প্রায় এক যুগ আগের কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসে (নিনমাস) তখন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যারের মাধ্যমে রোগীদের সেবা কার্যক্রম থেকে শুরু করে সব কাজ পরিচালনা করা হতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয় সফটওয়্যারটিতে। সমস্যার দ্রুত সমাধান না হওয়ায় নিনমাসে বেশ কিছু দিন রোগীদের সেবা কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তখন তরুণ শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নুর সমস্যাটির কথা জানান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষক মাহবুবুল আলমকে। বিষয়টি জানার পর মাহবুবুল আলম দ্রুত সেই কারিগরি সমস্যার সমাধান করে দেন। দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে পারায় তৎকালীন নিনমাসের পরিচালক ডা.

মিজানুল হাসান মাহবুবুল আলমকে নিনমাসের সফটওয়্যার অটোমেশন করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এর পর থেকেই নিজের সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাজেদাটেক লিমিটেডের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে প্রযুক্তিসেবা দিয়ে আসছেন মাহবুবুল আলম।

শুরুর গল্প

মাজেদাটেক লিমিটেডের উদ্যোক্তা মাহবুবুল আলম ভারতের চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ২০০০ সালে সোনালী ব্যাংকে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দেন। এরপর ২০০৪ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করেন। এক বছর চাকরি করার পর ২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে আইসিটি বিষয়ে মাস্টার্স করেন। এরপর কাজের সূত্রে ২০০৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গেলেও পরে দেশে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করেন মাজেদাটেক লিমিটেড। শুরুতে মাত্র তিনজন কর্মী নিয়ে নিজের বাসার এক রুমে সফটওয়্যার তৈরির কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজিতে শিক্ষকতা চালিয়ে যান। ২০১২ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসের সমস্যার সমাধান করার পর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহার উপযোগী অটোমেশন ও গ্রাহকসেবা সফটওয়্যার তৈরি করেন। বর্তমানে শতাধিক দেশি প্রতিষ্ঠান মাজেদাটেক লিমিটেডের তৈরি সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

মাহবুবুল আলম বলেন, ‘শুরুতে আমরা অন্য সব প্রযুক্তি উদ্যোগের মতোই বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য ছোটখাটো কাজ করতাম। পরে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজের বিশাল সুযোগ পাই। তখন আমরা দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি সংকট ও সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে শুরু করি। ফলে আমাদের তৈরি সফটওয়্যার ও অ্যাপ ব্যবহার করে বিভিন্ন হাসপাতালের সেবাব্যবস্থা উন্নত ও দ্রুত হয়েছে। মাজেদাটেক লিমিটেডের স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ২৫ হলেও অনেক তরুণ খণ্ডকালীন যুক্ত রয়েছেন আমাদের সঙ্গে।’

দেশি হাসপাতালে দেশীয় সমাধান

মাজেদাটেক লিমিটেডের তৈরি করা সফটওয়্যার ও অ্যাপ ব্যবহার করছে জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি বড় সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল। এ বিষয়ে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা মূলত এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং, হাসপাতালের ইনফরমেশন, অ্যাকাউন্টিং ম্যানেজমেন্ট, ইনভেনটরি ম্যানেজমেন্ট, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, এয়ারলাইন ম্যানেজমেন্ট, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, রেস্টুরেন্ট ম্যানেজমেন্ট, স্টুডেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ই-প্রেসক্রিপশন সিস্টেম তৈরি করে থাকি। আমরা এক দশক ধরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মতোই উন্নত নিরাপত্তাযুক্ত সফটওয়্যার, অ্যাপ তৈরিসহ প্রযুক্তিসুবিধা দিচ্ছি। আমাদের কাজের মাধ্যমে দেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের ভরসা ও বিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। এখন শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরের অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছি। পাপুয়া নিউগিনির অন্যতম বড় একটি সুপারশপের বিক্রয় ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি অসংখ্য বিদেশি গ্রাহককে প্রযুক্তিগত বিভিন্ন সেবা দিচ্ছি আমরা।’

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত সেবা

আগে বিভিন্ন হাসপাতালে যেখানে চিকিৎসকের সাক্ষাৎ (অ্যাপয়েনমেন্ট) পাওয়ার জন্য রোগীদের ভিড় লেগে থাকত সেখানে অ্যাপ ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে দ্রুত সিরিয়াল দেওয়া কিংবা রিপোর্ট পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে মাজেদাটেক। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট ডা. মাহফুজা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে অটো রিপোর্ট ডেলিভারি সেবা, ই-প্রেসক্রিপশন সেবা, মোবাইল অ্যাপসে ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন কিউ ম্যানেজমেন্ট সেবা দিয়ে থাকে মাজেদাটেক লিমিটেড। এতে কমসংখ্যক কর্মীর মাধ্যমে আমরা অনেক বেশি রোগীর সেবা দিতে পারছি। রোগীরাও অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন রিপোর্ট পাচ্ছেন।’ জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোরশেদ আলম বলেন, ‘আমাদের এখানে রোগীদের অনেক চাপ। কিউ ম্যানেজমেন্ট সেবা চালু করে সেই চাপ এখন সুন্দর করে ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে। রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য আমাদের মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া অটো রিপোর্ট ডেলিভারির সেবা দেওয়ার মাধ্যমে দ্রুত রোগীদের সেবা দিতে পারছি আমরা। এই সেবা দেওয়ার কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম উন্নত হয়েছে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সফটওয় য র ব যবহ র সমস য র আম দ র র জন য ক জ কর

