অনিয়ম, ব্যর্থতা এবং জালিয়াতির অভিযোগ থাকার পরও এককভাবে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি ভাতার অর্থ বিতরণ কোনো একক প্রতিষ্ঠানকে না দেওয়ার আলোচনা শুরু হয়েছিল। এ নিয়ে কয়েকটি বৈঠকে আগের মতো উপকারভোগীর পছন্দের এমএফএস অ্যাকাউন্টে বিতরণের সুপারিশ এসেছিল। সেই সুপারিশ উপেক্ষিত হয়েছে। 

গত ৫ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষ ও সমমানের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির জন্য তথ্য এন্ট্রির ক্ষেত্রে অভিভাবকদের শুধু নগদের অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আদেশে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের আওতায় ষষ্ঠ থেকে স্নাতক ও সমমান পর্যায়ের  শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি এবং ভর্তি সহায়তার অর্থ ডাক বিভাগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এর মাধ্যমে বিতরণের লক্ষ্যে গত বছরের ২ জুন ত্রিপক্ষীয় চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের শিক্ষার্থীদের তথ্য এন্ট্রির ক্ষেত্রে শুধু ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট নম্বর এন্ট্রির প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে।
এর আগে গত বছরের ১৮ এপ্রিল ট্রাস্টের আওতাধীন সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির ষষ্ঠ-দ্বাদশ ও সমমান শ্রেণির উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সব অনলাইন ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট ‘নগদ’-এ রূপান্তর করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে উপকারভোগীদের পছন্দের অ্যাকাউন্ট বাদ দিয়ে নগদের মাধ্যমে উপবৃত্তি নিতে আবার নতুন করে অ্যাকাউন্ট খোলার ঝামেলা পোহাতে হয়।  ২০২৪ সালের ১০ জুন পর্যন্ত তিনবার সময় বাড়ানোর পরও সব শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্ট ‘নগদ’-এ রূপান্তর করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিতরণ সম্পন্ন করতে ২৩ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে তাদের পছন্দের অ্যাকাউন্টেই উপবৃত্তি দেওয়া হয়।  

২০২১ সাল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব উপবৃত্তি কার্যক্রম প্রধামমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে পরিচালনা করা হতো। এর অধীনে অভিভাবকদের পছন্দের অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তি দেওয়া হতো। কিন্তু ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারিতে উপকারভোগী এবং তাদের অভিভাবকদের মতামত উপেক্ষা করে পছন্দের মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে উপবৃত্তি পাঠানোর পরিবর্তে এককভাবে নগদের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদানের নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের এই উপবৃত্তি পেতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অনেক জায়গায় এদের এজেন্ট নেই। আর নগদের অ্যাকাউন্ট খুলতেও নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। 

এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার নগদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। প্রশাসক বসানোর পর নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, নগদ লিমিটেডে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না। সাবেক সরকারের আমলে নিয়মের বাইরে গ্রাহক বানানো, সরকারি ভাতা বিতরণসহ একচেটিয়া সুবিধা পায় নগদ। প্রতিষ্ঠানটিতে যখন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন। সবার চোখের সামনে এসব অনিয়ম হলেও চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডাক অধিদপ্তর।
গত ১১ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, নিরীক্ষা চালানোর পর নগদে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ‘অনিয়মের’ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রকৃত টাকার চেয়ে অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকা ইলেকট্রনিক মানি (ই-মানি) তৈরি করেছে নগদ। বয়স্ক, উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি ভাতার অর্থ বিতরণ না করে নগদ সেই অর্থ অন্যখানে সরিয়েছে বলেও জানান গভর্নর। সম্প্রতি নগদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (সিইও) ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) স্মৃতি কর্মকার সমকালকে বলেন, উপবৃত্তি প্রদানে নগদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত রয়েছে। তার পরও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাগদের মাধ্যমে এ কার্যক্রম চালানো হবে কিনা তা জানতে চেয়ে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ডাক বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে নগদের মাধ্যমেই উপবৃত্তি প্রদান অব্যাহত রাখার অনুমোদন দেয়। সে অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন। 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপব ত ত র পছন দ র ব তরণ র ও সমম ন ন র পর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সন্তান জন্মের সময় ভেসে আসছিল নববর্ষের গান 

মেহেরপুর শহরে সূর্যের হাসি ক্লিনিকে হাসি ফুটে উঠল গোলাম মর্তুজা ও নাসরিন আক্তার দম্পতির মুখে। তাদের কোলজুড়ে এলো কন্যাসন্তান। বাংলা নববর্ষে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলো এই দম্পতির। 

মর্তুজা ও নাসরিনের বাড়ি একই গ্রামে, মেহেরপুর সদর উপজেলার চকশ্যামনগরে। সেই কবেকার কথা। পরস্পরের সঙ্গে দেখা, কথা। এরপর ভালো লাগা, ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে এক যুগ আগে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়েতে রূপ দেন তারা। বিয়ের পর কেটে যায় পাঁচটি বছর। এ সময় তাদের একটি ছেলের জন্ম হয়। এরপর থেকেই তাদের প্রত্যাশা ছিল মেয়ের। অবশেষে এবার নববর্ষের প্রথম প্রহরে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
 
