ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আতিকুলসহ ৬ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ
Published: 11th, February 2025 GMT
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র মো.আতিকুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতাকে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার ও সদস্য বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী আজ মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
আতিকুল ছাড়া আওয়ামী লীগের অন্য পাঁচ নেতা হলেন রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মো.
আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র আতিকুল ইসলাম ও অন্য পাঁচজনসহ এই ছয় নেতাকে হাজির করার আবেদন করেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ। আদালতের নির্দেশের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের সময় ঢাকা উত্তরে প্রায় ২০০ লোক নিহত হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে ভূমিকা ছিল সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের। আর অন্য পাঁচ আসামি সরাসরি নির্দেশনা পেয়ে ঘটনাস্থলে থেকে তা বাস্তবায়ন করেছেন।
গণ–অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর উত্তরায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে একটি মামলার কার্যক্রম চলছে বলেও জানান প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের এই মামলায় যদি তাঁদের (সাবেক মেয়র আতিকুল ও আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতা) গ্রেপ্তার দেখানো না হয়, তাহলে তাঁরা বিভিন্ন মামলায় জামিন পেলে মামলার তদন্ত ব্যাহত হবে। যথাযথ ও কার্যকর তদন্তের জন্য তাঁদের ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন জানানো হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘প্রভাবশালী’ সদস্যের বিরুদ্ধে পরোয়ানা
গণ–অভ্যুত্থানের সময় উত্তরায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ‘খুবই প্রভাবশালী সদস্য’–এর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পারোয়ানা জারি করা হয়েছে বলে জানান প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন। তবে তাঁর নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি তিনি।
গাজী মোনাওয়ার হুসাইন জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেই সদস্য গণ–অভ্যুত্থানের সময় উত্তরায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্র–জনতার ওপর আক্রমণে সহায়তা করেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তাঁর অধীনস্তরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। ফলে যথাযথ ও কার্যকর তদন্তের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা জরুরি।
এ ছাড়া গণ–অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সে সময় উত্তরায় কর্মরত হোসেন আলী নামের পুলিশের এক কনস্টেবলকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ জানান, ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রিমান্ড নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অপর ধ র আওয় ম ইসল ম সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতেই থাকবে?
সমকালসহ গতকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এক. মাসখানেক আগে ধর্ষণের শিকার এক তরুণী আত্মহত্যা করেছে। তার পিতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন শহীদ। পটুয়াখালীর দুমকীতে পিতার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে সে আক্রান্ত হয়। এতে গ্রেপ্তার হয় অভিযুক্ত দু’জন। এর মধ্যে তারা জামিনও পায়। তারপর ঢাকায় আত্মহত্যা করে তরুণী। পরিবার বলছে, আসামিরা জামিন পেয়ে যাওয়ায় মর্মাহত হয়ে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দুই. টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে একটি পাঠাগারের বইপত্র লুট করে ইউএনওর কাছে জমা দিয়েছে ‘তৌহিদি জনতা’। পাঠাগারে ধর্মবিরোধী বই রাখার অভিযোগে ওই ঘটনা তারা ঘটায়। মামলা হয়েছে। এদিকে ইউএনও বলেছেন, দু’পক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা হবে।
প্রথম ঘটনাকে সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচনা করাই সংগত। অনেকে হয়তো বলবেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কন্যা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক উপাদান আছে। তেমনটি হলে মনে হয় না বর্তমান শাসনামলে আসামিরা সহজে জামিন পেত। তবে এ ধরনের মামলায় জামিন লাভ কতখানি গ্রহণযোগ্য– সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তারা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল বলেই জানা যায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর যেসব ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন আসেনি, তার মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ। তদন্তকারী পুলিশের বিষয়েও অভিযোগ কমেনি। যা হোক, আসামি জামিন পাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে ধর্ষিতার আত্মহত্যার ঘটনা মানুষকে ব্যথিত করবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কন্যাও ন্যায়বিচার না পাওয়ার ঘটনাটি হবে বিশেষভাবে আলোচিত।
