অমর একুশে গ্রন্থমেলার ‘সব্যসাচী’ স্টলে আক্রমণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশ-বিদেশে বসবাসকারী ২০৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক।

‘নেটওয়ার্ক ফর ডেমোক্রেটিক বাংলাদেশ’ নামের আন্তর্জাতিক অ্যাকটিভিস্ট সংগঠনের ব্যানারে গতকাল সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। নেটওয়ার্কের পক্ষে বিবৃতিটি পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আজফার হোসেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সব্যসাচী স্টলে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের ন্যক্কারজনক আক্রমণ, প্রকাশনীর প্রকাশক-লেখক শতাব্দী ভবকে শারীরিক-মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় এই নাগরিকেরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন। সব্যসাচী স্টলের বিরুদ্ধে তসলিমা নাসরিনসহ ‘নাস্তিক্যবাদী ও শাতিমদের বই’ প্রকাশের অভিযোগ তুলে আগের দিন রোববার থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি দেওয়া হয়। এরপরও স্টলটিতে কোনো রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে না পারার ব্যর্থতার দায় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ও অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে। অথচ, ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পরে এই বইমেলা নিয়ে এই নাগরিকদের আশা ছিল, সব চিন্তা ও মতের প্রকাশ মুক্ত, অবারিত হবে। সব লেখক-প্রকাশক নির্ভয়ে নিজেদের বই প্রকাশ, পরিবেশন ও বিক্রয় করতে পারবেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরে এমন আঘাতের ঘটনায় তাঁরা (নাগরিকেরা) অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলেও তাঁরা একইভাবে একুশে বইমেলার ওপরে বারংবার আক্রমণ ঘটতে দেখেছেন।

বিবৃতিদাতারা বলেন, অতীতে শাসকগোষ্ঠীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর হুমকিতে রোদেলা, শ্রাবণের মতো প্রকাশনী মেলায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বই নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই ধারাবাহিকতাতেই স্বাধীন মত ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের ওপর এই আক্রমণ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জায়গায় আজ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কখনো তারা নারীদের ফুটবল খেলায় বাধা দিচ্ছে, আক্রমণ করছে। আবার কখনো তারা পতিত ফ্যাসিবাদের প্রতীক-স্থাপনার প্রতি জনগণের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ নিয়ে সেখানে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করছে। কৃষকের ভাস্কর্যসহ নানা রকম ভাস্কর্য ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারকে ভাঙচুর চালাচ্ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি তুলছে। সারা দেশে একের পর এক মাজারের ওপরে হামলা ও আক্রমণ চলছে। তৌহিদি জনতাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের হুমকি-ধমকিতে প্রশাসন নিরাপত্তা বিধানের পরিবর্তে ওরস শরীফ ও মেলা বন্ধ করে দিয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার জননিরাপত্তা প্রদানে, বিশেষ করে সব মানুষের ধর্মীয় ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছে। এর ফলে পতিত ফ্যাসিবাদীশক্তি বিশ্বে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের কবলে যাওয়া দেশ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চরমভাবে ব্যর্থ সরকার হিসেবে দেখাতে পারছে। এভাবেই তারা দেশে ও বিদেশে নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে পারছে।

বিবৃতিদাতারা বলেন, ‘এ অবস্থায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এবং অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করা বাংলাদেশের সমস্ত স্তরের জনগণের প্রতি আমাদের আহ্বান, দেশে ও বিদেশে আওয়ামী এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের নানারকম চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও উসকানিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করুন।’

বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের বাইরে থেকে যাঁরা নানাভাবে উসকানি দিচ্ছেন, প্রকারান্তরে তাঁরা দেশে বিভক্তির রাজনীতি তৈরির মাধ্যমে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তিকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলছেন। ফ্যাসিবাদী শক্তির হাতেই তাঁরা নানারকম অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। সরকারকে বিপদে ফেলছেন। এভাবে তাঁরা গণ-অভ্যুত্থানকেই দুর্বল করে ফেলতে ভূমিকা রাখছেন। ফলে যেকোনো ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উসকানি থেকে সবাইকে সাবধান থাকার আহ্বান জানান বিবৃতিদাতা নাগরিকেরা।

বিবৃতিদাতারা চারটি দাবি তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো—

১.