শিশুটির বাবা মর্তুজা বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ সবসময়ই আমার মধ্যে আলোড়ন তুলত। মনে মনে বাসনা ছিল যদি বৈশাখের প্রথম দিন আমাদের সন্তান জন্ম হয় তাহলে খুব ভালো হতো। তবে সব কিছু তো পরিকল্পনা করে হয় না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রার্থনা কবুল করায় পহেলা বৈশাখে আমাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এতে আমাদের পরিবারের লোকজন সবাই খুব খুশি। আমরা দু’জনই কৃষক পরিবারের সন্তান। দু’জনই স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। দরিদ্র পরিবার হওয়ায় সেই অর্থে লেখাপড়া হয়নি। তবে কৃষক পরিবারে পহেলা বৈশাখের যে আমেজ আনুষ্ঠানিকতা তা সবসময় আমার কাছে প্রিয়।’ সন্তান ও মায়ের জন্য সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেছেন তিনি।

শিশুটির মা নাসরিন বলেন, ‘জন্মের পরপরই নার্সরা আমার বোনের কোলে তুলে দেয় আমার নাড়িছেঁড়া মামণিকে। মেয়ের বাবা ও খালা খুশিতে ভরে যায়। তোয়ালে জড়ানো মেয়েকে রাঙাতে দ্রুত বাজার থেকে একটি গোলাপি রংয়ের জামা কিনে এনে গায়ে পরিয়ে দেন মেয়ের বাবা। তখন আমার মেয়েকে দেখে পরীর মতো মনে হচ্ছিল। তখনও আমার শরীর অনেকটাই অবশ। হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো আমাকে। পাশেই দেওয়া হলো আমার রাজকন্যাকে। শরীরে যন্ত্রণা থাকলেও মেয়েকে দেখে মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। যন্ত্রণাও যেন কমে গেল অনেকটাই।’

নাসরিন জানান, সন্তান গর্ভে থাকাকালে তাঁর কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না। নিয়মিত চিকিৎসক দেখাতেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন যত এগিয়ে আসছিল ততই তাঁর স্বামী বলতে লাগলেন, তাদের সন্তান ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক না কেন যদি পহেলা বৈশাখে হয় তাহলে সেটি হবে একটি স্মরণীয় ঘটনা। অবশেষে নববর্ষের দিন সকালেই তাঁর ব্যথা ওঠে। তাদের গ্রাম থেকে হাসপাতাল ছয় কিলোমিটার দূরে। স্থানীয় বাহন নসিমনে করে তাঁকে হাসাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক বলছিলেন মায়ের স্বাস্থ্য ভালো আছে। নরমাল ডেলিভারি হয় কিনা সেই চেষ্টা করা যাক। তবে প্রথম বাচ্চা সিজারিয়ান হওয়ায় ব্যথা ওঠার ছয় ঘণ্টা পর স্বাভাবিক ডেলিভারি না হওয়ায় আবার সিজার করে কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই হাসপাতালের মাইকে আজান দেওয়া হয়েছে। তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি পরে জেনেছেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই বারান্দায় অপেক্ষারত সন্তানের বাবা, চাচা, খালারা পরস্পরের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।
 
নাসরিন বলেন, ‘আমি যেখানে সন্তান জন্ম দিয়েছি, সেখান থেকে অল্প দূরেই শহরের শহীদ সামসুজ্জোহা পার্ক। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই ওই পার্কে পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা চলছিল। সেই অনুষ্ঠান থেকে ভেসে আসছিল নববর্ষের গান। মনে মনে ভাবছিলাম এমন স্মরণীয় দিনে আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে খুব ভালো হবে। আমার রাজকন্যা পৃথিবীতে এলো। হাসপাতাল থেকে আমাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা দিতে এলে মনে হচ্ছিল আমার কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্নপূরণ হলো। আমাদের দু’জনেরই সিদ্ধান্ত মেয়েকে প্রথমে কোরআনের হাফেজ বানাব। এরপর সে স্কুলে পড়ালেখা করবে। মেয়েকে নিয়ে তেমন বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। তার ভাগ্যে যেটা আছে সেটাই হবে তার পেশা। তবে সে যেন মানুষর মতো মানুষ হয়, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। পহেলা বৈশাখ সন্তান জন্ম হওয়ায় আমি ও আমার স্বামী দু’জনই খুব খুশি।’

মেহেরপুর ম্যাটার্নিটি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ও সার্জন রামানা হেলালী জুসি বলেন, ‘মর্তুজা-নাসরিন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান পহেলা বৈশাখ দুপুর আড়াইটার সময় সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এদিন পহেলা বৈশাখ হওয়ায় হাসপাতাল থেকে সন্তানের মাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। শিশুটির মা ম্যাটার্নিটি হাসপাতালে তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতেন। শিশুটির বাবা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নিয়মিত ফলোআপ চিকিৎসা করাতেন। তিনি স্ত্রীর প্রতি খুবই যত্নশীল বলে তাঁর মনে হয়েছে। মায়ের স্বাস্থ্য ভালো ছিল। কোনো সমস্যা ছিল না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় শিশুটির ওজন ছিল তিন কেজি। তার রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ। মা ও মেয়ে দু’জনই সুস্থ আছে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