‘কনডেমড সেলে একরকম কষ্টে ছিলাম। বাইরে এসেও তো কষ্ট। মা-ভাই-বোনের মুখের দিকে তাকলে তো বোঝা যাচ্ছে সংসারের অবস্থা! এখন কিছু একটা করতি হবে। করতি তো হবে; আমার তো ক্যাপাসিটি নাই। কী করব, এইটাই তো বুঝে উঠতি পারতিছিনে। নানাবাড়ির খুব সামান্য একটু সম্পত্তি ছিল। সেই সম্পত্তি বেইচে মামলার পেছনে গেছে। কেউ কেউ এখন দেখতে আসতেছে। সবাই ডাকাডাকি করতেছে। এসবের মধ্যেও আমার মাথায় খালি চিন্তা কীভাবে কী হবে।’

কথাগুলো ইব্রাহিম আলী শেখের। ডাকনাম সাগর। ২১ বছর কারাভোগ শেষে গত শনিবার সন্ধ্যায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অবশ্য বছর সাতেক আগেই মুক্ত হতে পারতেন। নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে খালাস পেয়েছিলেন ২০১৭ সালে। তবে খালাসের সেই আদেশ কারাগারে পৌঁছাতে লেগেছে এতটা বছর।

৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলা কারাগারের জেল সুপারের কার্যালয় থেকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারের কাছে ইব্রাহিম আলীর ছাড়পত্র পাঠানো হয়। সেখানে ইব্রাহিমের ঠিকানা লেখা আছে খুলনার বটিয়াঘাটার হাতিরাবাদ গ্রাম।

গতকাল সোমবার চর হাতিরাবাদ গ্রামে ইব্রাহিমদের পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, তাঁর বাবা মতিয়ার রহমান চর হাতিরাবাদ গ্রামে থাকলেও ইব্রাহিমরা সেখানে থাকেন না। ইব্রাহিমকে পাওয়া গেল বাগেরহাটের ফকিরহাটের লখপুর ইউনিয়নের ভবনা-খড়িবুনিয়া গ্রামে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ইব্রাহিম ভগ্নিপতি নওশের আলী খানের কাছে আছেন।

ভগ্নিপতির ঘরের পাশেই ইব্রাহিমের মা-ভাইয়েরও ঘর। মরা পশুর নদের চরের সরকারি জায়গায় ঘরবাড়ি করেছেন তাঁরা। ২১ থেকে ২২ বছর বয়সে যখন জেলে যান, তখন মায়ের সঙ্গে ইব্রাহিমরা থাকতেন বটিয়াঘাটার আমীরপুর গ্রামে। তাই নতুন ঠিকানায় ইব্রাহিমের এই প্রথম পা রাখা। ২০০৩ সালে যখন ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তাঁর বিয়ের বয়স বছর দুয়েক। সন্তানের বয়স কয়েক মাস। তাঁর জেলে থাকার সময়ে সন্তানের বিয়ে হয়ে গেছে। সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন স্ত্রী।

ইব্রাহিমের বড় ভগ্নিপতি নওশের আলী খান বলেন, ‘এখন ও একেবারে জিরো। স্ত্রী, পরিবার, টাকাপয়সা কিছু নেই। শ্বশুরের আরেকটা বিয়ে হওয়ায় সন্তানদের নিয়ে আমার শাশুড়ি পরের জায়গায় থাকত। মরা পশুরের দুই পাড়ে চর উঠেছে। আমরা বটিয়াঘাটার অংশে জায়গা না পেয়ে ফকিরহাটের পাড়ে জায়গা পেয়েছি। এখানেই সবাই মিলে থাকছি। জেল থেকে বের হয়ে ইব্রাহিম আমার কাছে থাকছে।’

দীর্ঘকাল পরে ছেলেকে কাছে পেয়ে খুশি ইব্রাহিমের মা কোহিনূর বেগম। হতাশাও আছে। কোহিনূর বেগম বলেন, ছেলে জেলে যাওয়ার পর কী যে খারাপ দিন গেছে! পয়সাকড়ির সমস্যা তো ছিলই, মামলা দেখাশোনার জন্যও কেউ ছিল না। বাবার বাড়িতে একটু জায়গা ছিল, সেটাও বিক্রি করে দেন। ইটের ভাটার কাজ, এর বাড়ি ওর বাড়ি কাজ করেছেন। ছোট ছেলেটা ছোট ছিল, দুটো মেয়ের বিয়ে বাকি ছিল, ইব্রাহিমের মেয়েটাও ছোট ছিল। জানের ওপর দিয়ে অনেক কষ্ট গেছে। ওপরওয়ালার ইচ্ছায় ছেল ফিরে এসেছেন, এতেই তিনি খুশি। তবে সংসার কেমনে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তাও আছে।