এছাড়াও পড়ুন:

যন্ত্র যখন বিশ্বস্ত সহকর্মী

শেষবার কবে আপনি আপনার ফোনের ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে আবহাওয়ার খবর জানতে চেয়েছিলেন? অথবা টেক্সট বার্তায় কোনো বানান ভুল ঠিক করতে অটোকরেক্টের সাহায্য নিয়েছিলেন, তা কি মনে আছে? সেই মুহূর্তে যন্ত্রটি আর নিছক একটি নিষ্ক্রিয় সরঞ্জাম ছিল না। সেটি যেন এক সহায়ক সহকর্মীর মতোই আপনার ছোট্ট একটি কাজে সাহায্য করেছিল। বিশ্বজুড়ে এবং বাংলাদেশেও এখন এমন ঘটনা ক্রমেই বেশি দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ডিজিটাল যন্ত্র সাধারণ হাতিয়ার থেকে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। অর্থাৎ, মানুষ এখন যন্ত্রকে আর শুধু ব্যবহারই করছে না, বরং তাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছে বন্ধু ও সহযোগীর মতো।

মানব–ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে যন্ত্র ছিল বাধ্য কর্মচারীর মতো। আমরা বোতাম চাপতাম আর যন্ত্র নির্দিষ্ট একটি কাজ করত। যেমন ক্যালকুলেটর শুধু সংখ্যা গণনা করত, কম্পিউটারও নির্দিষ্টভাবে প্রোগ্রাম করে দেওয়া কাজটাই করত। অন্য যন্ত্রগুলোকেও শুধু কী করতে হবে বললে হতো না; কীভাবে করবে, প্রতিটি ধাপ বলে দিতে হতো। কিন্তু আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অগ্রগতির ফলে যন্ত্রগুলো শেখার ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। এর মানে, আগেকার বাধ্য কর্মচারী মতো ধাপে ধাপে নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা না করে যন্ত্র এখন একটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং পারস্পরিক ও পারিপার্শ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা শিখছে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও এআই হাত বাড়িয়ে সহায়তা করছে। বাংলাদেশের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিক্ষা সফটওয়্যার (ইন্টেলিজেন্ট টিউটরিং সিস্টেম) প্রতিটি শিশুর জন্য উত্তর-প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে শিশুর ব্যক্তিগত সক্ষমতার স্তর অনুযায়ী প্রতিটি বিষয় সাজিয়ে দিতে পারে। এর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দিক হচ্ছে শিশুটি যত বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা সফটওয়্যারটির ব্যবহার করবে, সফটওয়্যারটিও শিশুটির বিষয়ভিত্তিক সক্ষমতার স্তরগুলো অধিকতর বিশ্লেষণ করে তার জন্য বিশ্বস্ত ও চাহিদা অনুযায়ী উপযোগী হয়ে উঠবে।

যন্ত্রগুলো সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক সুযোগও নিয়ে আসছে। এগুলো একঘেয়ে বা বিপজ্জনক কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারে। সেকেন্ডের মধ্যে বিশাল ডেটা সেট বিশ্লেষণ করতে পারে। এমনকি সৃজনশীল ধারণাও দিতে পারে। ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং উদ্ভাবনে গতি সঞ্চার হয়।

তবু বিশ্লেষকদের মতে, এআই এখনো কোনো একটি কাজ শতভাগ করার মতো কৌশল আয়ত্ত করতে পারেনি। সে শুধু আংশিক কাজই করতে পারে। একটি গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, প্রযুক্তি দিয়ে মোট কাজের মাত্র ৫ শতাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব। অধিকাংশ পেশায় এখনো কাজের বড় অংশের জন্য প্রয়োজন হয় মানুষের সরাসরি হস্তক্ষেপ। তবে মানুষের বিকল্প হিসেবে যন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপিত করা বা যন্ত্রের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরিতে ব্যস্ত প্রযুক্তিবিদেরা।

অবশ্য যন্ত্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতায় উদ্বেগ অনেক। যেমন জবাবদিহির প্রশ্নে যদি কোনো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ভুল করে, তবে দায় কার ওপর পড়বে? এ ধরনের প্রশ্ন এখনো আলোচনা ও বিতর্কের বিষয় হয়ে আছে। মানব-রোবট সহযোগিতার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম্যাথিয়াস ক্লাম্প উল্লেখ করেছেন, ‘বিপুল হারে চাকরি হারানোর ব্যাপারে অতিরিক্ত ভয় আমাদের দৃষ্টিতে যথার্থ নয়।’ তাঁর বিশ্বাস, এআই চাকরি বিলুপ্ত না করে বরং কাজের প্রকৃতি পরিবর্তন করবে। রুটিন কাজগুলো এআই দিয়ে করানো যাবে। আর মানুষ মনোযোগ দেবে সেই কাজগুলোয়, যেগুলো যন্ত্র ভালো পারে না।

