২০৩০ সালের মধ্যে হোক প্রসবজনিত ফিস্টুলামুক্ত বাংলাদেশ, মর্যাদাপূর্ণ জীবন পাক নারী
Published: 11th, February 2025 GMT
রোকেয়া বেগম (৩৭ বছর) ছয় সন্তানের মা। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ১০ বছর ধরে প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছিলেন। বাসায় সন্তান প্রসবের সময় দীর্ঘ প্রসব বেদনা সত্ত্বেও বাধাগ্রস্ত প্রসবের মুখোমুখি হন, ফলে তিনি প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন।
এরপর রোকেয়া পরিবার ও সমাজে তীব্র যন্ত্রণা ও অপমানের মধ্যে জীবন যাপন করতে থাকেন। তাঁর স্বামী তাঁকে পরিত্যাগ করেন এবং একে একে শ্বশুরবাড়ির সদস্যরাও তাঁকে পরিত্যাগ করে দূরে সরে যান। একাকিত্ব ও মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতায় মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকেন রোকেয়া।
সৌভাগ্যক্রমে রোকেয়া একজন সরকারি মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে ফিস্টুলা চিকিৎসার বিষয়ে জানতে পারেন। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা গ্রহণের পর এখন তিনি ফিস্টুলা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক ২০ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন এবং তাঁদের জন্য রোকেয়ার গল্পটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। গর্ভধারণ প্রতিটি নারীর জীবনে একটি আনন্দময় অধ্যায়। তবে সুখকর হলে ও গর্ভকালীন অনেক জটিলতার ঝুঁকিও থাকে। যেমন বিলম্বিত বাধাগ্রস্ত প্রসব এবং প্রসবজনিত ফিস্টুলার আশঙ্কা, বিশেষ করে যখন প্রসবকালীন চিকিৎসাকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে বা অন্য কোথাও সন্তান প্রসব করা হয়, তখনে এসব জটিলতার আশঙ্কা বেশি থাকে।
প্রসবজনিত ফিস্টুলা হলে নারীর প্রসবের রাস্তার সঙ্গে মূত্রথলি/ মূত্রনালি বা মলদ্বার অথবা উভয়ের একটি অস্বাভাবিক সংযোগ স্থাপিত হওয়া। ফলে প্রসবের রাস্তা দিয়ে অনবরত নিয়ন্ত্রণহীন প্রস্রাব/ পায়খানা বা উভয়ই ঝরতে থাকে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা না করা হলে এই অবস্থা স্থায়ী হতে পারে, যা শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া থেকে শুরু করে একাকী, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন।
এই আঘাত নারীদের স্বনির্ভর হওয়াকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত করে এবং তাঁদের জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতাসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকিতে ফেলে, পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ও অবনতি ঘটে। প্রসবজনিত ফিস্টুলা মূলত দরিদ্র নারী ও কিশোরী, যাঁরা সমাজে পিছিয়ে আছেন, গ্রামে বসবাস করেন, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের হার কম, বাসায় অদক্ষ ধাই দিয়ে প্রসব করান বা দুর্গম এলাকায় থাকেন, তাঁদের মধ্যে এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ এবং মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি তাঁদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ প্রসব বাড়িতে হয়, যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণবিহীন ধাত্রীর সহায়তায় প্রসব হয়। আবার ৬৫ শতাংশ প্রসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে হলেও এর মধ্যে মাত্র ৩০ শতংশ সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্পন্ন হয়। শহরে বস্তিতে বসবাসকারী নারীদের প্রসবজনিত যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ বেশ কষ্টসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং। মানসম্পন্ন গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবার অভাবে তাঁদের প্রায়ই বাড়িতেই অথবা ব্যয়বহুল বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভকালীন সেবা নিতে হয়, যার কোনোটাই যথাযথ মানসম্পন্ন নয়, নিরাপদও নয়।
এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আশাব্যঞ্জক কিছু বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রসবজনিত ফিস্টুলা নিরসনে বিশ্বব্যাপী ‘অ্যান্ড ফিস্টুলা ক্যাম্পেইন’-এর অংশ হিসেবে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২ হাজার ৪৬৫ জন ফিস্টুলা রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ রোগী দক্ষতা উন্নয়ন ও জীবিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হয়েছেন।