ক্ষোভও কম নয় কোহিনূর বেগমের। বললেন, ‘সাত বছর আগে খালাস পেয়েও জেলে থাকা লাগছে। সাতটা বছর ফাও খাটল। এর কি কোনো সুরহা হবে? ক্ষতিপূরণ তো আর পাওয়া যাবে না।’

কারাগার সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালের বটিয়াঘাটা থানার একটি হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ইব্রাহিম আলীকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পরে মামলাটি উচ্চ আদালতে গেলে ২০১৭ সালে তিনি খালাস পান। তিনি মোট চারটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড, বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় যাবজ্জীবন এবং অপর দুটি মামলায় ১০ বছর ও ৭ বছরের সাজা ছিল তাঁর। মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজার মামলায় খালাস পান। আর বাকি দুটি মামলায় সাজাভোগ পূর্ণ হয়ে যায়। উচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেলেও মুক্তির আদেশ না পাওয়ায় তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন।

নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ইব্রাহিম বলেন, ‘যে মার্ডারের ঘটনার জন্য জীবন থেকে ২১টা বছর চলে গেল, সেখানে আমি জড়িত ছিলাম না। খুন হওয়া ব্যক্তি আমাদের ভাইব্রাদার ছিল। খামাখা সন্দেহে জড়িয়ে গেছি। ওই সময় থেকেই তো কিছু নাই। সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধে ছিল। কাজকাম করে খাইতাম। জয়পুর বাজারে নাইটগার্ডের চাকরি করতাম। ভ্যান চালাইতাম। মামলায় নিজে কোনো উকিল দিতে পারিনি। সরকারিভাবে চলছিলাম। তাই হয়তো ভালো ফল পাইনি।’

অন্য মামলাগুলো কীভাবে হলো জানতে চাইলে ইব্রাহিম বলেন, হত্যা মামলার আরেকটা অংশ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা। পরে সন্দেভাজন হিসেবে আরও দুটো মামলায় নাম দেওয়া হয়েছে বলে তাঁর ভাষ্য।

জেলে থাকার সময় অন্য একজন কয়েদির সঙ্গে সখ্য হয় ইব্রাহিমের। সেই কয়েদির পরিচিত একজনকে দিয়ে নিম্ন আদালতের রায়ের বিপরীতে উচ্চ আদালতে আপিল করান ইব্রাহিম। তিনি বলেন, ‘আমার হয়ে মামলার কাজ করে দেওয়া ওই ব্যক্তি আমাকে জানিয়েছিলেন আমার খালাস হয়ে গেছে, আমি তাড়াতাড়ি বের হতে পারব। এরপর আমার কাছ থেকে ওকালতনামায় সই করিয়ে নিয়ে যান। কিছুদিন পর শুনি তিনি মারা গেছেন। আমার কাগজপত্র নিয়ে আর তদবির করার তেমন কেউ ছিল না। এর মধ্যে আমাকে খুলনা কারাগারে চালান করা হয়। একসময় শুনি, আমার কাগজপত্র খুলনায় এসেছে। কিন্তু কাগজপত্রের বিষয়ে আর কিছু জানতে পারি না।’

শেষ পর্যন্ত কীভাবে মুক্ত হতে পেরেছেন, সে কথা জানাতে গিয়ে ইব্রাহিম আলী শেখ বলেন, মাস দেড়েক আগে কারাগারে টিভি দেখার সময় একটা হেল্প লাইনের নম্বর দেখে মৃত্যুদণ্ডের আসামিদের মোবাইলে কথা বলার নির্ধারিত দিন কল করেন তিনি। এরপর তাঁর বিষয়টি নিয়ে নড়াচড়া হয়।

২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ইব্রাহিমকে খুলনা কারাগার থেকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। খুলনার জেল সুপার মো.

