রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে গত ২ ফেব্রুয়ারি ১১ বছর বয়সী কিশোরী আরাবি ইসলাম সুবা নিখোঁজ হলে দেশব্যাপী আলোড়ন তৈরি হয়। দুই দিন পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নওগাঁ থেকে তাকে উদ্ধার করে জানায়, প্রেমের সম্পর্কের কারণে সেখানকার এক কিশোরের সঙ্গে পালিয়েছিল সুবা। 

প্রায় একইভাবে গত ১৬ ডিসেম্বর কক্সবাজার থেকে প্রেমিকের সন্ধানে মাগুরায় আসে ১৪ বছরের এক কিশোরী। ১১ জানুয়ারি সিলেটের বিশ্বনাথ থেকে নিখোঁজ হওয়া স্কুলপড়ুয়া কিশোরীকে (১৩) পাবনায় প্রেমিকের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ২৯ ডিসেম্বর সকালে পরীক্ষার ফল জানার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল সে। ৩০ জানুয়ারি সিলেটের মোগলাবাজার থেকে নিখোঁজ কিশোরী নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে প্রেমিকের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। 
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে মাদ্রাসাপড়ুয়া এক কিশোরীর (১৭) সঙ্গে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার শিবপুরের মতিউর রহমান নামে এক তরুণের পরিচয় হয়। গত ১৯ জানুয়ারি ওই তরুণের বিরুদ্ধে শিশু অপহরণের মামলা করেন কিশোরীর বাবা।  

আরাবি ইসলাম সুবার ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন উঠলেও অন্য ঘটনাগুলো তেমন আলোচনায় আসেনি। কিন্তু পাঁচটি ঘটনারই যোগসূত্র ‘টিকটক’। ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে দীর্ঘদিনের পরিচয়, পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা-প্রেম। প্রেমের সম্পর্কের পরিণতি দিতেই অপরিণত বয়সে ঘর ছাড়ছে শিশু-কিশোররা! বাস্তবতা হচ্ছে, সব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে না। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। শুধু ঘরছাড়া কিংবা অপহরণেই সীমাবদ্ধ নেই; টিকটকে পরিচয় থেকে প্রেম এবং এ সম্পর্কের জটিলতায় গত দুই মাসে অন্তত চারজন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন।
টিকটকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে পরিচয়ের সূত্রে অপরিণত বয়সে প্রেম সত্যিকার অর্থে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। শিশু-কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালে তাদের যে মনোসামাজিক পরিবর্তন ঘটে; টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো ডিজিটাল মাধ্যম এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করছে। 

সুবা উদ্ধার হওয়ার পর অনেকেই তার চরিত্রের পোস্টমর্টেম করতে বসেছি। কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে ছেড়ে শিশুটির প্রেমিকের হাত ধরে চলে যাওয়া যে ক্যান্সারের চেয়েও ভয়াবহ! এ রোগে যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভয়ংকরভাবে আক্রান্ত, তা কি আমরা বুঝতে পারছি? এ রোগের দাওয়াই কোথায়?

দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ১৩ কোটিরও বেশি, যার বড় অংশ তরুণ-কিশোর। তাদের আবার বড় অংশ ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। বর্তমানে দেশের চার কোটিরও বেশি মানুষ টিকটক ব্যবহার করছে। ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় সাত কোটি। সামাজিক মাধ্যম যেমন নতুন প্রজন্মকে স্মার্ট ও যুগোপযোগী করে তুলছে, তেমনি ঝুঁকিও তৈরি করছে। বিশেষ করে ভিডিওনির্ভর সামাজিক মাধ্যমের প্রতি বর্তমান প্রজন্ম বেশি আগ্রহী। শিশু-কিশোরের জন্য যে ধরনের ভিডিও প্রযোজ্য নয়, তেমন ভিডিও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম রিলসে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ভিডিও কনটেন্টের ছড়াছড়ি। 

অশ্লীলতাসহ কমিউনিটি গাইডলাইন না মানায় টিকটক গত বছর বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের ১ কোটি ২১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৪৫টি ভিডিও ডিলিট করেছে। এই প্ল্যাটফর্মে কী সংখ্যক অশোভন কনটেন্ট আপলোড হয়, এ পরিসংখ্যানই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। 

সমস্যা কিংবা ঝুঁকি আছে– এটি বলে টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম বন্ধ করে ডিজিটাল বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ নেই। রোগ সারাতে মাথা না কেটে সামাজিক মাধ্যম, সামগ্রিক অর্থে ইন্টারনেটকে শিশুবান্ধব ও নিরাপদ করতে হবে। শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করে ইন্টারনেটের যে অপার সম্ভাবনা, সেটিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। 
সাধারণত ফেসবুক-টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর। কিন্তু প্রায় সব সামাজিক মাধ্যমেই বয়স লুকিয়ে যে কেউ এতে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। কেননা, বয়স কিংবা লিঙ্গ যাচাইয়ের কোনো সিস্টেম এতে নেই। টিকটক-ফেসবুকে ন্যূনতম কত বছর বয়স হলে অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে, সেটি অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার ঠিক করে দিতে পারে। সেটি যদি ১৩ বছরও হয়, সে নিয়ম যেন মানা হয়, তা মনিটর করতে হবে।

শিশু-কিশোরদের সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সাধারণত তারা যা দেখে কিংবা শোনে, যাচাই-বাছাই ছাড়া সহজেই তা বিশ্বাস করে। ফলে বিশাল এ সামাজিক মাধ্যমনির্ভর ইন্টারনেট-সমুদ্রে সমাজের নানা স্তরের দুর্বৃত্ত ওত পেতে থাকে। এরা নানাভাবে শিশু-কিশোর এমনকি সামাজিক মাধ্যম সম্পর্কে গভীর জানাশোনা নেই এমন ব্যক্তিদের প্রলুব্ধ করে আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি করে থাকে। সহজেই প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে শিকারে পরিণত হয়। অনলাইনে গেমস খেলার মাধ্যমে ডিভাইসসহ শিশুর মানসিক নিয়ন্ত্রণও নিতে পারে পৃথিবীর নানা প্রান্তে থাকা অপরিচিত ব্যক্তি। গেমিংয়ের ছলে শিশুদের পর্নোগ্রাফিতে যুক্ত করারও ভূরি ভূরি নজির রয়েছে।  

সামাজিক মাধ্যমসহ ইন্টারনেট সেবা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না; সেটা সমাধানও নয়। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষা দিতে ইন্টারনেটে বিচরণ যতদূর সম্ভব নিরাপদ করা। এ ক্ষেত্রে নীতিমালাসহ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা জরুরি। অভিভাবক, শিক্ষকসহ সমাজের অংশীজনকে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। প্রায় সব স্মার্টফোন ও কম্পিউটার ডিভাইসে সুলভ ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ ফিচার চালু করলে শিশু কী দেখছে, কী ডাউনলোড করছে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। শিশু দিনে ডিভাইসটি কতক্ষণ দেখতে পারবে, সেটিও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ইন্টারনেট সেবাদাতা কোম্পানিরও ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ সেবা রয়েছে। তবে এ ধরনের ফিচারের ব্যবহার অভিভাবকদের আগে শেখানো দরকার। এ ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত বাবা-মাকেই হিমশিম খেতে দেখছি। অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত বাবা-মায়ের জন্য তো তা দুরূহ! ফলে এটি নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি জরুরি।

সবচেয়ে জরুরি ইন্টারনেট সেবাদাতা (ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেট), ইন্টারনেটচালিত ডিভাইস স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ নির্মাতা ও পরিবেশক এবং টিকটক, ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমকে শিশুর সুরক্ষায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনায় বাধ্য করা। এসব কোম্পানি এমনিতেই কিন্তু বড় অঙ্কের ভ্যাট-ট্যাক্সে ছাড় পায়। এই ছাড় পেতে হলে করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটির (সিএসআর) বাজেটসহ আয়ের একটা অংশ সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে খরচ করার বাধ্যবাধকতা দেওয়া যেতে পারে। এ কর্মসূচির আওতায় তৈরি হবে শিশু-কিশোরবান্ধব মজার ও শিক্ষণীয় কনটেন্ট। সরকারের আইসিটি ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং টেলিকম নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসি এ ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। ইন্টারনেট বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে গিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; বিপথগামী না হয়; খড়কুটোর মতো ভেসে না যায়; সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অবারিত ইন্টারনেট-সমুদ্রে শিশুর সুরক্ষা সবার আগে– এই বাস্তবতা রাষ্ট্র যত দ্রুত বুঝবে ততই মঙ্গল।

হাসান জাকির: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
prantojakir@gmail.

com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইনস ট গ র ম প ল য টফর ম প রজন ম ব যবহ র ফ সব ক ট কটক

এছাড়াও পড়ুন:

জামায়াতের ইফতার মাহফিলে বিএনপির বাধা, থানায় মামলা

গাজীপুরের কালীগঞ্জে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ইফতার মাহফিলে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসময় দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে, ওই ঘটনায় উপজেলার বাহাদুরসাদী ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি মো. সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে কালীগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন।

বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ইউনিয়নের খলাপাড়া খাজা মার্কেট এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। 

আরো পড়ুন:

হবিগঞ্জের সাবেক এমপি আবু জাহিরসহ ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বাহুবলে গাছে বেঁধে আগুন, ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

আহতদের মধ্যে জামায়াতের দুই কর্মীকে গাজীপুর পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন- ঈশ্বরপুর এলাকার মফিজ উদ্দিনের ছেলে আসলাম (২৬) এবং খলাপাড়া এলাকার ইসলাম সরকারের ছেলে হাফিজ উদ্দিন (৩৫)। 

বাহাদুরসাদী ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর যুব বিভাগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক মো. সুমন মিয়া বলেন, “উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার খলাপাড়া খাজা মার্কেট এলাকায় ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। ইফতারের আগ মুহূর্তে স্থানীয় বিএনপির কর্মী আপেল, নুর ইসলাম ও আকরামসহ ১০-১৫ জন এসে বলেন, এই এলাকায় ইফতার মাহফিল করা যাবে না। এরপর কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তারা ইফতারের খাবার ফেলে দেন। পরে জামায়াতের কর্মীরা অন্য স্থানে ইফতার ও নামাজ শেষে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিএনপি কর্মীরা অতর্কিত হামলা চালায়। এতে আমাদের প্রায় ১০ জন আহত হন। তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।”

বাহাদুরসাদী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বলেন, “কেউ যদি আমাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালায়, তাহলে কি তারা রক্ষা করবে না? জামায়াতের নেতাকর্মীরা আমাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। এতে আমাদের প্রায় ৭-৮ জন আহত হন।” 

বিএনপির এই নেতা তাৎক্ষণিক আহতদের নাম পরিচয় দিতে পারেনি। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত জানানো হবে বলেও জানান তিনি।

গাজীপুর মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য খায়রুল হাসান বলেন, “আমাদের নেতাকর্মীদের ইফতার মাহফিলে বিএনপির নেতাকর্মীরা বাধা দিয়েছে। তাদের হামলায় আমাদের প্রায় ১০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। দুইজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় গাজীপুর পাঠানো হয়েছে।” 

কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক তারিকুল ইসলাম বলেন, “রাত ৯টার দিকে জামায়াতের পাঁচজন কর্মীকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। দুইজনকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।”

কালীগঞ্জ থানার ওসি মো. আলাউদ্দিন বলেন, “জামায়াত নেতা মো. সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে কালীগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”

ঢাকা/রেজাউল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