৩৫টি জেলা হাসপাতালে ফিস্টুলা কর্নার এবং ৩০ জন সক্রিয় সার্জন ও ১৮টি ফিস্টুলা অপারেশন করার সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০২১ সালে পঞ্চগড় জেলা প্রথম ‘ফিস্টুলামুক্ত জেলা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা আরও ৯টি জেলায় ৯টি উপজেলায় বিস্তৃত হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বিভাগ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে ফিস্টুলা নিরসনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এখনো প্রায় ১৭ হাজার ফিস্টুলা রোগীর জন্য যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং বাকি ৬৩ জেলাকে ফিস্টুলামুক্ত ঘোষণা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ফিস্টুলামুক্ত করতে হলে মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাল্যবিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্ব প্রতিরোধশিক্ষা, আইন প্রয়োগ এবং কমিউনিটি সচেতনতার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ ও কিশোরী মাতৃত্ব প্রতিরোধ করলে ফিস্টুলার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। বাল্যবিবাহের মূল কারণগুলো উদ্ঘাটন করে তা মোকাবিলার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিক্ষা, আইন প্রয়োগ ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে অল্প বয়সে গর্ভধারণ রোধ করতে পারলে ফিস্টুলার ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব। পাশাপাশি মেয়েদের প্রজননস্বাস্থ্য, সন্তান জন্মদান সম্পর্কে সঠিকভাবে সচেতন করে তুলতে পারলে অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
কমিউনিটিভিত্তিক স্ক্রিনিং ও সচেতনতা কার্যক্রমপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে স্ক্রিনিং ক্যাম্পেইন এবং সচেতনতা বৃদ্ধি নারীদের চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ফিস্টুলা বিষয়ে বিদ্যমান ভুল ধারণা ও বিনা মূল্যে প্রদত্ত চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে অবগত করাটা জরুরি।
রেফারেল ব্যবস্থা ও উন্নত সার্জিক্যাল ম্যানেজমেন্টজটিল সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা এবং দক্ষ সার্জন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দক্ষ সার্জনদের ধরে রাখা এবং একই সঙ্গে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও সার্জন বাড়াতে হবে।
সামগ্রিক পুনর্বাসন ও কমিউনিটি সহায়তাঅস্ত্রোপচারের পর পুনর্বাসন কার্যক্রম, মনঃসামাজিক কাউন্সেলিং এবং জীবিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের পুনর্বাসিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আক্রান্তদের পুনর্বাসন নিশ্চিতকরণ ও দারিদ্র্য নিরসনে স্থানীয় সরকার, এনজিও, এবং কমিউনিটির মানুষসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করাটাও জরুরি।
মাতৃস্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নদক্ষ মিডওয়াইফ দ্বারা মাতৃস্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা এবং জরুরি প্রসূতি সেবা সহজলভ্য করার পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো শক্তিশালী করা অপরিহার্য। জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফিস্টুলা কর্নারগুলোর সময়মতো ফিস্টুলা নিরূপণ ও সেবা প্রদানে সক্ষমতা উন্নত করাও অপরিহার্য।
বাংলাদেশকে ফিস্টুলামুক্ত করতে বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীদারদের অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, উন্নয়ন অংশীদার, সরকার এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে, যাতে ফিস্টুলায় আক্রান্ত একজন নারীও ফিস্টুলা মোকাবিলায় বাদ না যান। বাংলাদেশের প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল প্রোগ্রামের অগ্রগতি প্রমাণ করে যে সঠিক প্রচেষ্টা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে কী সম্ভব।
ফিস্টুলা নির্মূল কেবল স্বাস্থ্যসেবার বিষয় নয়, এটি নারীদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং তাঁদের নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনার একটি সংকল্প। বাংলাদেশকে ফিস্টুলামুক্ত করতে হলে আমাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, এখনই যদি সবাই একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায় এবং বদ্ধপরিকর থাকে, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলামুক্ত করতে পারবে।
মাসাকি ওয়াটাবে প্রতিনিধি (ভারপ্রাপ্ত) ইউএনএফপিএ, বাংলাদেশ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ স ট ল ম ক ত করত ব যবস থ প রসব র র প রসব র জন য স র জন সরক র গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
২০৩০ সালের মধ্যে হোক প্রসবজনিত ফিস্টুলামুক্ত বাংলাদেশ, মর্যাদাপূর্ণ জীবন পাক নারী
রোকেয়া বেগম (৩৭ বছর) ছয় সন্তানের মা। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ১০ বছর ধরে প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছিলেন। বাসায় সন্তান প্রসবের সময় দীর্ঘ প্রসব বেদনা সত্ত্বেও বাধাগ্রস্ত প্রসবের মুখোমুখি হন, ফলে তিনি প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন।
এরপর রোকেয়া পরিবার ও সমাজে তীব্র যন্ত্রণা ও অপমানের মধ্যে জীবন যাপন করতে থাকেন। তাঁর স্বামী তাঁকে পরিত্যাগ করেন এবং একে একে শ্বশুরবাড়ির সদস্যরাও তাঁকে পরিত্যাগ করে দূরে সরে যান। একাকিত্ব ও মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতায় মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকেন রোকেয়া।
সৌভাগ্যক্রমে রোকেয়া একজন সরকারি মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে ফিস্টুলা চিকিৎসার বিষয়ে জানতে পারেন। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা গ্রহণের পর এখন তিনি ফিস্টুলা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক ২০ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন এবং তাঁদের জন্য রোকেয়ার গল্পটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। গর্ভধারণ প্রতিটি নারীর জীবনে একটি আনন্দময় অধ্যায়। তবে সুখকর হলে ও গর্ভকালীন অনেক জটিলতার ঝুঁকিও থাকে। যেমন বিলম্বিত বাধাগ্রস্ত প্রসব এবং প্রসবজনিত ফিস্টুলার আশঙ্কা, বিশেষ করে যখন প্রসবকালীন চিকিৎসাকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে বা অন্য কোথাও সন্তান প্রসব করা হয়, তখনে এসব জটিলতার আশঙ্কা বেশি থাকে।
প্রসবজনিত ফিস্টুলা হলে নারীর প্রসবের রাস্তার সঙ্গে মূত্রথলি/ মূত্রনালি বা মলদ্বার অথবা উভয়ের একটি অস্বাভাবিক সংযোগ স্থাপিত হওয়া। ফলে প্রসবের রাস্তা দিয়ে অনবরত নিয়ন্ত্রণহীন প্রস্রাব/ পায়খানা বা উভয়ই ঝরতে থাকে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা না করা হলে এই অবস্থা স্থায়ী হতে পারে, যা শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া থেকে শুরু করে একাকী, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন।
এই আঘাত নারীদের স্বনির্ভর হওয়াকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত করে এবং তাঁদের জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতাসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকিতে ফেলে, পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ও অবনতি ঘটে। প্রসবজনিত ফিস্টুলা মূলত দরিদ্র নারী ও কিশোরী, যাঁরা সমাজে পিছিয়ে আছেন, গ্রামে বসবাস করেন, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের হার কম, বাসায় অদক্ষ ধাই দিয়ে প্রসব করান বা দুর্গম এলাকায় থাকেন, তাঁদের মধ্যে এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ এবং মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি তাঁদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ প্রসব বাড়িতে হয়, যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণবিহীন ধাত্রীর সহায়তায় প্রসব হয়। আবার ৬৫ শতাংশ প্রসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে হলেও এর মধ্যে মাত্র ৩০ শতংশ সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্পন্ন হয়। শহরে বস্তিতে বসবাসকারী নারীদের প্রসবজনিত যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ বেশ কষ্টসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং। মানসম্পন্ন গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবার অভাবে তাঁদের প্রায়ই বাড়িতেই অথবা ব্যয়বহুল বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভকালীন সেবা নিতে হয়, যার কোনোটাই যথাযথ মানসম্পন্ন নয়, নিরাপদও নয়।
এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আশাব্যঞ্জক কিছু বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রসবজনিত ফিস্টুলা নিরসনে বিশ্বব্যাপী ‘অ্যান্ড ফিস্টুলা ক্যাম্পেইন’-এর অংশ হিসেবে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২ হাজার ৪৬৫ জন ফিস্টুলা রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ রোগী দক্ষতা উন্নয়ন ও জীবিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হয়েছেন।