নাসির উদ্দিন প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ওই বন্দীর মামলার ছাড়পত্র ও উচ্চ আদালতের আদেশের ছায়ালিপি যথাসময়ে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র সেল সুপারের কাছে পাঠিয়ে দেন। আদেশ পৌঁছাতে কেন দেরি হয়েছে, এটা তাঁরা কিছু বলতে পারবেন না।

খালাস পাওয়ার পরও সাত বছর ফাঁসির সেলে থাকার ব্যাপারে খুলনায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ও আইনজীবী কুদরত-ই-খুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এককথায় এটা অমানবিক। আমরা বলি দেশে আইনের শাসন আছে। অথচ মানুষটা বিচার পেল, কিন্তু বিচারের বাস্তবায়ন বা প্রভাবটা যদি সাত বছর লাগে কার্যকর হতে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! বিচারের পর সেই রায় কার্যকর হওয়াটা জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে অনেক সময় এটা হচ্ছে না। বিচারব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা সক্রিয় না থাকলে বিচার পেয়েও যে অনেকে বিচারহীনতায় ভোগে, ইব্রাহিম তার উদাহরণ।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র ক

এছাড়াও পড়ুন:

ময়মনসিংহে জমির জাল কাগজপত্র তৈরি চক্রের হোতা গ্রেপ্তার

জমির দলিল, খতিয়ান, দাগ ও নাম পরিবর্তন করে নিমেষেই জাল কাগজপত্র তৈরি করতেন আলমগীর হোসেন (৩১)। নিজেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নামের সিল স্বাক্ষর তৈরি করে দিতেন। সেই জাল কাগজপত্র নিয়ে আদালতে মামলা ঠুকে দিয়ে গ্রামে চলত বিবাদ। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার রাতে অভিযান চালিয়ে জাল কাগজপত্র তৈরি চক্রের মূল হোতা আলমগীরকে গ্রেপ্তার করেছে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

গ্রেপ্তার আলমগীর হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়া ইউনিয়নে। অভিযানের সময় ৮টি জাল দলিল, বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের ভূমিসংশ্লিষ্ট ২০ কর্মকর্তাদের ৬২টি সিল, ৩৬টি খোলা রাবার সিল, ১৪টি রাবার সিলের প্লাস্টিক হোল্ডার ও খসড়া কাগজ জব্দ করা হয়েছে।

এ ঘটনায় আজ সোমবার বেলা তিনটার দিকে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম এম মোহাইমেনুর রশীদ চক্রটির তৎপরতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, দেড় বছরে বিপুলসংখ্যক জমিজমার কাগজপত্র চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করেছে। জেলায় হত্যাসহ সহিংসতার ঘটনাগুলোর অধিকাংশ জমির মালিকানাসংক্রান্ত ঘটনাকে ঘিরে। চক্রটি পুরোপুরি শনাক্ত করতে পারলে জমিজমাসংক্রান্ত সমস্যা প্রশমিত করা যাবে। জব্দ করা কাগজপত্রগুলো বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হবে।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানায়, আলমগীর তাঁর বাড়িতে দেড় বছর ধরে ভূমিসংশ্লিষ্ট জাল দলিল ও নাম খারিজের দলিলাদি তৈরি করে আসছিলেন। যিনি জমির মালিক নন, তাঁকে মালিক বানিয়ে দিতেন। এ জন্য মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিতেন। নামজারির ক্ষেত্রে নতুন নাম সংযুক্ত করা কিংবা যিনি জমির প্রাপ্য নন, তাঁর নাম সংযুক্ত করে জমির অংশীদার বানিয়ে জালিয়াতির কাজ করতেন। চক্রটিতে আরও অন্তত চারজন সদস্য কাজ করেন বলে জানা গেছে।

এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা হয়েছে। সেই মামলায় আলমগীর হোসেনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আজ বিকেলে তাঁকে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হাউজিংয়ের থাবায় হারাতে যাচ্ছে আরেকটি পুকুর
  • কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের ২৪ পদের ফল প্রকাশ
  • ময়মনসিংহে জমির জাল কাগজপত্র তৈরি চক্রের হোতা গ্রেপ্তার
  • বরিশালে গণঅধিকার পরিষদের কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ
  • যেভাবে প্রস্তুতি শুরু করবেন