ঘোষণা দিয়ে পুলিশ ও গণমাধ্যমের সামনে বইমেলার স্টলে চালানো এই আক্রমণের সঙ্গে জড়িত সবাইকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে।

২. সব ধরনের মত-পথের বই প্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা নিশ্চিতে যেকোনো ফ্যাসিবাদী হামলা মোকাবিলায় বইমেলা ও প্রকাশনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কোনো গোষ্ঠীর উসকানি, দাবি বা হামলায় কোনো অবস্থাতেই যাতে কোনো স্টল সাময়িকভাবেও বন্ধ করা না হয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক যদি তা নিশ্চিত করতে না পারেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি তাঁর পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।

৩. সারা দেশে মাজার, ওরস শরিফ ও মেলার ওপরে আক্রমণ; নারী ফুটবলের ওপর হামলা; বিভিন্ন ভাস্কর্য ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে কার্যকর ভূমিকা দেখতে চান বিবৃতিদাতা নাগরিকেরা। এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের ব্যবস্থা করা হোক। মানে দোষী প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সাজার ব্যবস্থা করা হোক।

৪. অবিলম্বে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে হবে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বিবৃতিতে সই করা ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন—

আজফার হোসেন (শিক্ষক, গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটি), জোবাইদা নাসরীন (শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), হেলাল মহিউদ্দীন (শিক্ষক, মন্টক্লেয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি), ফাহমিদুল হক (লেখক ও শিক্ষক), রাহাত মুস্তাফিজ (লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট), কায়সুল খান (গবেষক ও কলামিস্ট), লুবনা ফেরদৌসি (শিক্ষক), কাশফিয়া নাহরিন (শিক্ষার্থী), মেহেরান সানজানা (অভিনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট), খন্দকার সুমন (চলচ্চিত্র নির্মাতা), সাইদুর রহমান (সংবাদকর্মী), সহিদুজ্জামান পাপলু (রাজনৈতিক কর্মী), প্রীতম শুভ (সংস্কৃতিকর্মী), শ্রাবণী মজুমদার (প্রকাশক), নাসরিন খন্দকার (নৃবিজ্ঞানী), বাধন অধিকারী (সাংবাদিক), লুনা রুশদী (লেখক), পাভেল পার্থ (লেখক ও গবেষক), অনিক দেবনাথ (উন্নয়নকর্মী), রায়হান রাইন (শিক্ষক), মারজিয়া প্রভা (অ্যাক্টিভিস্ট) প্রমুখ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ সরক র বইম ল উসক ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

তিন চিকিৎসকের স্মরণসভা: আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বললেন আলোচকেরা

দেশের স্বাস্থ্য খাতের তিন উজ্জ্বল নক্ষত্র প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস, শুভাগত চৌধুরী ও টি এ চৌধুরী মানুষের কল্যাণের জন্য এবং জনগণের কথা চিন্তা করে কাজ করেছেন। তাঁদের আদর্শ ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

আজ শুক্রবার ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে এই তিন চিকিৎসককে নিয়ে এক স্মরণসভায় এসব কথা উঠে আসে। বিশিষ্ট স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ টি এ চৌধুরী (এ এইচ এম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী), বিশিষ্ট লেখক ও চিকিৎসক শুভাগত চৌধুরী এবং রাজশাহী ক্যানসার হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও রোটারিয়ান প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসকে নিয়ে এই স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই তিন চিকিৎসকই মৃত্যুবরণ করেছেন।

অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছে কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম। সহযোগিতায় ছিল ওয়ার্ল্ড ক্যানসার সোসাইটি। সভায় চিকিৎসক ও তাঁদের শুভানুধ্যায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

এই তিন গুণী চিকিৎসকের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে জানিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘তাঁরা তিনজনই শিক্ষক, পরামর্শক ও দেশের রত্ন। তাঁদের যে অসমাপ্ত কাজ রয়েছে, সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তাঁরা লিখতেন। অপ্রকাশিত ও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলো একত্র করে তা সামনে আনতে হবে। তাহলেই তাঁদের স্মরণ করা হবে এবং চিন্তাগুলো সবার মাঝে থাকবে।’

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ও অধ্যাপক হালিদা হানুম আখতার বলেন, ‘যেকোনো সমস্যায় তাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ পাওয়া যেত। তাঁদের কাজ থেকে শিখতে হবে, কীভাবে তরুণদের উৎসাহিত করতে হয়। তাঁরা হারিয়ে যাননি, তাঁদের নিজেদের কাজের ভেতরে ধারণ করতে হবে।’

টি এ চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক সারিয়া তাসনিম বলেন, ‘তিনি গুরুজনেরও গুরু ছিলেন। তাঁর মতো এমন কর্মঠ ও অর্থবহ জীবন সবাই পায় না। তাঁকে স্মরণ করার পাশাপাশি তাঁর আদর্শ মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে।’

শুভাগত চৌধুরীর স্ত্রী কামনা চৌধুরী বলেন, ‘এই তিনজনই সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন।’ প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসের মেয়ে ইপ্সিতা বিশ্বাসও সবার কাজের মাধ্যমেই তাঁর বাবা বেঁচে থাকবেন বলে জানান।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই মানুষগুলো অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তাঁরা আমাদের আরেকটু বড় হতে অনুপ্রেরণা দেন।’

অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন কবি মোহন রায়হান, ওয়ার্ল্ড ক্যানসার সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ হুমায়ুন কবির প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