৩৫টি জেলা হাসপাতালে ফিস্টুলা কর্নার এবং ৩০ জন সক্রিয় সার্জন ও ১৮টি ফিস্টুলা অপারেশন করার সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০২১ সালে পঞ্চগড় জেলা প্রথম ‘ফিস্টুলামুক্ত জেলা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা আরও ৯টি জেলায় ৯টি উপজেলায় বিস্তৃত হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বিভাগ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে ফিস্টুলা নিরসনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এখনো প্রায় ১৭ হাজার ফিস্টুলা রোগীর জন্য যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং বাকি ৬৩ জেলাকে ফিস্টুলামুক্ত ঘোষণা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ফিস্টুলামুক্ত করতে হলে মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাল্যবিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্ব প্রতিরোধশিক্ষা, আইন প্রয়োগ এবং কমিউনিটি সচেতনতার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ ও কিশোরী মাতৃত্ব প্রতিরোধ করলে ফিস্টুলার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। বাল্যবিবাহের মূল কারণগুলো উদ্ঘাটন করে তা মোকাবিলার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিক্ষা, আইন প্রয়োগ ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে অল্প বয়সে গর্ভধারণ রোধ করতে পারলে ফিস্টুলার ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব। পাশাপাশি মেয়েদের প্রজননস্বাস্থ্য, সন্তান জন্মদান সম্পর্কে সঠিকভাবে সচেতন করে তুলতে পারলে অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
কমিউনিটিভিত্তিক স্ক্রিনিং ও সচেতনতা কার্যক্রমপ্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে স্ক্রিনিং ক্যাম্পেইন এবং সচেতনতা বৃদ্ধি নারীদের চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ফিস্টুলা বিষয়ে বিদ্যমান ভুল ধারণা ও বিনা মূল্যে প্রদত্ত চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে অবগত করাটা জরুরি।
রেফারেল ব্যবস্থা ও উন্নত সার্জিক্যাল ম্যানেজমেন্টজটিল সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা এবং দক্ষ সার্জন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দক্ষ সার্জনদের ধরে রাখা এবং একই সঙ্গে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও সার্জন বাড়াতে হবে।
সামগ্রিক পুনর্বাসন ও কমিউনিটি সহায়তাঅস্ত্রোপচারের পর পুনর্বাসন কার্যক্রম, মনঃসামাজিক কাউন্সেলিং এবং জীবিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের পুনর্বাসিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আক্রান্তদের পুনর্বাসন নিশ্চিতকরণ ও দারিদ্র্য নিরসনে স্থানীয় সরকার, এনজিও, এবং কমিউনিটির মানুষসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করাটাও জরুরি।
মাতৃস্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নদক্ষ মিডওয়াইফ দ্বারা মাতৃস্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা এবং জরুরি প্রসূতি সেবা সহজলভ্য করার পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো শক্তিশালী করা অপরিহার্য। জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফিস্টুলা কর্নারগুলোর সময়মতো ফিস্টুলা নিরূপণ ও সেবা প্রদানে সক্ষমতা উন্নত করাও অপরিহার্য।
বাংলাদেশকে ফিস্টুলামুক্ত করতে বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীদারদের অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, উন্নয়ন অংশীদার, সরকার এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে, যাতে ফিস্টুলায় আক্রান্ত একজন নারীও ফিস্টুলা মোকাবিলায় বাদ না যান। বাংলাদেশের প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল প্রোগ্রামের অগ্রগতি প্রমাণ করে যে সঠিক প্রচেষ্টা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে কী সম্ভব।
ফিস্টুলা নির্মূল কেবল স্বাস্থ্যসেবার বিষয় নয়, এটি নারীদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং তাঁদের নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনার একটি সংকল্প। বাংলাদেশকে ফিস্টুলামুক্ত করতে হলে আমাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, এখনই যদি সবাই একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায় এবং বদ্ধপরিকর থাকে, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলামুক্ত করতে পারবে।
মাসাকি ওয়াটাবে প্রতিনিধি (ভারপ্রাপ্ত) ইউএনএফপিএ, বাংলাদেশ