দ্বিতীয় ঘটনা ‘মব ট্রায়াল’ বলেই বিবেচিত হবে। হালে এগুলোকে ‘মব ভায়োলেন্স’ বলা হচ্ছে। এসব অনেক বেশি ঘটছে গণঅভ্যুত্থানের পর। এর শিকার কেবল ক্ষমতাচ্যুতরা নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত। জনপ্রশাসনও বাদ যায়নি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপরেও কিছু হামলা হয়েছে। একই ধর্মাবলম্বীর মধ্যে ভিন্নধারার প্রতিষ্ঠানও হয়েছে আক্রান্ত। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তির সংকট কম উপস্থিত হয়নি। তা সত্ত্বেও সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে কমই। এর ধারাবাহিকতায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িসহ অনেক স্থাপনায় এক দল লোক বুলডোজার চালানোর মতো কাজও করেছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল– এসব আর ঘটতে দেওয়া হবে না। কিন্তু মব ভায়োলেন্স যে বন্ধ হয়নি– ধনবাড়ীর ঘটনাই তার প্রমাণ। ওই পাঠাগার থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বইও বস্তায় ভরে নেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। সালিশে এমন ঘটনার কী নিষ্পত্তি করা যাবে, কে জানে! কিছু লোকের একটা কিছু মনে হবে আর তারা দলবদ্ধ হয়ে যা খুশি করবে– এই বাংলাদেশ তো কেউ চায়নি। মব দ্বারা শতাধিক মাজার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বোঝা যায়, এদের হাতে স্বধর্মের ভিন্নধারাও নিরাপদ নয়। বিচারের দাবি উঠলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই। তৌহিদি জনতার নামে পাঠাগারে নৈরাজ্য চালানোর বিচারও কি হবে না? বিচার না হলে এমন ঘটনা আরও বড় পরিসরে ঘটার শঙ্কা অমূলক নয়। যেসব বইপত্র তারা বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে, সেগুলো দেশের অন্যান্য পাঠাগার আর বইয়ের দোকানেও আছে নিশ্চয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সমকালে দীর্ঘ প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞ মন্তব্য ছাপা হয়েছে গত শনিবার। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়– খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাইসহ ছয় ধরনের অপরাধ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে নারী-শিশু নির্যাতন আছে বৈ কি। আছে আসামি ছিনতাই, থানায় হামলার ঘটনা। খোদ শাহবাগ থানায় এক নারী উত্ত্যক্তকারীকে ছাড়িয়ে নিতে এক দল লোক কী করেছিল, তা সবার জানা। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলাকালেও এসব ঘটে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে এক দিন মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা গেল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পরই মহলবিশেষের দাবির মুখে এ পদে পরিবর্তন এনে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি কতখানি সাফল্য দেখাতে পেরেছেন, তা পৃথকভাবে বলার কিছু নেই। চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই সেটা বলছে।
গেল বছরের প্রথম তিন মাসের সঙ্গে চলতি বছরের সরাসরি তুলনা অবশ্য যুক্তিযুক্ত নয়। এর মধ্যে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীও ভেঙে পড়ে। এর কারণ সবার জানা। পুলিশকে সক্রিয় করতে এখনও লড়তে হচ্ছে সরকারকে। মাঠে বিশেষ ক্ষমতাসহ থাকতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। তাদের ওপর আস্থা আছে জনসাধারণের। তবে পুলিশের কাজে তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সেনাবাহিনী অপেক্ষা করছে– কবে পুলিশ পূর্বাবস্থায় ফিরবে। কিন্তু সরকারের ৯ মাস হতে চলার সময়ও পুলিশকে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। তাদের কাছে এসে অভিযোগ দাখিলে লোকে উৎসাহী হলেও এর নিষ্পত্তির চিত্র উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সেনাবাহিনীকেও অভিযুক্তদের থানায় এনে সোপর্দ করতে হচ্ছে। এর পর থানা ও আদালতপাড়ায় যা ঘটছে, তার চিত্র কি উৎসাহব্যঞ্জক?
গণঅভ্যুত্থানের পর কোথায় কোথায় আইনশৃঙ্খলার কতটা অবনতি ঘটেছিল, সে উদাহরণ টেনে অনেকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। এটা অযৌক্তিক নয়। অনেকে এমনও বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে গোটা পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ঘটনা বিরল। তবে আট-নয় মাস পরও অন্তর্বর্তী সরকার কেন পরিস্থিতিতে লক্ষণীয় উন্নতি ঘটাতে পারছে না, তার পক্ষে যুক্তি দেওয়া কঠিন। মাঝে রমজানে পণ্যবাজারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকার এক ধরনের সাফল্য কিন্তু দেখিয়েছিল। ঈদের পর সেটা ধরে রাখা গেল না কেন?
সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি রাজনৈতিক অপরাধ যেন আরও বেশি করে ঘটছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের চেষ্টা বাড়তে পারে। এসব দেখা যেত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদলের সময়ও। এবার স্বভাবতই তা সীমা ছাড়িয়েছে। সঙ্গে নতুন উপাদান হিসেবে চলছে মব ভায়োলেন্স। মবের ভয়ে মিডিয়াও কাজ যথাযথ করতে পারছে না বলে অনেকের অভিমত। সরকার ঘোষণা দিলেও তা দমনে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। আর রাউজানের মতো কোনো কোনো অঞ্চলে খুনখারাবি মানুষকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর হানাহানি চলছে আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্র দখলকে কেন্দ্র করেও। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকলে যে কোনো সরকারকেই দমাতে হয় এসব অপরাধ। বিশেষ কোনো পক্ষ অতিউৎসাহী হয়ে মব ভায়োলেন্স চালালে সেটাও দমন করতে হবে। নতুন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে বিশেষ নীতিকৌশল জরুরি হলে সে পদক্ষেপও সরকারকে নিতে হবে। সমধর্মী পট পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাও নেওয়া যায়। সেগুলো কেবল বর্ণনা করা হলে অনেকেরই মনে হবে, সরকার হয়তো পরিস্থিতির উন্নয়নে অনিচ্ছুক!
এমন ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ও রয়েছে– অন্তর্বর্তী সরকার এসব হতে দিচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অজুহাত তৈরি করতে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা তো স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে জাতীয় নির্বাচন। তার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতেও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে তৎপর হতে হবে সরকারকে। এদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে কম সচেষ্ট নয় সরকার। সে লক্ষ্য অর্জনেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে হবে। বর্ণাঢ্য বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালেও কিন্তু মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছিল কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দেশীয় প্রতিষ্ঠান!
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক