ছাড়ের অঙ্ক দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। মনে হতে পারে, তাদের এক কিস্তি তো আমাদের ১৫ দিনের রেমিট্যান্সের তুলনায় কম। সেটি ইস্যু না। বরং আইএমএফের নীতির সঙ্গে দ্বিমতে অর্থ ছাড় আটকে গেলে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থার রেটিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এলসি কনফারমেশন বা অন্য গ্যারান্টির চার্জেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অবশ্য আইএমএফের সব কথা শুনতে হবে, তেমন না। সাংঘর্ষিক অবস্থানের পরিবর্তে যৌক্তিক সমাধান খুঁজতে হবে।
লেখক : সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস য় র বর ত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের ঋণ পেতে সরকার মরিয়া নয়: অর্থ উপদেষ্টা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তিসহ কোনো দাতা সংস্থার ঋণের জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এবং ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স ভালো।
আজ রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইজারের সঙ্গে বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বিশ্বব্যাংকের দেওয়া শর্তের প্রায় সবগুলো পুরণ করেছে সরকার। নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব আদায়ে আলাদা বিভাগ হবে, রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, করছাড়ও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আগামী জুনের আগে আরও কিছু শর্ত বাস্তবায়ন হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি কি পিছিয়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আগামী মার্চে তাদের বোর্ড মিটিং হবে। এটা জুন পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে এমন প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এখন পর্যন্ত উনারা এ বিষয়ে তাদের কিছু জানানো হয়নি। তবে সরকারের অবস্থান হচ্ছে– বর্তমানে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এবং ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স ভালো। তাই আমরা একেবারে মরিয়া হয়ে উঠিনি। শুধু আইএমএফের চতুর্থ কিস্তিই নয় যেকোনো ঋণের বিষয়েই একই কথা। আইএমএফের সঙ্গে মার্চের আগে সরকারের আলাপ হবে।
প্রসঙ্গত, চতুর্থ কিস্তির ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড় মুদ্রবিনিময়হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে না দেওয়া এবং কর–রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় ইতোমধ্যেই পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে আরও এক মাস পিছিয়েছে আইএমএফ। এটি আরও পিছিয়ে জুনে নিয়ে যাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইজার বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া পরিসংখ্যানের স্বচ্ছতা, অভ্যান্তরিণ সম্পদ আহরণ বাড়ানোসহ অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রম নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব আদায়ে দুটি বিভাগকে আলাদা করার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা তাদেরকে জানিয়েছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছে। এটি তারা বাস্তবায়ন করতে চান।
বাস্তবায়নে সুনিদির্ষ্ট কোনো দিনক্ষণ দেওয়া হয়েছে কিনা–এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে অগ্রগতি দেখতে চায়। তবে তারা এ–ও জানেন যে, সরকারের একটি নিদির্ষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। তিনি বলেন, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যেকোনো করছাড় বা নতুন করে করারোপ আইনি প্রক্রিয়ায় বাজেটের মাধ্যমে হওয়া দরকার হয়। অপার এক প্রশ্নের জবাবে মার্টিন রাইজার আরও বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাবে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ।