চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্র—কোন দিকে যাবে পাকিস্তান
Published: 11th, February 2025 GMT
সম্প্রতি চীনে সরকারি সফরের সময় প্রেসিডেন্ট আসিফ জারদারি পাকিস্তানের কৌশলগত অংশীদারত্বের অটুট প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তাঁর এই সফর হলো এমন এক সময়ে, যখন পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা-সংকট চীন-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থিতিশীলতাকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলেছে।
প্রেসিডেন্ট জারদারির দল বর্তমানে বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশের ক্ষমতায় রয়েছে। এ কারণেও সফরটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই প্রদেশেই সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন চীনা নাগরিকেরা। এসব হামলা চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাকিস্তান সরকারকে প্রবল চাপের মুখে ফেলেছে।
যদিও নিরাপত্তাবিষয়ক সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থাপনা মূলত সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে, তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও পুলিশের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের ওপরই বর্তায়। তাই সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবিলায় তাদের কার্যকর সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুনপাকিস্তানে যে চার কারণে বাংলাদেশের মতো কিছু ঘটবে না২০ আগস্ট ২০২৪পাকিস্তানের অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো, যেভাবেই হোক চীনা বিনিয়োগকারীদের আরও আকৃষ্ট করা। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সম্পর্ক মজবুত হলেও পাকিস্তান চায়, তা আরও জোরদার করতে। তবে পাকিস্তান সতর্ক, যাতে তা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তার পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তবে চীনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে অনাগ্রহ বাড়ছে। আর এর কারণ নিরাপত্তাঝুঁকি, ঋণ পরিশোধের অনিশ্চয়তা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং পাকিস্তানের প্রশাসনের পশ্চিমাপন্থী অবস্থান।
পাকিস্তানে চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পারস্পরিক আস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমাগত নিরাপত্তা হুমকি দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে। ফলে পাকিস্তান কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে, যেন চীন নিশ্চিত হতে পারে যে পাকিস্তান তার স্বার্থরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বারবার পাকিস্তান ও চীন অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করলেও, বাস্তবে এসব বাধা অতিক্রমের অগ্রগতি ধীর। পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকেরা অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে ওঠে।
পাকিস্তান আপ্রাণ চেষ্টা করছে চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে। সামরিক প্রতিষ্ঠানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা যুক্তি দিচ্ছেন যে চীনের উত্থান সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের মতো নয়। তাই পাকিস্তান আরও ঘনিষ্ঠভাবে চীনের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে। তবে একটি মাত্র বৈশ্বিক শক্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা দীর্ঘ মেয়াদে কী কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা এখনো তা পুরোপুরি পর্যালোচনা করেননি।গত বছর দুটি ঘটনায় চীনা নাগরিক নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি চীনের সঙ্গে একটি যৌথ নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। করাচিতে এক নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে দুই চীনা নাগরিক আহত হওয়ার পর চীনের রাষ্ট্রদূত জিয়াং জায়ডংয়ের সঙ্গে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে পরবর্তী সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে যে এমন যৌথ নিরাপত্তাব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব না–ও হতে পারে। কারণ, পাকিস্তান যৌথ সামরিক মহড়া বা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম ছাড়া বিদেশি সেনাদের তার ভূখণ্ডে অবস্থানের অনুমতি দেয় না। চীনকে সন্তুষ্ট করতে পাকিস্তান সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান তীব্র করেছে। বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো রয়ে গেছে।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত নিরাপত্তাব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট দিকগুলো এখনো অস্পষ্ট। চীন ঠিক কী চায়, তার নাগরিকদের সরাসরি সুরক্ষা, একধরনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বলয়, নাকি এমন একটি যৌথ উদ্যোগ, যেখানে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনী একসঙ্গে কাজ করবে? আরও প্রশ্ন আছে, এই নিরাপত্তাব্যবস্থায় চীনের পক্ষ থেকে কারা যুক্ত থাকবেন? তাঁরা কি বেসরকারি নিরাপত্তা ঠিকাদার, নাকি নিয়মিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য? এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর এখনো অনিশ্চিত।
আরও পড়ুনআফগানিস্তান নিয়ে নীতি বদলাবে পাকিস্তান২৩ জানুয়ারি ২০২৫চীন যে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, তা স্পষ্ট। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রয়োজন আরও স্বচ্ছতা। চীন ও পাকিস্তান ইতিমধ্যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে বিভিন্ন স্তরে নিরাপত্তা সহযোগিতা বজায় রেখেছে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিওও) অধীনে এবং অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) জন্য বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার মাধ্যমে। তবে এই বহুস্তরীয় সহযোগিতা নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট জারদারির সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় তাঁর সফরসঙ্গী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি চীনের জননিরাপত্তা মন্ত্রী কি ইয়ানজুনের সঙ্গে এক বৈঠকে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান এবং সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা জোরদারের প্রতিশ্রুতি দেন।
এই বৈঠক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ, এর আগে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে মন্ত্রী নাকভি যুক্তরাষ্ট্রে একটি ‘চীনবিরোধী’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এ ধরনের ঘটনা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা গড়ে তোলার পথে আরেকটি বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চীন কখনো পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বজায় রাখার বিরোধিতা করেনি। তারা স্বীকার করে যে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
তবে চীনের উদ্বেগের কারণ ভিন্ন। তারা চায় না যে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ককে কূটনৈতিকভাবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রাখুক। বিশেষ করে যখন আমেরিকা ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বেইজিংয়ের মূল উদ্বেগ হলো, পাকিস্তানের আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক নির্ভরতা সিপিইসির ওপর ঋণ পরিশোধ ও প্রকল্পের গোপনীয়তা রক্ষায় প্রভাব ফেলতে পারে।
পাকিস্তান আপ্রাণ চেষ্টা করছে চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে। সামরিক প্রতিষ্ঠানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা যুক্তি দিচ্ছেন যে চীনের উত্থান সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের মতো নয়। তাই পাকিস্তান আরও ঘনিষ্ঠভাবে চীনের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে। তবে একটি মাত্র বৈশ্বিক শক্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা দীর্ঘ মেয়াদে কী কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা এখনো তা পুরোপুরি পর্যালোচনা করেননি।
এই সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলেছে ভারত নিয়ে পাকিস্তানের নিরাপত্তা নীতি, তালেবান সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক টানাপোড়েন, আফগানিস্তানের প্রতি ভারতের আগ্রহ। এসব জটিলতা সত্ত্বেও পাকিস্তান আশাবাদী যে চীন এ বছর দুটি বড় প্রকল্প-কারাকোরাম হাইওয়ে দ্বিতীয় ধাপ ও পাকিস্তানের রেল অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করবে।
মুহাম্মদ আমির রানা পাকিস্তানের নিরাপত্তাবিশ্লেষক
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ফরিদপুরে মঞ্চস্থ গণঅভ্যুত্থানের নাটক দ্য ডার্ক ক্রিস্টাল
শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ৬৪ জেলায় জুলাই গণঅভ্যুত্থান শীর্ষক প্রযোজনাকেন্দ্রিক নাট্য কর্মশালা ও মুনীর চৌধুরী নাট্যোৎসব বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ফরিদপুরের কবি জসীম উদ্দীন হলে সোমবার সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হলো জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত নাটক ‘দ্য ডার্ক ক্রিস্টাল’। নাটকটি লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইরা আহমেদ। নির্দেশনা দিয়েছেন ইরা আহমেদ ও বিশ্বনাথ ভৌমিক।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান মোল্লা। জেলা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এই মঞ্চনাটকে জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা সাইফুল হাসান মিলনের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বাকাহীদ হোসেন এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইয়াসিন কবির।
জানা গেছে, নাট্য প্রযোজনার জন্য ফরিদপুর জেলার নিয়মিত নাট্যদলসহ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাট্যচর্চায় যুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্য থেকে অডিশনের মাধ্যমে বাছাইকৃত ১৪ জনকে নিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি থেকে ১৫ দিনের এক কর্মশালা হয়েছে। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের নিয়েই সোমবার ‘দ্য ডার্ক ক্রিস্টাল’ মঞ্চস্থ হয়। কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দেন সহকারী অধ্যাপক ইরা আহমেদ। সহকারী প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন বিশ্বনাথ ভৌমিক।
জেলা শিল্পকলা একাডেমি ফরিদপুরের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ কর্মশালায় স্থানীয় সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ ও সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীসহ বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী, বহুরূপী সাংস্কৃতিক সংস্থা, বিনোদন নাট্যদল, উড়ানী নাট্যদল, সঙ থিয়েটার ও বাংলা থিয়েটারের নাট্যকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।