সৃজনী শক্তির কথাই ধরুন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত ভালো কাজই করুক না কেন, মানুষের চেয়ে বেশি সৃজনশীল হতে পারেনি। আর এটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর মানুষের সক্ষমতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্যরেখা টেনে দেয়। এ জন্য এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কিছু চিন্তা করা ও ভবিষ্যতে ভালো ফল পাওয়ার জন্য সৃজনশীল কর্মীর সন্ধান করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক কাজের একক সমাধান হলেও মানবমস্তিষ্কের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ভবিষ্যতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সৃজনীক্ষমতা সংযোজন করতে পারলে তা নিশ্চয়ই চমৎকার হবে। তবে সেটি পরিপূর্ণ মানুষের প্রতিস্থাপন করার পরিবর্তে মানুষের সহকারী হিসেবে কাজ করবে। আবার জটিল চিন্তাশক্তির ক্ষেত্রে তা কেমন হতে পারে, তা ভাবার বিষয়।

চারপাশে তথ্য-উপাত্তের কোনো কমতি নেই। কিন্তু সেগুলো যাচাই-বাছাই করে বিশ্বস্ত উৎস নির্বাচন করার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেই। সর্বত্র যখন মিথ্যা, প্রতারণা ও গুজবের ছড়াছড়ি, তখন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই জটিলভাবে চিন্তা করে সঠিকতা খুঁজে বের করার জন্য এমন দক্ষ কর্মী চায়, যারা তথ্যের গুণগত বিষয় যাচাই করে নির্ভুল উৎস বাছাই করার ক্ষমতা রাখে। জটিল চিন্তার দক্ষতা মানে কেবল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার পরিবর্তে বিশ্বস্ততাকে বোঝায়। আর এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে এখনো আশা করা যায় না।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করা গেলেও কোন তথ্য দিয়ে কী নির্দেশ করে, তা বিচার করার ক্ষমতা কেবল মানুষেরই আছে। তথ্য বিবেচনা করে কোন সিদ্ধান্তের প্রভাব সমাজের প্রেক্ষাপটে সুফল বয়ে আনবে, তা যন্ত্র বা সফটওয়্যার বুঝবে না। ঠিক একইভাবে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নৈতিকতার মানদণ্ডে কতটুকু ইতিবাচক, তা জানার জন্য মানুষের প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই।

সিদ্ধান্ত প্রায়ই জটিল হয়ে যায়। তাই নির্দিষ্ট তথ্য দ্বারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ফলাফল বাতলে দিলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন তথ্য যুক্ত করার ফলে পুনঃসিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা আছে কেবল মানুষের। অন্যদিকে মানুষের আবেগ সচেতনতা, নিয়ন্ত্রণ ও প্রকাশ করার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে আলাদা বিশেষত্ব বহন করে। সামাজিক ও মুঠোফোনপ্রযুক্তি দ্রুত গ্রহণের ফলে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়কে ভিন্ন করেছে। যার ফলে ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি মানুষের আবেগিক বুদ্ধিমত্তা ও সহানুভূতি কমিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ প্রযুক্তির উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মানবশক্তি অগ্রাহ্য করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে—এমনটা ভাবা ভুলই বটে।

আবার দেখুন, মানুষের মধ্যে রাগ, ভয়, ঘৃণা, ভালোবাসার মতো অনুভূতি রয়েছে। কিন্তু রোবট মানুষের বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সৃষ্ট। তারা মানুষের মতো দেখতে ও কথা বললেও এর মধ্যে অনুভূতি বলে কিছু নেই। সে চিন্তা করবে কীভাবে? এটি চলে প্রোগ্রাম দিয়ে। এর ভেতর যতগুলো প্রোগ্রাম সেট করা থাকে, ততটুকুই সে করবে। এর বাইরে কিছুই না। অর্থাৎ একজন মানুষ হয়তো একটি আদর্শ রোবট বানাতে পারে, কিন্তু একটি রোবট একজন আদর্শ মানুষ বানাতে পারবে না।

তবু যন্ত্রের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে কাজে লাগাতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেওয়াই হবে ভবিষ্যৎ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। তাই স্কুলগুলোয় কেবল মৌলিক কম্পিউটার দক্ষতাই নয়, এআইয়ের সঙ্গে কাজ করার কৌশলও রপ্ত করাতে হবে। কারণ, যন্ত্র আর নিছক বুদ্ধিহীন যন্ত্রপাতি নয়। মানুষ ও যন্ত্র পরস্পরের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একসঙ্গে কাজ করার এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেন ‘মানুষ বনাম যন্ত্র’ নয়, বরং ‘মানুষ ও যন্ত্র একসঙ্গে’, একে অপরের বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে পরিগণিত হয়।

ড. মতিন সাদ আবদুল্লাহ অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যন্ত্র যখন বিশ্বস্ত সহকর্মী