নির্বাচনী দৌড়ে কে এগিয়ে—বিএনপি না জামায়াত?
Published: 11th, February 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।’
গত ছয় মাসে সরকার রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পেরেছে কি না জানি না, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের বিষয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। বাইরের তৎপরতা দেখে অনেকে মনে করতে পারেন, কেবল বিএনপিই নির্বাচনের বিষয়ে বেশি তোড়জোড় করছে। আসলে তা নয়। ভেতরে ভেতরে সব দলই প্রস্তুতি নিচ্ছে। হিসাব করছে, কখন ভোট হলে কার বেশি লাভ।
বিএনপির নেতারা চলতি বছরের মাঝামাঝি নির্বাচনের কথা বললেও ডিসেম্বরকেই ডেটলাইন হিসেবে ধরে নিয়েছে।
সরকারেরও তেমন আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। জাপানের এনএইচকে টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
গত সোমবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেও নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়টি সামনে আসে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যসহ চলমান বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয় বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের জানিয়েছেন সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার আয়োজন করছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আলাদা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো একমত থাকলে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে। ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বৈঠক হবে তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কারের পদক্ষেপগুলো ব্যাখ্যা করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখে। ১৫ ফেব্রুয়ারির বৈঠকের বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের একজন নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বলেন, বৈঠক তো অর্থবহ হতে হবে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যতগুলো বৈঠক ছিল, রাজনীতিকেরা তাঁদের মতামত দিতে পারেননি। একসঙ্গে ২৫–৩০টি দলকে ডাকলে তারা কথা বলবে কীভাবে? কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হলে তো খোলামেলা আলোচনা হতে হবে।
সে ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকটি প্রলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর আগে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, প্রয়োজনে রোজার মধ্যেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রের বরাত দিয়ে একটি সংবাদমাধ্যম বলেছে, ‘নির্বাচন ডিসেম্বরের পরে হোক তা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কোনোভাবেই চান না। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আগামী ৬ ডিসেম্বর গণতন্ত্র দিবসে এই নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করা হয়েছে।’
৬ ডিসেম্বরের তাৎপর্য হলো ১৯৯০ সালের এই দিনে গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ৩৪ বছর পর আরেকটি গণ–অভ্যুত্থান হলো ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট।
নির্বাচনের দাবি জোরদার হওয়ার পাশাপাশি দলগুলোর মধ্যে ঝগড়াবিবাদও বাড়ছে। বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা সুযোগ পেলেই একে অপরের প্রতি আক্রমণের তির ছোড়েন। জামায়াতের এক নেতা বলেন, একদল দখলদারকে সরিয়ে জনগণ আরেকদল দখলদারকে ক্ষমতায় বসাতে চায় না। বিএনপির আরেক নেতার পাল্টা অভিযোগ হলো, প্রশাসন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবখানে জামায়াতের লোক বসানো হয়েছে।গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীনের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির তিন নেতা। তাঁরা বলেছেন, কোনো সংস্কারের দোহাই দিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হলে বিএনপি মেনে নেবে না। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছে। বিএনপির নেতারা ইসির কাছে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সবার আগে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে।
আগামী ১২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে সমাবেশ করবে বিএনপি। বিএনপির নেতারা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো, নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং ফ্যাসিবাদীদের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও ‘নির্বাচনের রোডম্যাপের’ দাবিই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
নির্বাচনের দাবি জোরদার হওয়ার পাশাপাশি দলগুলোর মধ্যে ঝগড়াবিবাদও বাড়ছে। বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা সুযোগ পেলেই একে অপরের প্রতি আক্রমণের তির ছোড়েন। জামায়াতের এক নেতা বলেন, একদল দখলদারকে সরিয়ে জনগণ আরেকদল দখলদারকে ক্ষমতায় বসাতে চায় না। বিএনপির আরেক নেতার পাল্টা অভিযোগ হলো, প্রশাসন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবখানে জামায়াতের লোক বসানো হয়েছে।
অন্যদিকে সাবেক ফ্যাসিবাদকে আশকারা দেওয়ার বিষয়েও বিএনপি ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে বাদানুবাদ চলছে। বিএনপি যখন ছাত্রদের দলকে কিংস পার্টি আখ্যা দিয়ে সমালোচনামুখর, তখন ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ বিএনপিকে দেশের প্রথম কিংস পার্টি বলে অভিহিত করছেন।
ডিসেম্বরের শুরু বা শেষে যখনই হোক না কেন, বাংলাদেশ এখন নির্বাচনী ট্রেনে উঠে গেছে। রাজনৈতিক আলোচনায় আগামী নির্বাচনই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব দল সংস্কার নিয়ে তোলপাড় করছে, তারাও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জোরেশোরে। যাঁরা বলছেন, সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচন হোক, তাঁদের হিসাবটা হলো নির্বাচন দেরিতে হলে তাঁরা দলকে ভালোভাবে সংগঠিত করতে পারবেন। আর যাঁরা দ্রুত নির্বাচন চাইছেন তাঁদের হিসাবটা হলো, অন্যরা সংগঠিত হওয়ার আগে ভোট হলে তাঁদের পক্ষেই জনসমর্থনের পাল্লা ভারী থাকবে।
আওয়ামী লীগ মাঠছাড়া হওয়ায় নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীই যে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো কার প্রস্তুতি কেমন? নেতাদের বক্তৃতা–বিবৃতিতে অনেকের মনে হতে পারে, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের কথা এখন ভাবছে না। তারা মৌলিক সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত আছে। দলের আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, এখন নির্বাচন করা হবে গণহত্যা। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা প্রায় প্রতিদিনই সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। আসলে রাজনীতির ভেতর–বাহির বলে একটা কথা আছে। জামায়াত প্রকাশ্যে সংস্কারের ইস্যুকে সামনে আনলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি অন্য প্রায় সব দলের চেয়ে বেশি। একটি উদাহরণ দিই। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো দল সম্ভাব্য প্রার্থীর কথা বলেননি। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী অনেকগুলো আসনে সম্ভাব্য প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে।
এর মধ্যে সিলেট বিভাগে ১৯টি, চট্টগ্রামের ১৬ আসনে, ফেনী-৩ (দাগনভূঞা-সোনাগাজী), বান্দরবান আসন, পটুয়াখালীর চারটি, পিরোজপুরে তিনটি, ঠাকুরগাঁওয়ে তিনটি, শরীয়তপুরের তিনটি, নাটোরের চারটি, ফরিদপুরের সব আসনে, দিনাজপুরের ছয়টি, কিশোরগঞ্জে পাঁচটি, ঝিনাইদহের সব আসনে, চুয়াডাঙ্গা-১, সিরাজগঞ্জের পাঁচটি ও সুনামগঞ্জের পাঁচটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। জামায়াতের আমির অবশ্য বলেছেন, এটা প্রাথমিক তালিকা, চূড়ান্ত নয়।
বিএনপি বা অন্য কোনো দল প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে বিএনপি দলীয় সূত্র জানিয়েছে, প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে তারা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ ও ২০১৮–এ দলীয় প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের পাশাপাশি তরুণ প্রার্থীদের কথাও বিবেচনা করবেন। তবে নির্বাচনের আগে আন্দোলনের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির আসন ভাগাভাগি কিংবা সমঝোতা হতে পারে বলেও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। অন্যান্য ইসলামী দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই।
বিএনপির আগাম প্রার্থী ঘোষণার সমস্যা হলো একই আসনে দুই বা ততোধিক প্রার্থী আছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম আগাম ঘোষণা দিলে অন্যরা তাঁর বিপক্ষে যাবেন। এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতা–কর্মীরা ভাগ হয়ে যাবেন এবং প্রতিপক্ষ এর সুযোগ পাবেন। বেশ কয়েকটি স্থানে সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
জামায়াতে ইসলামীতে সেই আশঙ্কা নেই। দলীয় নেতৃত্ব যাঁকে মনোনয়ন দেবে, নেতা–কর্মীরা সেটাই মেনে নেবেন।
এখানেই প্রশ্ন এসেছে, আগামী নির্বাচনী দৌড়ে কে এগিয়ে—বিএনপি না জামায়াত?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র ন ত র ড স ম বর র সরক র র ইসল ম হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
সদর উপজেলায় গ্রাম আদালত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে গ্রাম আদালত কার্যক্রমের অগ্রগতি বিষয়ে দ্বি-মাসিক সমন্বয় সভা ও গ্রাম আদালত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ড. মোঃ মনিরুজ্জামান, উপ পরিচালক (উপসচিব), স্থানীয় সরকার, নারায়ণগঞ্জ। সভায় সভাপতিত্ব করেন, রদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ জাফর সাদিক চৌধুরী।